সাদা কাগজে সই করিয়ে ‘মিথ্যে’ ধর্ষণের অভিযোগ! ভয়াবহ সত্য জানান দিচ্ছে সন্দেশখালি

Sandeshkhali Incident: ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা বলে সম্প্রতি যে ভিডিও সামনে এসেছে, তাতে ওই মহিলা জানিয়েছেন, তাঁকে রান্নার কাজের টাকা দেওয়া হয়নি। সেই অভিযোগকেই ধর্ষণের অভিযোগের রূপ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে না জানিয়ে।

সন্দেশখালি ঘটনায় একের পর এক বিস্ফোরক সব তথ্য ভিডিও আসা শুরু হয়েছে। যা কার্যত পাল্টে দিতে চলেছে লোকসভা ভোটের আগে রাজ্যরাজনীতির মতিগতি। আগামী ১ জুন বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে লোকসভা ভোট। চলতি ভোটে শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল সন্দেশখালি। তবে সন্দেশখালির ভোট আসতে আসতে সেই সব হিসেব নিকেশ যেন ক্রমশ পাল্টে যেতে বসেছে। সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে সেখানকার মহিলাদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। তার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছিলেন সেখানকার মেয়েরা। তবে সেই আন্দোলনের অনেকটাই নাকি সাজিয়ে তোলা। সম্প্রতি একের পর এক স্টিং অপারেশনে সামনে আসতে শুরু করেছে সেই তথ্য। কখনও সামনে আসছে সন্দেশখালি বিজেপির মণ্ডল সভাপতির বক্তব্য, তো কখনও খোদ বিজেপি প্রার্থী সন্দেশখালির প্রতিবাদী মুখ রেখা পাত্র বলছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানাতে যাওয়া নির্যাতিতারা ভুয়ো। সব মিলিয়ে সন্দেশখালিতে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে, সবটাই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আবার সন্দেশখালিতে ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করে বসলেন সেখানকার এক অভিযোগকারিনী।

সম্প্রতি সামনে এসেছে সন্দেশখালি সংক্রান্ত আরও একটি ভিডিও। যেখানে এক মহিলা দাবি করেছেন, তাঁকে দিয়ে জোর করে ধর্ষণের অভিযোগ লেখানো হয়েছিল সে সময়ে। সেই ভিডিওটিরও অবশ্য সত্যতা যাচাই করা যায়নি। ভিডিওয় মহিলা দাবি করেছিলেন, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল থানায়। এমনকী না জানিয়ে সাদা কাগজে সই পর্যন্ত করানো হয়। যা তিনি জানতে পারেন এক সপ্তাহ পরে। সেসময় তিনি যখন মামলাটি তুলতে চান, তখন তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলেও নালিশ মহিলার।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রপতির কাছে সন্দেশখালির ‘নকল’ নির্যাতিতা, স্বীকারোক্তি খোদ রেখা পাত্রের!

লোকসভা ভোট যত এগোচ্ছে, ততই যেন এক এক করে পর্দা উঠছে সন্দেশখালি মামলা থেকে। সামনে আসছে একের পর এক স্টিং অপারেশনের ভিডিও। যা রাজ্য-রাজনীতিকে তোলপার করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিছুদিন আগেই সন্দেশখালি বিজেপির মণ্ডল সভাপতি গঙ্গাধর কয়ালের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, সন্দেশখালিতে টাকার বিনিময়ে ধর্ষণের ‘মিথ্যে’ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। বসিরহাট আসনে বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্রও দু’হাজার টাকার বিনিময়ে ধর্ষণের ‘মিথ্যে’ অভিযোগ দায়ের করেছিলেন বলেও দাবি করেন ওই বিজেপি নেতা। বিজেপি অবশ্য সে সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছিল ওই ভিডিও বিকৃত ও সাজানো। তবে তার রেশ কাটতে না কাটতেই একই দাবি করে বসলেন সন্দেশকারীর এক মহিলা। যিনি সাফ জানালেন ভিডিওয়, তিনি যে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, সে কথা মিথ্যে। এবং তাঁকে দিয়ে থানায় মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। যার নেপথ্যে ছিলেন সন্দেশখালির প্রতিবাদী মুখ মাম্পি দাস ও পিয়ালী দাস।

সন্দেশখালি মামলা নিয়ে তোলপাড় শুরু হতেই লোকসভা ভোটে তাকেই অস্ত্র বানিয়েছিল বিজেপি। তারা বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছিল সন্দেশখালির প্রতিবাদী মুখ রেখা পাত্রকে। সেই রেখাকে দিয়ে এতদিন জোর প্রচারও চালিয়েছে বিজেপি। তবে ভোটের মুখে সেই তুরুপের তাসই যেন ব্যাকফায়ার করা শুরু করেছে বিজেপির জন্য। ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে রেখা পাত্রের অন্য একটি ভিডিও। যেখানে রেখার সঙ্গে দেখা গিয়েছে মাম্পিকেও। সেখানে তাদের আলোচনা করতে শোনা গিয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে নালিশ নিয়ে যাওয়া নির্যাতিতাদের নিয়ে। তাঁদের কথায়, তাঁরা নাকি সকলেই সাজানো। বিজেপি ঘনিষ্ঠ অনুপ দাসই নাকি তাঁদের সাজিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে যে আবার নাকি শাহজাহান-সঙ্গী শিবুরও ঘনিষ্ঠ। তার থেকে মাসে মাসে টাকা নিত অনুপ, এমন দাবিও করেছেন রেখারা। প্রশ্ন উঠে গিয়েছে রাষ্ট্রপতির দরবারে যাওয়া নির্যাতিতাদের পরিচয় নিয়েও। সেই ভিডিওরও সত্যতা সম্পর্কে অবশ্য নিঃসন্দেহ হওয়ার জায়গা নেই।


ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা বলে সম্প্রতি যে ভিডিও সামনে এসেছে, তাতে ওই মহিলা জানিয়েছেন, তাঁকে রান্নার কাজের টাকা দেওয়া হয়নি। সেই অভিযোগকেই ধর্ষণের অভিযোগের রূপ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে না জানিয়ে। মহিলার দাবি, ‘‘আমি বাড়িতে ছিলাম না। আমার শাশুড়িকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল মাম্পি দাস আর পিয়ালি দাস। দিল্লি থেকে মহিলা কমিশন এসেছে বলে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। থানায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেট ফেলে দিয়েছিল। উনি আর বেরোতে পারেননি। অভিযোগ কী জানতে চেয়েছিল, উনি জানিয়েছিলেন যে রান্নার কাজের টাকা পাইনি। এর পর সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিল। এর পর ওখান থেকে চলে যেতে বলেছিল। আমি বাড়ি ফিরে পিয়ালিকে ফোন করে জানতে চেয়েছি। পিয়ালি আমায় বলেছে, ও কোনও ব্যাপার নয়। অভিযোগ ছিল, তাই সই করিয়েছি। তোমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। এক সপ্তাহ পরে জানতে পারলাম, তিন-চার জনকে দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করানো হয়েছে। অভিযোগ ছিল, রাতে আমাদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে।’’ মহিলার দাবি, তিনি ও তাঁর শাশুড়ি পুলিশের কাছে গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানেও তাঁরা জানিয়েছেন যে, ধর্ষণের মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল। মহিলা জানান, তাঁরা ওই মিথ্যে মামলা তুলে নিতে চান। মহিলার কথায়, ‘‘যা ঘটেনি, সে সব নিয়ে কেন মামলা লড়ব? আমাদের অত ক্ষমতা নেই। আমরা এ সব ঝামেলার মধ্যে জড়াতে চাই না।’’ মহিলার দাবি, তিনি পিয়ালির কাছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে অপমান, হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁর কথায়, ‘‘পিয়ালিকেও বলতে গিয়েছিলাম যে আমরা এই মামলা তুলে নিতে চাই। কিন্তু আমাদের অপমান করে দিল। বলল, ‘তোমাদের দ্বারা কিছু হবে না। তোমরা অসভ্য, ছোটলোক!’’ মহিলার আরও অভিযোগ, এ সব কারণে পাড়ায় তাঁরা একঘরে হয়ে গিয়েছেন।

আরও পড়ুন: সন্দেশখালিতে সরব! কেন যৌনহেনস্থায় অভিযুক্ত রেভান্নার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিজেপি?

ওই মহিলার সমস্ত অভিযোগই অবশ্য উড়িয়েছেন পিয়ালি দাস। তাঁর বক্তব্য, এ সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে। তিনি বলেন, ‘‘রেখা পাত্রের সঙ্গে থানায় গিয়ে উনি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। পরে হয়তো পারিপার্শ্বিক চাপে উনি মামলা তুলে নিতে চান। তুলেও নেন। সাদা কাগজে সই করানোর যে কথা হচ্ছে, তা মিথ্যে। থানায় তো সিসিটিভি আছে। সেটা দেখা হোক। শাসকদলের লোকেরা টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে মহিলাদের দিয়ে এ সব বলিয়ে ভিডিয়ো ভাইরাল করছে। এ সবের কোনও সত্যতা নেই। তদন্ত হোক। যদি দোষী প্রমাণিত হই, তা হলে আইন যা শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেব। আর যদি তা না হয়, তা হলে কিন্তু আমি এদের নামে মানহানির মামলা করব।’’ পিয়ালির সঙ্গী মাম্পি অবশ্য এ নিয়ে এখনও মুখ খোলেননি।

সন্দেশখালি সংক্রান্ত সাম্প্রতিক একের পর এক ঘটনা এবার বিজেপির বিরুদ্ধে যেতে শুরু করেছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে এতদিন যা ছিল বিরোধীদের ঘুঁটি, সে সব যেন বেকায়দায় ফেলতে শুরু করেছে এখন বিজেপিকেই। বিজেপির মণ্ডল সভাপতি দাবি করেছেন, সন্দেশখালি সংক্রান্ত সমস্ত চক্রান্ত ছিল বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর মস্তিষ্ক প্রসূত। যদিও সেই দাবি উড়িয়ে ভিডিওগুলিকে ডিপ ফেক বলে দাবি করেছেন তিনি। একের পর এক ভিডিও যে বিজেপিকে ভালোই অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা শুভেন্দুবাবুর ব্যবহারেই স্পষ্ট। কখনও তিনি মেজাজ হারাচ্ছেন, আবার কখনও মুখ খারাপ করে ফেলছেন। আসন্ন লোকসভার ভোটের শেষ দফায় এই সন্দেশখালি কাণ্ডের প্রভাব কি হাড়ে হাড়ে বুঝতে চলেছে বিজেপি। পাশাপাশি তৃণমূলের সামনেও হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের বিরাট সুযোগ এসে ধরা দিয়েছে। এই সব ভিডিও আসলে কতটা ছাপ ফেলতে চলেছে লোকসভা ভোটের ফলাফলে, তার উত্তরও মিলবে শীঘ্রই।

More Articles