রাজনীতিতে কৌশলী বুদ্ধির গুরু তিনিই! আসলে কেমন ছিলেন চাণক্য

Chanakya: চাণক্য এবং চন্দ্রগুপ্তর কাহিনির যে সংস্করণ সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত, সেই গল্প বিশাখদত্তের লেখা 'মুদ্রারাক্ষস'-এ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শুনেছিলেন যে, রাজা ব্রাহ্মণদের কিছু দান করবেন। সেই প্রচার শুনে অন্যান্য ব্রাহ্মণদের মতো তিনি রাজসভায় গিয়েছিলেন। কিন্তু দানের বদলে জুটেছিল অপমান। কথিত আছে যে, ব্রাহ্মণের একটি পা বাঁকা ছিল। রাজার চোখে সেই ব্রাহ্মণকে কুৎসিত দেখতে লেগেছিল। তাই তিনি ব্রাহ্মণের সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিলেন। যখন ব্রাহ্মণ সেই অপমানের বিরোধিতা করেন, তখন রাজা তাঁকে বন্দি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কোনও মতে গ্রেফতারি এড়িয়ে ব্রাহ্মণ সভা থেকে পালিয়ে যান, কিন্তু তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

লোকালয় থেকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে ব্রাহ্মণ এক আশ্চর্য বালকের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেই বালক তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিল। খেলায় সে রাজা সেজেছিল। খেলার ছলে তাকে ডাকাতের বিচার করতে বলায় সে প্রথমে ডাকাতদের অঙ্গচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিল। অঙ্গচ্ছেদের পরে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হওয়ার কারণে সে জাদুবলে পুনরায় তাদের অঙ্গ ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ বুঝতে পারেন, এই বালক তার রাজা হওয়ার উপযুক্ত। তাই বালকের মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন সেই বালককে বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। তারপর সেই বালক যখন তরুণ হলো, তখন তাকে সেই অহংকারী রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পরামর্শ দিলেন ব্রাহ্মণ। প্রথম যুদ্ধের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয়বারের আক্রমণে তাঁরা রাজাকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন। বৌদ্ধ গল্পকথা এবং নথি অনুসারে সেই অহংকারী রাজা ছিলেন নন্দবংশের রাজা ধনানন্দ। সেই ব্রাহ্মণ ছিলেন চাণক্য এবং সেই আশ্চর্য বালক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

আরও পড়ুন: মাটির নীচে লুকিয়ে একখণ্ড বৌদ্ধ ইতিহাস! নানা কাহিনিতে মোড়া এই বাংলার ‘মোগলমাড়ি’

জৈন কি‌ংবদন্তি
ধনানন্দর চাণক্যকে অপমান, চাণক্যের চন্দ্রগুপ্তকে খুঁজে পাওয়া এবং পরবর্তীকালে ধনানন্দের পরাজয় সংক্রান্ত বিভিন্ন কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শেষ জীবনে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। জৈনদের বিভিন্ন গল্পকথা এবং নথি অনুযায়ী, চাণক্য ধনানন্দর কাছে দান- গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। সভায় উপস্থিত হয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে তিনি রাজসিংহাসনেই বসে পড়েন। কিছু সময় পরে সেই জায়গা থেকে তাঁকে অন্যত্র বসতে অনুরোধ করা হয়, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তাঁকে তখন রাজসভা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি এই সময়ে একটি ভবিষ্যৎবাণী জানতেন। সেই ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী এক নতুন রাজার আক্রমণের ফলে এই বংশের পতন ঘটবে। সভা থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময়ে চাণক্য নিজের অপমানের বদলা নেবেন বলেই ঠিক করেছিলেন। সভা থেকে বেরিয়ে লোকালয় এবং জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে তিনি একজন সন্তানসম্ভবা মহিলাকে সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই মহিলার সন্তানের খেলার ছলে রাজা হয়ে বিচার করার পদ্ধতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই সন্তান চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

যুদ্ধশিক্ষায় চন্দ্রগুপ্ত
চন্দ্রগুপ্তকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করে তাঁকে রাজধানী আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেও চন্দ্রগুপ্ত প্রথমবারে সফল হতে পারেননি। প্রথমবারের পরাজয়ের পরে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে তাঁরা একটি ঘটনা দেখতে পেয়েছিলেন। একটি বাচ্চা গরম পায়েস খেতে গিয়ে ছ্যাঁকা খেয়েছিল। তখন তার মা বলেছিলেন, চন্দ্রগুপ্তের মতো প্রথমেই ভেতরে গেলে বিপদ হবে। পাত্রের ধারের পায়েস তুলনামূলক ঠান্ডা থাকে। প্রথমে সেই পায়েস খেতে হয়। এই কথা শুনে তাঁরা দ্বিতীয়বার আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথমেই রাজধানী আক্রমণ না করে আশেপাশের গ্রাম এবং লোকালয় দখল করেছিলেন এবং শেষে রাজধানী আক্রমণ করেছিলেন। দ্বিতীয়বারের আক্রমণে চন্দ্রগুপ্ত সফল হয়েছিলেন।

