CAA: নাগরিকত্বের নামে ভোট টানতে হিন্দুদের মধ্যেই বিভাজন করে ফেলছে বিজেপি?
CAA Implementation: অসমের হিন্দুরা তো একেবারেই খুশি নন। অসমে বাংলাভাষী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
ঠিক লোকসভা ভোটের মুখে CAA অর্থাৎ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর হওয়ার কথা ঘোষণা করল বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে ঠিক এভাবেই সিএএ-এনআরসি নিয়ে উত্তপ্ত ছিল দেশ। সেবার চালু করার কথা বলা হয়েছিল, এবার চালু করে দিয়ে লোকসভা ভোটের হাওয়া নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেলল বিজেপি। এই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা সিএএ আসলে কী?
সিএএ হলো ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন। এই নতুন আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে যে সমস্ত অমুসলিমরা অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের নির্দিষ্ট নথি ও শর্ত মিলিয়ে নাগরিকত্বের শংসাপত্র দেবে ভারত। ঠিক ১১ মার্চ দিনটিকেই সিএএ কার্যকর ঘোষণার জন্য বেছে নেওয়ার পিছনে বিজেপি সরকারের যথেষ্ট অঙ্ক কষা রয়েছে। ১১ মার্চ ছিল মতুয়া সম্প্রদায়ের গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী। মতুয়া ভোট টানতে এটিই ছিল বিজেপির মোক্ষম অস্ত্র। বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুরকে দিয়ে এই আসন জেতাতে মতুয়াদের দেওয়া নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি পালন করতেই হতো বিজেপিকে। বাংলায় ৩৯টি বিধানসভা আসনে ২০ শতাংশের বেশি মতুয়া ভোট রয়েছে। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব বর্ধমান জেলায় মতুয়ারা আছেন। অর্থাৎ লোকসভা ভোটে এই আসনগুলিতে সিএএকে সামনে রেখেই হিন্দু ভোট একত্রিত করবে বিজেপি। পাশাপাশি, ১২ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে রমজান মাস। তার ঠিক আগের দিন সিএএ ঘোষণা করা হয়েছে। সিএএ এনআরসি-র দোসর। ফলে একদিকে সিএএ দিয়ে হিন্দুদের অভয় দিচ্ছে বিজেপি অন্যদিকে মুসলিমদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া গেছে।
আরও পড়ুন- রমজান শুরুর দিনটিই কেন সিএএ ঘোষণার জন্য বেছে নিলেন মোদি?
তিন দেশের অত্যাচারিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারত নাগরিকত্ব দেবে বলেছে। এই তিন দেশেই মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। অথচ নিজদেশেই পরবাসী তসলিমা নাসরিন। ধর্মে তিনি মুসলিম। তাহলে এমন কেউ যদি ভারতে আশ্রয় চান, তারা ঠাঁই পাবেন না? নেপাল, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা থেকেও তো অনেক মানুষই ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে আশ্রয় খোঁজেন? তারা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন না? কোনও উত্তর নেই এই সব প্রশ্নের। নাগরিকত্ব চাইতে গেলে কী কীতথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে? প্রথম ভাগের (১এ) জন্য নিম্নলিখিত নথিগুলির মধ্যে যে কোনও একটি জমা দিতেই হবে—
১। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান সরকারের ইস্যু করা পাসপোর্ট।
২। সংশ্লিষ্ট দেশের প্রশাসন কর্তৃক জারি করা জন্মের শংসাপত্র।
৩। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের স্কুল/কলেজ/বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্র।
৪। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র।
৫। বিদেশি আঞ্চলিক নিবন্ধন আধিকারিক বা ভারতে বিদেশি নিবন্ধন আধিকারিকের দ্বারা জারি করা আবাসিক অনুমতি পত্র।
৬। ওই তিন দেশের জারি করা যে কোনও লাইসেন্স।
৭। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে জমি বা ভাড়াটে সংক্রান্ত রেকর্ড।
৮। আবেদনকারীর পিতা-মাতা বা দাদু-ঠাকুমা বা প্রপিতামহের মধ্যে একজন ওই দেশগুলির নাগরিক বা নাগরিক ছিলেন, এমন নথি। বস্তুত, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সরকারের জারি করা যে কোনও নথি, যা প্রমাণ করে যে, আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক ছিলেন। সেই নথির বৈধতার সময়কাল অতিক্রান্ত হলেও তা গ্রাহ্য হবে।
আরও পড়ুন- ভোটের ঠিক আগেই কেন CAA? কোন চাল বিজেপির?
