চন্দননগরে বামেদের জয় বঙ্গের রাজনীতিতে নতুন মোড়? যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে

চন্দননগর পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটের ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) গত কয়েক মাস ধরে প্রচার কৌশলে যে অভিনবত্ব এবং আন্তরিকতা এনেছে, সেটি কিন্তু তাঁদের এই অসাধ্য সাধনের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি।


চন্দননগর পৌর নিগমের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট নির্ধারিত সময়ে হতে পারেনি এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে। সম্প্রতি সেই ভোট হয়েছে এবং সেখানে বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী অশোক গঙ্গোপাধ্যায় জিতেছেন। চন্দননগর পৌর নিগমের এই ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআই(এম) প্রার্থীর জেতাটা সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী সংগ্রামের ইতিহাসে কোনও মামুলি ব্যাপার হিসেবে দেখাটা ঠিক নয়। মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতিনিধিত্বে ভরা চন্দননগর পৌর নিগমের এই ১৭ নম্বর ওয়ার্ডটিতে সিপিআই (এম) শেষ জিতেছিল ১৯৮৬ সালে। সেই সময় দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে ক্ষমতাসীন। তারপর প্রায় দীর্ঘ ৩০ বছর ওই ওয়ার্ডে কোনও বাম প্রার্থী জেতেননি। অথচ বামফ্রন্টের শাসনকালে, চন্দননগর পৌর বোর্ডের শাসনভার বামফ্রন্টেরই হাতে ছিল।

আজ যখন রাজ্য বিধানসভায় বামফ্রন্টের একজনও প্রতিনিধি নেই, এই রাজ্য থেকে লোকসভায় বামফ্রন্টের একজন প্রতিনিধি নেই, একমাত্র নদিয়া জেলার তাহেরপুর পৌরসভা বামফ্রন্টের দখলে আছে, তখন নির্ধারিত দিনের পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়েছে, সেখানে সিপিআই (এম) প্রার্থীর জেতাটা গুরুত্বপূর্ণ বটে।

এই গোটা কার্যক্রমের বিশ্লেষণে প্রবেশের আগে করোনাকালের পূর্ববর্তী সময়ের একটি ঘটনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই। চন্দননগরের রবীন্দ্রভবনে গান গাইতে আসবেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী অদিতি মহসিন। আয়োজক সংস্থার কার্যালয়টি ঠিকভাবে চিনি না। ঘটনাচক্রে যেদিন ওই অনুষ্ঠানের টিকিটটি কাটতে গিয়েছি, সেইদিন দেখা হয়ে যায় চন্দননগরের বাম আমলের এক মেয়রের পত্নীর সঙ্গে। তিনি আমাকে অদিতি মহসিনের গানের অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কার্যালয়টি চিনিয়ে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে ওই আয়োজকদের একজন আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, আপনি ওই ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে করে কেন এসেছিলেন আমাদের আমাদের কার্যালয়ে টিকিট কাটতে? তাঁকে বলি, আপনাদের কার্যালয়টি আমি চিনতাম না। উনি আমাকে চিনিয়ে নিয়ে এলেন। সেই ব্যক্তিটি বলেন, আসলে আমরা আগে যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম, তখন পৌরনিগমের মেয়র যেহেতু ওঁর অতি নিকট জন, সেই কারণে উনি ফোন করে অনুষ্ঠানের সবথেকে দামি টিকিট রেখে দিতে বলতেন আমাদের কাছে। সেই টিকিটে ওঁরা দলবল বেঁধে অনুষ্ঠান দেখতেন। বলা বাহুল্য, কোনওদিন একটি টিকিটেরও দাম তাঁদের কাছ থেকে পাইনি।

আরও পড়ুন: সাদা কাপড়ে এক ছিটে কালি, কেন ঝালদায় গো-হারা হারতে হল তৃণমূলকে?

