স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমজনতার লড়াই! চিনের দুর্দশাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারে ভারত?
China Zero Covid Policy Protest: সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন মানুষ। জীবনের কথা না ভেবেই উইঘুর মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায় জনতা, গণ অভ্যুত্থান হয় প্রবল মাত্রায়।
করোনা ঠেকাতে চিন ছিল অতি তৎপর। কিন্তু এই অতি তৎপরতার বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছিল চিনের সাধারণ মানুষ। চিনের কট্টরপন্থী বাম সরকারের বিরুদ্ধে যেখানে মানুষের কথা বলাও অপরাধ, সেখানে গোটা চিন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল চিনের স্বেচ্ছাচারী শাসক শি জিনপিংয়ের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। চিনের উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়া এক আন্দোলন কিভাবে শি জিনপিংয়ের মতো নেতাকেও পিছু হটতে বাধ্য করে তা দেখিয়েছে চিনের সাধারণ মানুষ। আন্দোলনের ঘটনার এক সপ্তাহ পরে শেষমেশ চিনের জনগণের মতেই সম্মতি জানাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। রাজধানী বেজিং-সহ অন্যান্য কিছু শহরের মতো সাংহাইয়েও করোনা বিধি শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
করোনা শূন্য নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আগে থেকেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল চিনের একটা বড়ো অংশ। সাধারণ পড়ুয়া থেকে শুরু করে আম জনতা সকলেই নেমেছিল ময়দানে। বেজিং এবং সাংহাই বিশ্বের সবথেকে বড় সার্ভিলেন্স স্টেট। এই শহরে বিক্ষোভরত অবস্থায় সরকারি ক্যামেরায় ধরা পড়লেও তার নিশ্চিহ্ন হওয়া অবশ্যম্ভাবী। চিনে এভাবে প্রতি বছর কত মানুষ যে গায়েব হয়ে যান তার কোনও ইয়ত্তা নেই! তবুও, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন মানুষ। জীবনের কথা না ভেবেই উইঘুর মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায় জনতা, গণ অভ্যুত্থান হয় প্রবল মাত্রায়। আর এই আন্দোলনের অতি তীব্রতার জেরে ‘করোনা শূন্য নীতি’ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু, ভাবনার বিষয় হলো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে শুরু করে হাইটেক মোবাইল ও ল্যাপটপ টেকনোলজি, উন্নতমানের বিমান ব্যবস্থা থেকে বিশ্বের সবথেকে বড় পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎস্যের ভাণ্ডার, সব কিছুই রয়েছে চিনের কাছে। এখানে একজন সাধারণ বাসিন্দার আয় অনেক দেশের সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি। হাইস্পিড ইন্টারনেট থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক গাড়ি সবকিছুই ব্যবহার করতে পারেন চিনের মানুষ। পাশাপাশি, প্রাচীন চিনের সেই ঐতিহ্যকেও পুরোপুরি ফিরিয়ে এনেছেন শি জিনপিং। এত কিছু যখন চিন সরকার সাধারণ মানুষের জন্য করেছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই সরকারের বিরুদ্ধেই সাধারণ মানুষের এই গণ অভ্যুত্থানের কারণটা ঠিক কী? শুধুই কি কোভিড শূন্য নীতি, না কি আরও কোনও কারণ দায়ী এই গণ অভ্যুত্থানের পিছনে? এর থেকেও বড় প্রশ্নটা হলো, চিন কি আবারও ১৯৮৯ সালের তিয়েনআমেন গণহত্যার দিকে এগোচ্ছে, যেভাবে চিনের কমিউনিস্ট সরকার হত্যা করেছিল আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের?
আরও পড়ুন- এখনও কেন লকডাউন চিনে! সাদা কাগজ নিয়ে বিক্ষোভকে ডরাচ্ছে কমিউনিস্ট চিন?
কেন এই গণ অভ্যুত্থান?