দ্বিতীয় ভাগে (১বি) নথির মাধ্যমে প্রমাণ দাখিল করতে হবে যে, ওই ব্যক্তি কখন ভারতে প্রবেশ করেছেন। তার জন্য নথির তালিকার মধ্যে রয়েছে
১। ভারতে আসার ভিসার ফোটোকপি এবং অভিবাসন দফতরের স্ট্যাপ যুক্ত নথি।
২। রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা আবাসিক অনুমতি পত্র যা ভারতে ‘ফরেনার্স রিজিয়োনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার’ বা ‘ফরেনার্স রেজিস্ট্রেশন অফিসার’ (FRO) দ্বারা জারি করা হয়।
৩। ভারতে জনগণনার সময়ে গণনাকারীদের দেওয়া নথি বা স্লিপ।
৪। ভারত সরকারের জারি করা লাইসেন্স বা শংসাপত্র বা পারমিট (ড্রাইভিং লাইসেন্স, আধার কার্ড ইত্যাদির মধ্যে একটি)।
৫। রেশন কার্ড।
৬। সরকারি স্ট্যাম্প-সহ আবেদনকারীকে সরকার বা আদালতের দেওয়া কোনও চিঠি।
৭। ভারত সরকার কর্তৃক জারি করা আবেদনকারীর জন্মের শংসাপত্র।
৮। আবেদনকারীর নামে ভারতে নিবন্ধিত জমির কাগজ বা ভাড়াটে রেকর্ড।
৯। প্যান কার্ড। কবে ইস্যু করা হয়েছে তার তারিখ থাকতে হবে।
১০। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার জারি করা কোনও নথি।
১১। গ্রাম বা শহরের স্থানীয় প্রশাসনে অথবা কোনও সংস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির জারি করা শংসাপত্র।
১২। আবেদনকারীর ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসের অ্যাকাউন্টের প্রমাণ এবং ব্যাঙ্ক/পোস্ট অফিস কর্তৃপক্ষের জারি করা ওই অ্যাকাউন্টের বিবরণ।
১৩। আবেদনকারীর নামে ভারতে থাকা বিমা সংস্থার পলিসির কাগজ।
১৪। আবেদনকারীর নামে থাকা বিদ্যুৎ বিল।
১৫। আবেদনকারীর নামে যদি আদালত বা ট্রাইবুন্যালে কোনও রেকর্ড থাকে, তার নথি।
১৬। কর্মচারী ভবিষ্য তহবিল/ সাধারণ ভবিষ্য তহবিল/ পেনশন/ এমপ্লয়িজ স্টেট ইনসিয়োরেন্স কর্পোরেশন দ্বারা অনুমোদিত ভারতে কর্মসংস্থানের নথি।
১৭। আবেদনকারীর কাছে এ দেশের স্কুল পাস সার্টিফিকেট থাকলে, সেটি।
১৮। এ দেশে স্কুল/কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়/ সরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্র।
১৯। পুরসভার দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স।
২০। বিয়ের শংসাপত্র
এবার বাস্তব সত্য হচ্ছে, এমন বহু বহু মানুষ আছেন যাদের কাছে এই নথি নেই। বাংলাদেশের বাড়ির রেকর্ড, সে দেশের স্কুলের শংসাপত্র তাঁদের নেই, জোগাড়ের সম্ভাবনাও নেই। তাহলে ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন না তারা? সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সিএএ অনুযায়ী আগে এই মানুষদের নিজেদের অনাগরিক প্রমাণ করতে হবে। এতদিন ভারতেই রইলেন, তাঁরাই ভোট দেন, তাঁদের আধার কার্ডও আছে। সেসব নথিও ভারত সরকারেরই দেওয়া। তাহলে এই মানুষরা রাতারাতি অনাগরিক হতে যাবেন কেন? এই দেশের নাগরিকই যদি না হন এতদিন ভোট দিলেন কীভাবে তারা? এই প্রশ্নের উত্তর কোথাও গুছিয়ে দেওয়া নেই। অন্যদিকে সিএএ ঘোষণার পরেই অসমে ফের বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, কেউ যদি এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন না করে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পান তবে তিনি পদত্যাগ করবেন। অসমের হিন্দুরা তো একেবারেই খুশি নন। অসমে বাংলাভাষী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তাহলে একদিকে মতুয়া ভোট টানতে গিয়ে হিন্দুদের মধ্যেও কি বিভেদ তৈরি করে দিল সিএএ?