কাকে ভোট দিচ্ছেন তার নেপথ্যেও আছে বিজ্ঞান! জানেন, কোন অঙ্ক মেনে চলে গণতন্ত্র?
Science of Election: প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে, সর্বসাকুল্যে ৫০%-এর কম ভোট পেয়েও জয়ী হচ্ছেন প্রার্থী। এটি এই 'এফ পি টি পি' পদ্ধতির আরেক সমস্যা।
দুনিয়ার সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের উৎসবের উদযাপন চলছে দেশজুড়ে। একে একে পেরোচ্ছে নির্বাচনী দফা। আমজনতার কাছে নির্বাচন এক উচ্ছ্বাস, নিজের পছন্দের রাজাকে মনোনীত করার উদযাপন! কিন্তু কীভাবে ঠিক হলো বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি? এই পদ্ধতিও কি সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য? সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকে কি আমরা সবসময়ই সত্যিই নির্বাচন করতে পারি? ভোটের উত্তেজনা, দামামা, কাদা ছোড়াছুড়ি এক পাশে সরিয়ে রেখে নির্বাচনের পিছনে থাকা বিভিন্ন গাণিতিক সম্ভাবনার কথা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে নির্বাচনের ধরনটা ছিল অদ্ভুত। কয়েকজন যোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া হতো। সেখানে নির্বাচনের প্রচার, দলীয় প্রভাব, অর্থ-বিত্ত কোনও কিছুই বিশেষ গুরুত্ব পেত না। যাঁর কপালে শিকে ছিঁড়ত, সেই-ই রাজা। আমাদের দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে নাকি আরেক অদ্ভুত নির্বাচন পদ্ধতি চালুছিল। যার নাম ছিল 'কুদাভোলাই'। চোল লিপি থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে সেখানে তালপাতায় যোগ্য প্রার্থীদের নাম লেখা হতো। স্থানীয় ভাষায় সেগুলিকে বলা হতো 'ভোলাই'। তারপর সেই পাতাগুলোকে মাটির হাঁড়িতে রেখে এলোমেলো করে দেওয়া হতো। খানিক ওই টিকিট ঝালিয়ে নেওয়ার মতো আর কী। মাটির হাঁড়িগুলোকে বলা হতো 'কুদা'। তারপর সেখান থেকে একজন কিশোর খেয়ালখুশি মতো একটি পাতা তুলতো, যাঁর নাম আসতো সেই-ই নেতা।
আরও পড়ুন- ২৬ ফুট লম্বা দৈত্যাকার সবুজ সাপ! আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যের যে খোঁজ তাক লাগিয়েছে বিজ্ঞানীদের
উপরের কোনও পদ্ধতিই যুৎসই নয়। মানে ব্যাপারখানা এমন, "যাও একজন নেতা নির্বাচন করো"। আধুনিক যুগে এরকম যে চলবে না তা বলাই বাহুল্য। আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে এখন চালু আছে ' ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট সিস্টেম' বা 'এফ পি টি পি'। বেশ কিছু গণ্ডগোল এখানেও রয়েছে। যেমন, আমার আপনার মতো আম-আদমির ইচ্ছার যে খুব গুরুত্ব আছে তা কিন্তু নয়। গণতন্ত্রে জনতাই জনার্দন, সেখানে গুরুত্ব নেই কী করে সম্ভব? অনেকসময় আমরা দেখি, বেগুনি দলের গ্রহণযোগ্যতা দেশের মানুষের কাছে মোটামুটি ৪৮% কিন্তু ফল ঘোষণার পর দেখা গেল মাত্র ৪% আসনে বেগুনি পতাকা তুলতে পেরেছে, ওদিকে নীল পার্টির গ্রহণযোগ্যতা ৫০% হলেও জয়ের নিরিখে বাজিমাত করেছে ওরা। নির্বাচনের নেপথ্যে মিশে থাকা অঙ্ক বিষয়টা আরও জটিল। সূক্ষ্মভাবে বললে একে বলা যায় অ্যালগরিদম। ২০১৫ সালে দিল্লির নির্বাচনের দিকে খেয়াল করলে এর বাস্তব রূপ আরও পরিষ্কার হবে। মোদ্দা কথা, ভোট শেয়ার ও আসন শেয়ারের ভেতর সমতা নেই। এই সিস্টেম মূলত ফার্স্ট প্রেফারেন্স টাইপ সিস্টেম। মানে যাকে আপনার পছন্দ তাকে ভোট দিলেন কিন্তু যাকে একটু কম পছন্দ, মনে হয় সেই প্রার্থী জিতলেও মন্দ হয় না তাঁকে অল্প ভোট দেওয়ার কোনও পদ্ধতি এখানে নেই। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, একটা 'প্রেফারেন্স লিস্ট' থাকলে বোধহয় ভালোই হতো। প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে, সর্বসাকুল্যে ৫০%-এর কম ভোট পেয়েও জয়ী হচ্ছেন প্রার্থী। এটি এই 'এফ পি টি পি' পদ্ধতির আরেক সমস্যা। এসবের জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা বরাবর এই পদ্ধতির বিপক্ষে। গণিতজ্ঞরা যদিও মনে করেন, নির্ভুল নির্বাচন পদ্ধতি তৈরি করা একপ্রকার অসম্ভব।
আর কি কোনও উপায় আছে নির্বাচনের? ত্রয়োদশ শতকে র্যা মন লুল নামে এক ধর্মতত্ত্ববিদ, 'দে আর্টে ইলেকশন' নামে একটি বইতে চার্চের আধিকারিক নির্বাচনের জন্য একটা পন্থা বলেন, যেখানে বিজেতা সব সময়ই ৫০% ভোট পাবেন। তবে একটু জটিল হওয়ায়, ছোটখাট কোনও সংস্থার মাথা নির্বাচন করতে এটি ব্যবহার করা হয়, কোনও দেশের গণতন্ত্রের নির্বাচনে এখনও ব্যবহার হয়নি। বহুবছর পর অষ্টাদশ শতকে ফরাসি গণিতজ্ঞ কনডোরেক্ট স্বতন্ত্রভাবে এই নিয়ম বের করেন। সেই থেকে এই নিয়ম ‘কনডোরেক্ট পদ্ধতি' নামে পরিচিত।
এছাড়াও সমসাময়িক সময়ে আর একজন বিখ্যাত ফরাসি গণিতজ্ঞ বর্ডা র্যাঙ্কভিত্তিক একটি নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেন। এটা অনেকটা হালের আইপিএল পয়েন্ট টেবিলের মতো। ব্যালট পেপারে থাকা সমস্ত প্রার্থীদের নামের পাশে ভোটদাতা পছন্দ অনুযায়ী একটা করে ক্রমিক নম্বর বসান। তারপর সেই পছন্দের ভিত্তিতে বিজেতা ঠিক হয়। এই পদ্ধতিতে বিজেতাকে ৫০% ভোট পেতেই হয়। এখানে মূলত ভোটের রিডিস্ট্রিবিউশন হয়। আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এই পদ্ধতি অনুসারে হয়। ভি ভি গিরি যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, প্রথম পছন্দের ভিত্তিতে তিনি ৫০% ভোট পাননি। পরে দ্বিতীয় পছন্দকে গণনায় ধরে তিনি বিজয়ী হন। কনডোরেক্ট পদ্ধতির মতো এটিও বেশ জটিল, সেজন্য সর্বজনীন নির্বাচনে এখনও প্রয়োগ করা হয়নি।
যদিও গণিতজ্ঞরা এই পদ্ধতিতেও খুশি নন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকান গণিতজ্ঞ অ্যারো প্রমাণ করেন যে, এই র্যাঙ্কভিত্তিক নির্বাচনও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অনেক সময়, সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থীও বিজয়ী হতে পারেন না। একটা ছোট্ট গাণিতিক সমস্যার দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়। ধরা যাক, এক সমিতিতে নেতা নির্বাচন হবে। প্রার্থী তিনজন - 'ক', 'খ' এবং 'গ'। মোট ভোটার আছেন ৯ জন। সব ভোটার তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী প্রত্যেক প্রার্থীকে একটা ক্রমিক নম্বর দিতে পারেন। ধরা যাক, বিন্যাসগুলো এইরকম - সমিতির চারজন সদস্য 'গ'-এর চেয়ে 'খ'-কে পছন্দ করেন, এবং 'খ' ও 'গ' এর চেয়ে 'ক'-কে বেশি পছন্দ করেন। গাণিতিকভাবে সাজালে ব্যাপারটা এমন দেখায়-
