জেরার নামে নৃশংসতা! ভূ-স্বর্গের আসল ছবিটা আজ যেমন

Civilian Deaths in Jammu Kashmir: বিজেপি বলছে 'সব চাঙ্গা সি'! প্রতিদিন গ্রেফতার হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। সাম্প্রতিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা বলেছেন কাশ্মীর ভারতের গাজা হতে চলেছে

জম্মু ডিভিশনের পুঞ্চ এবং রাজৌরি জেলার সীমানায় সেনার দু’টি গাড়িতে বৃহস্পতিবার জঙ্গি হামলার ঘটনায় পাঁচ জওয়ান নিহত হয়েছেন। ঘটনার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে পাক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তইবার শাখা সংগঠন ‘দ্য পিপলস অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ফ্রন্ট’। এর পরে ওই এলাকায় তল্লাশি অভিযানে নামে সেনা, রাষ্ট্রীয় রাইফেলস, সিআরপিএফ এবং পুলিশের যৌথ বাহিনী। তখনই ওই এলাকার টোপা মাস্টানডারা গ্রাম থেকে সেনা বেশ কয়েক জনকে আটক করে বলে অভিযোগ। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, সেনা হেফাজতে মারধরের ফলে ধৃতদের মধ্যে সাফির হুসেন (৩৭), বছর মহম্মদ শওকত (২৬) এবং শাবির আহমদের (৩২) মৃত্যু হয়।

তড়িঘড়ি উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। পুঞ্চ এবং রাজৌরি এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার স্তরের এক অফিসারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। পাশাপাশি, নিহত তিন গ্রামবাসীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও নিকটাত্মীয়কে সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন। কাশ্মীরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল থেকে মহম্মদ আশরফ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনী। ডেহরা কি গলিতে নিয়ে গিয়ে প্রথমেই ফোনগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর নগ্ন করে লাঠি, লোহার রড দিয়ে চলে অকথ্য অত্যাচার। ক্ষতের উপর ছিটানো হয় লঙ্কার গুঁড়ো। মারের চোটে বেহুঁশ হয়ে যান আশরফ।

কাশ্মীরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল থেকে মহম্মদ আশরফ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনী। ডেহরা কি গলিতে নিয়ে গিয়ে প্রথমেই ফোনগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর নগ্ন করে লাঠি, লোহার রড দিয়ে চলে অকথ্য অত্যাচার। ক্ষতের উপর ছিটানো হয় লঙ্কার গুঁড়ো। মারের চোটে বেহুঁশ হয়ে যান আশরফ। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পাঁচজন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ছড়ায় গ্রামবাসীদের মধ্যে। এ অঞ্চলে ফের বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা।

২০০৭ সাল থেকে জম্মু কাশ্মীরের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টে লাইনম্যানের কাজ করে আসছেন আশরফ। মাস মাইনে ৯৩৩০ টাকা। দুই ছেলে এক মেয়ের পিতা আশরফের স্ত্রী গত হয়েছেন। বাকি পাঁচজনের অবস্থাও প্রায় এক। তাদের মধ্যে রয়েছে বছর পনেরোর এক কিশোরও। অভিযোগ, দশম শ্রেনির ওই ছাত্রের উপরও অকথ্য অত্যাচার চালায় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা।

আরও পড়ুন:মন্দির নির্মাণই কি দেশের কাজ, বাংলা যা ভাবছে

কয়েকদিন আগে কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় জম্মু-কাশ্মীরের উপ-রাজ্যপাল মনোজ সিনহা বলেন, কাশ্মীর উপত্যকা এখন কলকাতার থেকে নিরাপদ। এই ভাষণের আটচল্লিশ ঘণ্টা পার হতে না হতেই একদিকে জঙ্গি হামলা, অন্যদিকে জঙ্গিদমনের নামে নাগরিক-নিপীড়নের অভিযোগ উঠল কাশ্মীরে।

বিজেপি ক্রমাগত দাবি করে আসছে, ৩৭০ ধারা বাতিলের পর আমজনতার নিরাপত্তা নাকি বেড়েছে। বেড়েছে নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতাও। পাথরছোঁড়া নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেনাদের সঙ্গে জনতার সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপও নাকি অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু কোথায় কী? সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিজেপির সমস্ত দাবিতে বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ মনে করে, ২০১৯-এর পর কিছুই বদলায়নি। সেনার সঙ্গে নাগরিকদের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং উঠেছে একের পর এক অভিযোগ। কখনও উনিশ বছরের যুবককে চেয়ারে বেঁধে ঠোঁটে বারবার সূচ ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ, কখনও মহিলাদের ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির অভিযোগ, কখনও বা বছর পনেরোর কিশোরকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগ। ক্রমাগত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে চলেছেন কাশ্মীরের মানুষ। মায়েরা জানেন না সন্তান আর বাড়ি ফিরবে কিনা! অথচ বিজেপি বলছে 'সব চাঙ্গা সি'! প্রতিদিন গ্রেফতার হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। সাম্প্রতিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা বলেছেন কাশ্মীর ভারতের গাজা হতে চলেছে।

