ভারতে ফুলকপির বয়স দুশো! যে ভাবে সাগর পেরিয়ে এল বাঙালির প্রিয় শীতের সবজি

History of Cauliflower : ফুলকপি এ দেশে এসেছিল আজ থেকে ঠিক ২০০ বছর আগে। ১৮২২ সালে ভারতে প্রথম আগমন ঘটে ফুলকপির।

শীত আসতে বাকি আর মাত্র কয়েকমাস। শীত মানেই যেমন গরমের হাসফাঁস থেকে মুক্তি, তেমনই আবার শীত মানেই বাজারে নানান রঙের শাকসবজির মেলা আর ফুলকপি-বাঁধাকপি ছাড়া কিন্তু শীতকালের কথা ভাবাই যায় না। ফুলকপির বড়া, ফুলকপির ঝোল, ফুলকপি ভাজা ছাড়াও মাছের ঝোলে কিম্বা সবজি ডালে ফুলকপি থাকবেই থাকবে। এখন তো আবার মুরগির মাংসকেও রীতিমত টেক্কা দিচ্ছে শীতের এই ফসল। শাকাহারীদের কথা ভেবে বড় বড় রেস্তোরাগুলি মাংসের পরিবর্তে দিব্যি ফুলকপি দিয়েই বানিয়ে ফেলেছে দুর্দান্ত সব চাইনিজ আইটেমগুলো যা খেতেও সুস্বাদু আবার দামেও কম। শীতকালে যে সবজি ছাড়া বাঙালিদের দিন চলে না, এই ফুলকপির আখ্যান, মানে জন্মবৃত্তান্ত জানেন?

ফুলকপি এ দেশে এসেছিল আজ থেকে ঠিক ২০০ বছর আগে। ১৮২২ সালে ভারতে প্রথম আগমন ঘটে ফুলকপির। ভারতের টমেটো, আলু, লংকার মত সবজির আগমন একসময় পর্তুগিজ জাহাজ থেকে হলেও, ফুলকপির আগমন কিন্তু হয়েছিল ইংরেজদের হাত ধরে। আমাদের দেশে তখন রমরমিয়ে চলছে ইংরেজ শাসন। সেই সময় নিয়ে যতই রাগে ফুসে উঠি না কেন একটা কথা ঠিক ইংরেজ না থাকলে, আমরা ফুলকপি অতো সহজে কখনই পেতাম না।

ভূগোল বইয়ে আমরা সকলেই পড়ে এসেছি, ভারতবর্ষ নদীমাতৃক দেশ, তাই প্রাচীন কাল থেকেই এই দেশে বিভিন্ন ধরনের ফসলের উৎপাদন ছিল পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশের তুলনায় অনেকখানি বেশি। ঠিক তেমনভাবেই, ইংল্যান্ডের কিউ এলাকা ছিল চাষাবাদ, বাগান এবং উদ্যানের জন্য বিখ্যাত। ইংল্যান্ডের কিউ অঞ্চলের একজন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ ডক্টর জেমসন ব্রিটিশ শাসনকালে ইউনাইটেড প্রভিন্স-এর (যা বর্তমানের উত্তরপ্রদেশ) অন্তর্গত সাহারানপুরে কোম্পানির বাগানের দায়িত্বে ছিলেন এবং
পরবর্তীতে এই সাহেব উদ্ভিদবিদের হাত ধরেই ভারতের মাটিতে পা রাখে আজকের শীতকালের অন্যতম প্রিয় সবজি ফুলকপি। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন ফুলকপি ভারতে পা রাখেনি, তখন ব্রিটিশ লেখক, কৃষিবিদ কিম্বা উদ্ভিদবিদদের ফুলকপি নিয়ে মাতামাতির শেষ ছিল না, এই সবজির প্রশংসায় তারা তখন সর্বদাই পঞ্চমুখ। ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ জর্জ মার্শাল উইরো ফুলকপি চাষের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ফুলকপি খুবই নরম প্রকৃতির গাছ হওয়ায় এই চাষে অত্যন্ত যত্নের প্রয়োজন।

কিন্তু ভারতের মাটিতে ফুলকপি আসতেই তাদের ধারণা গেল পাল্টে। দেখা গেল ভারতের ফুরফুরে দোঁয়াশ মাটি, দাক্ষিণাত্যের কালো মাটি, গঙ্গা এবং নর্মদা এলাকার বেলেমাটিতে ফুলকপির ফলন হচ্ছে দেখবার মত, ইংল্যান্ডের তুলনায় এই দেশের মাটিতে ফুলকপির চাষ অনেক সহজতর হল এবং গাছগুলির পরিচর্যাতেও বিশেষ পরিশ্রমের প্রয়োজন হল না।