এরকম কিন্তু না যে চিনে কখনই কোনও আন্দোলন হয় না। করোনা পূর্ববর্তী সময় থেকে শুরু করে করোনার সময়কালেও চিনের নানা জায়গায় নানাভাবে ছোট ছোট আন্দোলন হয়েছিল। তবে, একটি ইস্যু নিয়ে সারা দেশে একসঙ্গে, এক সময়ে এত বড় আন্দোলন বিগত বহু বছরে চিনে দেখা যায়নি। এমনিতেই চিনে সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশি কিছু খবরাখবর বাইরে আসে না। কিছু বিদেশি সংবাদমাধ্যম ছাড়া চিনের ভেতরের খবর জানা সহজ না। আর যদি চিনের ভেতরের খবর করতে গিয়ে কোনও সংবাদকর্মী ধরা পড়েন, তাহলে তার কপালে থাকে চরম অত্যাচার। কিন্তু এবারের আন্দোলন তার থেকে অনেকটাই আলাদা। এই আন্দোলনে মানুষের মধ্যেই ছিল সরকারের প্রতি ক্ষোভ। ফলে এই আন্দোলনের আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেয়নি। তাও আবার চিনের রাজধানী বেজিং এবং তাদের সবথেকে বড়ো শহর সাংহাইয়ে! ফলে বিষয়টা ছিল সারা বিশ্বের জন্যই একটা বড়ো খবর।
এদেশের দিল্লির মতোই চিনের রাজধানীতেও রয়েছে কিছু রিং রোড। চিনের রাজধানীর তৃতীয় রিং রোডে হয়েছিল সরকারবিরোধী সবথেকে বড় আন্দোলন, কোটি কোটি মানুষ হাতে সাদা কাগজ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এই সাদা কাগজ ছিল সরকার বিরোধিতার প্রতীক। সরকার জনগণের উপরে যেভাবে স্বেচ্ছাচারিতা ফলায়, তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রতীক ছিল এই সাদা কাগজ। স্লোগান চলেছিল, 'We don't want to be locked, We want Freedom', 'Release Xinjiang, Give Freedom'.
এবারে আসা যাক একেবারে মূল কারণে। এই পুরো ঘটনার উৎসস্থল উত্তর চিনের শিনজিয়াং প্রদেশের উরুমকি। এই এলাকায় দিন কয়েক আগে ভয়াবহ আগুন লাগে এক বহুতলে, ১০ জন সেখানেই প্রাণ হারান। বিগত কয়েক দিন ধরে চিনের এই প্রদেশে চলছে ‘কোভিড শূন্য নীতি’। তাই যে আগুনে ভস্মীভূত হয়ে মানুষের মৃত্যু হত না, সেই আগুনের মানুষের মৃত্যু হলো। পুরোপুরি লকডাউন থাকার কারণে মানুষজন সেখান থেকে বেরোতে পারলেন না। দমকলের কর্মীরাও সেখানে প্রবেশ করতে পারলেন না। আর এই বিষয়টিকেই সরাসরি হত্যার সঙ্গে তুলনা করে সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন সাধারণ মানুষ। শুধু এই একটি ঘটনা নয়। যদি চিনের মিডিয়ার সামান্য খবরাখবর থাকে, তাহলেই যেটুকু জানা যায় তা হলো, চিনের সরকারের এই নীতির কারণে একটি ৩ বছরের শিশু মারা গিয়েছে কোয়ারান্টাইনে থাকাকালীন, ১৪ বছরের এক শিশু হাসপাতালে পৌঁছতে পারেনি। জোর করে পার্কিং লটের বাথরুমে কোভিড কোয়ারান্টাইন সেন্টার রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, বিভিন্ন ভাবেই সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করতে শুরু করেছিল চিনের সরকার। আর এই কোভিড শূন্য নীতির বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই এই আন্দোলন। যে সাংবাদিকরা বিগত ১০-২০ বছর ধরে চিনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা পর্যন্ত বলছেন, এরকম আন্দোলন চিনে হবে এটা ভাবাও যায়না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ স্লোগান দিচ্ছেন 'No to covid test'। এমনকী চিনের সুপ্রিম লিডার শি জিনপিংয়ের পতনও দাবি করছে জনতা।
ইরান থেকে চিন, কীভাবে রূপ নিচ্ছে গণআন্দোলন?