মুদ্রারাক্ষস
চাণক্য এবং চন্দ্রগুপ্তর কাহিনির যে সংস্করণ সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত, সেই গল্প বিশাখদত্তের লেখা 'মুদ্রারাক্ষস'-এ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গল্প অনুযায়ী চাণক্য ধনানন্দর রাজসভায় সভাসদ ছিলেন। নন্দবংশের অহংকারী রাজা ধনানন্দ চাণক্যকে অপমান করেছিলেন। চাণক্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি ধনানন্দের মতো অনুপযুক্ত রাজাকে মগধের সিংহাসন থেকে উৎখাত করে তার অপমানের বদলা নেবেন। রাজসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেরোনোর সময় চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি চন্দ্রগুপ্তকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে উপযুক্ত ব্যক্তি বলেই মনে করেছিলেন। দীর্ঘদিন চন্দ্রগুপ্তকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করে এবং সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা নির্দিষ্ট করেই তাঁরা রাজধানী আক্রমণ করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেই যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন ও সিংহাসনে বসেছিলেন। চাণক্য নিজের প্রতি করা অপমানের বদলা নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জীবসিদ্ধি
বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের কাছে এই গল্পের সমাপ্তি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর সিংহাসন আরোহণের সঙ্গেই হয়। যদিও সিংহাসন আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সব সমস্যার সমাধান মোটেই হয়নি। রাজা হওয়ার আগে এবং পরে বহুবার চাণক্যের বুদ্ধিবলেই তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। 'মুদ্রারাক্ষস'-এ চন্দ্রগুপ্ত রাজা হওয়ার পরের বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনার কথা জানতে পারা যায়। যদিও এই ঘটনার কোথাও কোথাও বাস্তব এবং কল্পনা মিশে গিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ঘটনা অবাস্তব বলে মনে হয় না। এই বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনার মধ্যে 'জীবসিদ্ধি' নামে একটি চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়।

জীবসিদ্ধির আসল নাম সম্ভবত ছিল ইন্দুশর্মা। তিনি চাণক্য-র অত্যন্ত বিশ্বস্ত একজন শিষ্য ছিলেন। চাণক্যের নির্দেশে তিনি গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর শত্রুপক্ষের তাঁকে হত্যা করার বিভিন্ন পরিকল্পনা জানতেই জীবসিদ্ধি শত্রুপক্ষের দলে যোগদান করেছিলেন। চাণক‍্যর রচিত অর্থশাস্ত্র, বিশাখদত্তর মুদ্রারাক্ষস এবং অন্যান্য বিভিন্ন নথিতে সেই সময়ের গুপ্তচর, তাদের বিভিন্ন বেশ এবং গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কে জানা যায়। সেই সময়ের গুপ্তচরদের জন্য একটি উপযুক্ত বেশ হিসেবে জৈন অথবা বৌদ্ধ ভিক্ষুকের পরিচয় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মুদ্রারাক্ষস অনুযায়ী জীবসিদ্ধি জৈন ভিক্ষুক এবং জ্যোতিষীর পরিচয়ে চন্দ্রগুপ্ত শত্রুপক্ষের দলে যোগ দিয়েছিলেন। একটি কাহিনি অনুযায়ী বলা হয় যে, জীবসিদ্ধি চন্দ্রগুপ্তকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যার পরিকল্পনা জানতে পেরেছিলেন। চন্দ্রগুপ্তর শত্রুপক্ষের সেই পরিকল্পনার কথা তিনি চাণক্যকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। চাণক্য নিজের বুদ্ধিবলে এমনভাবে চন্দ্রগুপ্তকে রক্ষা করেছিলেন, যাতে জীবসিদ্ধির ওপর কেউ সন্দেহ না করতে পারে। দ্বিতীয় একটি ঘটনা থেকে জানা যায় যে, রাজধানীর প্রধান তোরণ দুর্বল করে রাখা হয়েছিল। চন্দ্রগুপ্তর শত্রুপক্ষের পরিকল্পনা ছিল যে, চন্দ্রগুপ্ত হাতির পিঠে চেপে রাজধানীতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে সেই তোরণ তাঁর মাথার ওপর ভেঙে পড়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করবে। জীবসিদ্ধি সেই ষড়যন্ত্রের কথা চাণক্যকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। চাণক্যের বুদ্ধিবলে সেই তোরণ শত্রুপক্ষের এক গুপ্তচরের মাথায় ভেঙে পড়ে। এইভাবেই দীর্ঘদিন নিজের পরিচয় আত্মগোপন করে তিনি তাঁর গুরুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে রক্ষা করেছিলেন।

'মুদ্রারাক্ষস' এবং অন্যান্য গল্প থেকে জানা যায় যে, তাঁর গুপ্তচরবৃত্তির প্রয়োজনীয়তা শেষ হলে তিনি বানপ্রস্থে চলে গিয়েছিলেন। এই গল্পগুলো আসলে পুরোপুরি বাস্তব না কি কল্পনা এবং বাস্তবের মিলন, না কি শুধুই কল্পনা? সেই প্রশ্ন থাকলেও প্রাচীন ভারতের গুপ্তচর চরিত্রগুলোর মধ্যে জীবসিদ্ধির মতো চরিত্র যে উপস্থিত ছিল, তার সাক্ষ্য বিভিন্ন নথি এবং গল্প থেকেই পাওয়া যায়।

তথ্য ঋণ: এপিক চ্যানেল, ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি

More Articles