অনেকের মতে ফুলকপির আগমন হয়েছিল ২৩০০ বছর আগে। অনেকে এও বলে থাকেন, এই ফুলকপির জন্ম হয়েছিল ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলিতে। সেখান থেকেই পরবর্তী সময়ে ফুলকপির চাষ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ওটামন সাম্রাজ্য ইস্তামবুলে ফুলকপির কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই মনে করা হয়, এশিয়া থেকেই ফুলকপি পা রেখেছিল ইউরোপের মাটিতে। সপ্তাদশ শতাব্দীতে, ফরাসি অভিজাতদের টেবিলে ফুলকপি স্থান পেত, এমনকি ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের খাবার তালিকাতেও দেখা মিলেছে এই ফুলকপির। এরপরেই ইংরেজদের হাত ধরে তা ভারতের মাটিতে পা
রাখে আজ থেকে ২০০ বছর আগে।

ভারতের ফুলকপি

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ফুলকপি আমাদের দেশের বাজারে আসতে শুরু করে। মূলত শহর এবং শহরের আশেপাশের কিছু অঞ্চলেই তখন দেখা মিলত এই সবজির। ইংরেজরা আবার বলেছেন, ভারতের মাটিতে ফলা ফুলকপিগুলি স্বাদে এবং গন্ধে সাহেবদের দেশের তুলনায় ছিল খানিক নিম্নমানের। এই শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকেই ভারতীয় রান্নার বিভিন্ন বইগুলিতেই স্থান করে নেয় ফুলকপি। চিজ কিম্বা ফরাসি সব সস দিয়ে ফুলকপির রোস্ট থেকে শুরু করে ভাজা-পোড়া কিম্বা মাছের ঝোলে
সবেতেই ফুলকপির কত-শত বাহার।

বাঙালির জীবনে ফুলকপি

এই শতাব্দীর পরে আবার থেকে বাঙালি রান্নার বইগুলিতেও চোখে পড়ে ফুলকপির কথা। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পাক প্রণালী’
বইতে ফুলকপিকে ঘি’য়ে ভেজে, উপরে খানিক মাখন লাগিয়ে, লবঙ্গগুড়ো এবং নুন সহযোগে পরিবেশন করার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়াও বাঙালির প্রায় সমস্ত ঘরেই দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ফুলকপির জায়গা ছিল বলেও জানা যায়। সেকালের ঠাকুরপরিবারেও ফুলকপির বিভিন্ন রান্নার চল ছিল এবং তা ছিল বেশ উচ্চমাত্রাতেই। ডিম দিয়ে ফুলকপির ঝোল কিম্বা ফুলকপির ধোকা – এই সবকিছুর পাশাপাশি ফুলকপির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত প্রেমের বশেই, প্রাজ্ঞসুন্দরী দেবী নাকি তাঁর ৫০তম জন্মদিনে তা দিয়ে মিষ্টি তৈরি করে ফেলেছিলেন।

ফুলকপি নিয়ে ধর্মীয় বিতর্ক

ভিনধর্মীদের হাত ধরে ভারতের মাটিতে পা রাখায় এবং সর্বপোরি তা ইংরেজদের খাদ্য হওয়ায়, আধিকাংশ হিন্দু পরিবারের ঠাকুরের ভোগে ফুলকপির স্থান হত না। সময় অনেক এগিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মন্দিরগুলিতে ঠাকুরের কাছে নিবেদিত কোন ভোগেই ফুলকপি ব্যবহার করে না।

ফুলকপির রমরমা

মানুষের চাহিদার কারণেই ফুলকপির চাষ আর কেবলমাত্র শীতকালেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বছরই  সস্তা দামেই বাজারের সব দোকানে এখন দেখা মেলে তার। তবে কিছু কিছু মানুষ কিন্তু আজও এই ফসলকে শীতকালীন ফসল হিসাবে বিবেচিত করে তা সেই সময়ে খাওয়ার মধ্যেই বিষয়টিকে সীমিত রেখেছেন। সে যাই হোক, ফুলকপির জন্ম যেখানেই হয়ে থাকুক, ইংরেজদের অগুনতি খারাপ জন্য তাদের নিন্দা করলেও এই একটা বিষয়ে কিন্তু তারা প্রশংসার দাবি রাখে।

More Articles