বিগত কয়েক মাসের মধ্যেই ইরান থেকে শুরু করে চিন, পৃথিবীর সব থেকে বড় কিছু সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশে হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ইরানে মাহশা আমিনির মৃত্যুর পরবর্তীতে হিজাব বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে চিনের জিরো কোভিড পলিসির বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন, সবকিছুই যেন এক সূত্রে বাঁধা। চিন হোক বা ইরান, দু’টি দেশের সরকারকেই কোনওরকম বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় না। নামে গণতন্ত্র থাকলেও, সারা দেশে চলে স্বৈরতন্ত্রই।
তবে, ইরান হোক বা চিন, দুই দেশেই আন্দোলন কিন্তু শুরু হয়েছিল কোনও একটি প্রান্তে এবং সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। চিনের ক্ষেত্রে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল একেবারে উত্তর পশ্চিমের একটি প্রদেশ উরুমকি থেকে। সেখানে অধিকাংশ জনগণ উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের। চিনের সংখ্যাগুরু জনতা যেহেতু হান সম্প্রদায়ের, তাই এই উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে কোনওদিন বিশেষ আলোচনা মূলস্তরে আসেনি। কিন্তু এবারে সেখান থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের ফুলকিতেই পুরোপুরি জ্বলে উঠল চিন।
একই ঘটনা ইরানের ক্ষেত্রেও। মাহশা আমিনির সঙ্গে ঘটনাটি ঘটে ইরানের একেবারে উত্তরে ইরান ও ইরাক সীমান্তের সামনাসামনি অবস্থিত সাকেজে। সেখান থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনই নড়িয়ে দিল পুরো ব্যবস্থাকে। ইরানের ইসলাম সরকার বাধ্য হলো ‘গস্ত-ই-এরশাদ’ নামের নীতিপুলিশ বাহিনীকে বাতিল করতে। তাই এই দুই আন্দোলন থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, আন্দোলনের সূত্রপাত যেখান থেকেই হোক না কেন, সরকারের বিরুদ্ধে যদি মানুষের ক্ষোভ থাকে, তাহলে বিক্ষোভ হবেই। কোনও নীতি পুলিশ, কোনও স্বৈরাচারী নীতি আটকাতে পারবেনা বিক্ষোভকে।
আরও পড়ুন- কোভিডের টিকাতেই ছিল মৃত্যুফাঁদ! বিস্ফোরক যে তথ্য আসছে প্রকাশ্যে
ভারত কীভাবে নিতে পারবে সুবিধা?
যে নীতি নিয়ে এতদিন শি জিনপিং চিনের অর্থনীতিকে তৈরি করেছিলেন, সেই নীতি ধীরে ধীরে ব্যর্থতার দিকে এগোতে শুরু করেছে। চিনের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এবারে শুরু হয়েছে সমস্যা। আন্তর্জাতিক দিক থেকে দেখতে গেলে, চিনের প্রভাব বেশ কিছুটা কমেছে। অন্তত করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির আগে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিনের যতটা প্রভাব ছিল, তার তুলনায় এখন প্রভাব অনেকটাই কম। সুতরাং, বলা যেতেই পারে, চিনের বামপন্থা ধীরে ধীরে নিজেদের প্রভাব হারাতে শুরু করেছে। আর এইখানেই এই পরিস্থিতির সুবিধা নিতে পারে ভারত। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ভারত চিনকে অনেকখানি পিছু হঠাতে পারে, যাতে গালওয়ানের মতো ঘটনা আবার ঘটানোর আগে চিন ফের চিন্তা করে।
এর জন্য ভারতের অস্ত্র হতে পারে গণতান্ত্রিক শক্তি, ভারতের ‘গুডউইল’ এবং ‘সফট পাওয়ার অ্যাপ্রোচ’। এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রত্যেকটি কোম্পানি চিন+১ নীতি গ্রহণ করতে চাইছে। অর্থাৎ চিন একমাত্র ভরসা নয়, চিনের বাইরেও কোনও একটি দেশে তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে চাইছে পৃথিবীর সমস্ত কোম্পানি। এখন অ্যাপেল শুধুমাত্র চিন নয়, ভারতীয় আইফোন তৈরি করতে চলেছে। চিনের ফক্সকনে বিক্ষোভের পর অ্যাপেল নিজেদের কারখানা চিন থেকে গুটিয়ে নিতে চাইছে বললেই চলে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির পরে সারা বিশ্ব মনে করেছিল, বিশ্বের প্রায় ১০০০ টি কোম্পানি চিন থেকে নিজেদের কারখানা সরিয়ে অন্যত্র স্থাপন করবে। এই সমস্ত কোম্পানিগুলি চিন থেকে নিজেদের কারখানা স্থানান্তর করলেও কিন্তু ভারতে আসেনি। বরং তারা চলে গিয়েছে ভিয়েতনাম, লাওস, ইন্দোনেশিয়া সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে। কিছু কিছু কোম্পানি চিনের সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানে গিয়ে কারখানা স্থাপন করেছে, যেখানে এমনিতেই প্রতিযোগিতা চূড়ান্ত মাত্রায়।
কেন ভারতে আসছে না এই সমস্ত কোম্পানি? শুধুমাত্র ধার্মিক এজেন্ডায় আটকে থেকে ব্যবসায়িক দিকের বিকাশ কি আদৌ সম্ভব? সুরক্ষিত এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক দেশ না হলে বৈদেশিক বিনিয়োগ কেনই বা এদেশে আগ্রহী হবে! এমনটা না হলে চিনের স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে মিলে যাবে ভারতের ধর্মতন্ত্র। না তো লাভ হবে ভারতের অর্থনীতির, না তো হাল ফিরবে ভারতের সাধারণ মানুষের।