এই ঘটনাটি এই কারণে উল্লেখ করলাম যে, বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন একটা পর্যায়ে এসে একটা অংশের স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা বা তাঁদের আত্মীয়-পরিজনদের কৃতকর্ম সাধারণ মানুষকে বামফ্রন্টের রাজনৈতিক কর্মসূচির সুফল থেকে বিচ্যুত করে একটা ছোট অংশের অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এমন একটা বিরক্তির জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল, যার ফল বামফ্রন্টকে নির্বাচনী সংগ্রামের ক্ষেত্রে আজও অনেকখানি দিয়ে চলতে হচ্ছে।

চন্দননগর পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটের ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) গত কয়েক মাস ধরে প্রচার কৌশলে যে অভিনবত্ব এবং আন্তরিকতা এনেছে, সেটি কিন্তু তাঁদের এই অসাধ্য সাধনের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। নির্ধারিত দিনে ওই ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভোট হতে না পারার কারণে জনসংযোগ থেকে যে সিপিআই(এম) ওই এলাকায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল, তা কিন্তু নয়। নির্ধারিত দিন থেকে পরবর্তীকালে যেদিন ভোট হলো, ভোট থাকুক আর না থাকুক, প্রায় প্রতিটি ভোটারদের সঙ্গে সাধারণ কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে নেতৃত্ব যে নিবিড় জনসংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিল, তাতে সাধারণ মানুষের এই ধারণা এবং প্রত্যয় জন্মেছে যে, আজকের সিপিএমে স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে জেলা স্তর হয়ে, রাজ্য স্তর পর্যন্ত যে নবীন প্রজন্মের, বাস্তববোধ-সম্পন্ন, সংকীর্ণতাবোধের ঊর্ধ্বে ওঠা ব্যক্তিগণ নেতৃত্বে আছেন, তাঁরা এই নিবন্ধের শুরুতে যে প্রাক্তন মেয়রদের আত্মীয়-পরিজনের কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করা হলো, তাঁদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।

রাজনৈতিক স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে, রাজনীতি এবং ক্ষমতাকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার সোপান হিসেবে আজকের প্রজন্মের সিপিআই(এম)-এর সর্বস্তরের নেতৃত্ব যে পরিচালিত হবে না- এই বোধ, এই প্রত্যয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে কিন্তু চন্দননগর পৌর নিগমের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষ, তার মধ্যে যেমন বামপন্থী সমর্থকরা আছেন, তেমন দক্ষিণপন্থী সমর্থকরাও আছেন, তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের সঠিক দিকনির্দেশে, নিজেদের ওয়ার্ডে বামপন্থী প্রার্থীর প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন।

কোনও পৌর নিগমের একটি ওয়ার্ডে বামপন্থীরা জেতার নিরিখে যেমন এককথায় বলতে পারা যায় না, নির্বাচনী সংগ্রামের ক্ষেত্রে বামপন্থীরা খরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, তেমনই একথাও বলতে পারা যায় না যে, সাধারণ নির্বাচনে রাষ্ট্রশক্তি শাসককে জেতানোর ক্ষেত্রে যতখানি তৎপর থাকে, উপনির্বাচন বা কোনও টেকনিক্যাল কারণে পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়, সেখানে তার থেকে শতগুণ বেশি তৎপরতা দেখা যায় না।

বামফ্রন্টের সময়কালে যে কোনও উপনির্বাচনে শাসক বামফ্রন্টকে পরাজিত করে বিরোধী শিবিরের জেতার ঘটনা কোনও অভিনব ব্যাপার ছিল না। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বেলগাছিয়া পূর্ব কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সেই সময়ের দোদণ্ডপ্রতাপ বাম প্রার্থীকে হারিয়ে কংগ্রেসের অমর ভট্টাচার্য জিতেছিলেন। এমন উদাহরণ লোকসভার উপনির্বাচনের ক্ষেত্রেও আছে।গীতা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর সাবেক পাঁশকুড়া আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্রম সরকারের জেতার ঘটনা এই প্রসঙ্গে বলতে হয়। পৌরসভা, পঞ্চায়েত সমস্ত জায়গাতেই বামফ্রন্টের আমলে বিরোধীদের উপনির্বাচনে জেতার উদাহরণ আছে।

তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কি সাধারণ নির্বাচন, কি পৌর নির্বাচন, কি পরবর্তী কোনওরকম উপনির্বাচনে শাসক শিবির ব্যতীত কোনও অংশের বিরোধী শিবির জিতেছে, তেমন কোনও দৃষ্টান্ত নেই। তার মানে এই নয় যে, চন্দননগর পৌর নিগমের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে শাসক শিবির নিজেদের শাসনযন্ত্রকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করেনি। এই সমস্তকিছুকে অতিক্রম করে সাধারণ মানুষ যে বামফ্রন্টের প্রার্থী অশোক গঙ্গোপাধ্যায়কে চন্দননগর পৌর নিগমের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে জিতিয়েছে, সেই সাফল্যের পিছনে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় জেলা নেতৃত্বর কথা। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সমস্ত রকমের সংকীর্ণতাকে কাটিয়ে নির্বাচনী সংগ্রামে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) দলের হুগলি জেলার বর্তমান নেতৃত্ব, বিশেষত তাঁদের নতুন সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ যে কৃতিত্ব রেখেছেন, তা নির্বাচনী রাজনীতির ক্ষেত্রে এই নতুন ইতিহাস রচনায় একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

দীর্ঘদিন ধরে হুগলি জেলায় সিপিআই(এম) দলটি গোষ্ঠীরাজনীতির দীর্ণতায় তাঁদের রাজনৈতিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের থেকে বিপক্ষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেই বেশি সময় খরচ করেছে। অনিল বসু এবং রূপচাঁদ পালের দ্বন্দ্ব এক সময়ের বাম আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হুগলি জেলা থেকে ধীরে ধীরে নির্বাচনী রাজনীতিতে বামপন্থীদের কোণঠাসা করেছে। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, কেবলমাত্র আরামবাগ মহকুমায় নয়, গোটা হুগলি জেলায় সাধারণ মানুষের সিপিআই(এম) সম্পর্কে একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিল বসুর গোষ্ঠীতন্ত্রের দাপট বিশেষভাবে দায়ী।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। নয়ের দশকের প্রথম দিকের সময়কাল। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ তখনও ধ্বংস করেনি হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবির। তবে সামাজিক বিভাজনের সবরকমের চেষ্টা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির চালাচ্ছে। এইরকম এক সময় আরামবাগ মহকুমার হরিণখোলা থানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুন্ডেশ্বরী নদীর বালিখাদ ঘিরে অনিল বসুর আশ্রিত একটা বড় অংশের সঙ্গে স্থানীয় সিপিআই নেতৃত্বের জোরদার সংঘাত বাঁধে। বলা বাহুল্য, এই অনিল বসুর গোষ্ঠীর লোকজনরা তখন সিপিআই(এম) দলের ভেতরে থেকেই ওই দলটির সাড়ে সর্ব্বনাশ ঘটাচ্ছিল।

জয়নাল খান নামক অনিল বসুর ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি, অনিলের দৌলতেই যে সিপিআই(এম)-এর স্থানীয় নেতা, যাঁকে ঘিরে বেআইনি বালি তোলার অভিযোগ ছিল, তিনি গিয়ে জড়ো হন সিপিআই শিবিরে। গোটা ঘটনাটির কারণ অনুসন্ধান করতে তখন হরিণখোলা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন সিপিআই-এর সংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়। হরিণখোলার ভূঁইয়ারা গ্রামে তিনি একটি জনসভাও করেছিলেন। এরপর হরিণখোলা থানায় তৎকালীন এসডিপিও-র সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয়া সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুলিশের একজন জেলা স্তরের অফিসার যেভাবে গলা তুলে উচ্চগ্রামে তুলে কথাবার্তা বলেছিলেন, তা মনে করলেও শিউরে উঠতে হয়।বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীকালে আরও জল ঘোলা হয়। দিমিত্রভ পড়া, না-পড়া নিয়ে স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে এই পর্যায়ে গীতা মুখোপাধ্যায়ের বিতর্ক খবরের কাগজের পাতার শিরোনাম দখল করেছিল।

তখন আরামবাগের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সিপিআই(এম)-এর নাম করে অনিল বসুর ঘনিষ্ঠ লোকজনদের যে কর্মকাণ্ড, তা কেবলমাত্র আরামবাগ মহকুমাতেই সিপিআই(এম)-কে বা বামপন্থীদের, সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, রাজ্যজুড়ে করেছিল। যার ফলশ্রুতি আমরা দেখতে পেয়েছিলাম ২০১১ সালের ভোটবাক্সে।

More Articles