ক > খ> গ (৪)
অন্য সম্ভাব্য নির্বাচনগুলো এইরকম
খ> গ> ক (৩)
গ>ক>খ (২)
প্রথম সম্ভাব্য নির্বাচন থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সমিতির বেশিরভাগ সদস্যরই 'ক' প্রার্থীকে পছন্দ, আর 'গ'-এর জনপ্রিয়তা সবচাইতে কম। এবার 'খ' যদি তার মনোনয়ন তুলে নেন তখন কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল পুরো ঘুরে যাবে। এবং 'গ' বিজয়ী হবেন।
আরও পড়ুন- ইভিএমের সঙ্গে মেলানো হবে ভিভিপ্যাট স্লিপ? লোকসভা ভোটের মধ্যেই যে বড় সিদ্ধান্ত জানাল সুপ্রিম কোর্ট
আগে যে কনডোরেক্ট পদ্ধতির কথা বললাম, সেক্ষেত্রে ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীদের জোড় হিসাবে বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন, তিনজন প্রার্থীর একটি সম্ভাব্য নির্বাচন 'গ ক খ' হলে এটি নির্দেশ করে, 'গ'-এর জনপ্রিয়তা 'ক'-এর থেকে বেশি, 'ক' আবার 'খ'-এর থেকে জনপ্রিয়, আর 'গ' তো 'ক'-এর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। এই ঘটনাগুলিকে আমরা জোড় ভিত্তিক 'গ ক', 'ক খ', এবং 'গ খ' হিসাবে গণ্য করতে পারি। অন্য ভোটাররা আবার উল্টো জোড় পছন্দ করতে পারেন, অর্থাৎ 'ক গ', 'খ ক', 'খ গ'। অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে ছ'টি সম্ভাব্য জোড় হতে পারে। সমস্ত সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক প্রার্থীকে অপর দু'জনের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেখা যায়, 'ক খ' এর ঝুলিতে ৬ নম্বর, 'গ ক' এর ঝুলিতে ৫ নম্বর। এভাবে দেখতে পাওয়া যায় 'ক' বিজেতা। অ্যারোর উপপাদ্য আমাদেরকে জানায়, র্যাঙ্ক ভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতিতে এরকম অবাঞ্ছিত ফলাফল আসতেই পারে। গণিতের এইরকম জনমুখী প্রয়োগের জন্য অ্যারো ১৯৭২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান।
গুটিকতক ভোটার ও হাতেগোনা কয়েকজন নেতার নির্বাচনের পিছনে থাকা গণিতকে হয়তো হিসেব করা সোজা, সমস্যাগুলোও চোখে পড়ে। অনেক বড় পরিসরে উপরোক্ত সমস্যা কিছুটা প্রশমিত হয়। যেমন, একটা বেলুনের মধ্যে অসংখ্য গ্যাসের অণু বিদ্যমান থাকে, যারা একে অপরের দিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করে, এমনকী একটি অণু আরেকজনের ঘাড়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে, অহরহ অণুগুলি বেলুনের গায়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। গ্যাসের গতীয় তত্ত্ব থেকে জানা যায়, এই ধাক্কাধাক্কি বেলুনের একটা ধ্রুবক চাপ ধরে রাখার জন্য। অর্থাৎ ক্ষুদ্র পরিসরের টালমাটাল অবস্থা থাকলেও বৃহৎ পরিসরে অনেকটা শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে। এটাই পরিসংখ্যান পদার্থবিদ্যার মূলনীতি।