কেন মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন মনোজ সিন্‌হারা? কেন গোদি মিডিয়া জাঠ জগদীপ ধনখড়কে নিয়ে তাদের উদ্বেগের সিকিভাগও কাশ্মীরের জনজীবনের জন্য বরাদ্দ করে না? কোন অদৃশ্য জুজুর ভয়ে চুপ বিরোধী নেতারাও? কোনপথে কাশ্মীরে শান্তি ফিরবে? আসুন, জেনে নিই বিশেষজ্ঞদের মতামত।

সুমন ভট্টাচার্য (সাংবাদিক)

আতঙ্কবাদ আসলে জলের মতো। তাকে একদিকে রুখতে গেলে অন্যদিকে গড়িয়ে যায় ঠিকই। তার মূল কারণটা খোঁজা প্রয়োজন। গোড়ায় গলদ থাকলে রোখা যাবে না জঙ্গি হামলা। ফলে আক্লমণ হয়েই চলেছে। আর সেই আতঙ্কবাদকে ব্যবহার করছে বিজেপি। ফারুখ আবদুল্লাহ খুব দামি কথা বলেছেন। সত্যিই কাশ্মীর গাজায় পরিণত হবে কিনা আমরা জানি না। তবে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত অবহেলিত। তার সঙ্গে কাশ্মীরী মুসলমানদের নিয়ে যে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বিজেপি, তাতে ভবিষ্যতে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে একশো ভাগ। সেনাদের কাশ্মীরীদের হৃদয় জয় করতে হবে। শক্তি প্রদর্শন করে তা করা যাবে না। করা যাবে না কাশ্মীরীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করেও। কাশ্মীরী মুসলিম মানেই জঙ্গি—এ আখ্যান ভাঙতে হবে। বিজেপি তা করছে না। বরং সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। মনোজ সিনহা কাশ্মীরের নিরাপত্তা নিয়ে যাই বলুন, পুঞ্চ এবং রাজৌরিতে ইন্টারনেট বন্ধ করতে হল, বিতর্কিত অত্যাচারের ভিডিও যাতে ছড়িয়ে না পড়ে। যে মানুষের পরিবারের কেউ মারা যাচ্ছে, সে কি কোনও দিন আর সেনাকে বিশ্বাস করতে পারবে? বরং জঙ্গিরা কি তার সুযোগ নেবে। তাহলে কাশ্মীরকে কীভাবে বোঝা সম্ভব? কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব? মিথ্যে কথা কাশ্মীরের পরিবেশকে আরও জটিল করবে। কাশ্মীরের অবস্থা খুব ভাল—এমনটা প্রচার করলে চলবে না। শ্রীনগর প্রেসক্লাবে এক কাপ চা খাওয়ার অবস্থা নেই। কাশ্মীরের সমস্যাটা সহানুভূতির সঙ্গে বোঝা প্রয়োজন। না হলে আমাদের এই ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেবে জঙ্গিরা। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমাদের সেনারা। অবিশ্বাস কাশ্মীরকে গোটা দেশের যৌথমানস থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ করে তুলছে।

আরও পড়ুন: জিজ্ঞাসাবাদের নামে সাধারণ মানুষকে হত্যা ভারতীয় সেনার! কাশ্মীরের ‘অচ্ছে দিন’ তবে এই?

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য (সাংবাদিক)

২০২২-এর জানুয়ারিতেই কাশ্মীরের প্রেসক্লাবটিকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। তবে তার শুরু হয়েছিল ২০২-র জুন মাসেই। 'মিডিয়া পলিসি' নামে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন। সেখানে বলা হয়, উস্কানি দিতে চাইলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। এমন কোনও গণমাধ্যম সরকারি বিজ্ঞাপন পাবে না। এখানে উস্কানির সংজ্ঞাই কী খোলসা করে‌ বলা হয়নি। এমনকি উস্কানি দেওয়ার কথা ভাবলেও এ নিয়ম বর্তাবে। ভাবছে—সেটা কীভাবে বোঝা যাবে? এ ব্যবহার করে যাকে ইচ্ছে অসুবিধায় ফেলতে পারে সরকার। বিজ্ঞাপন বন্ধ করে সংবাদমাধ্যমগুলির উপর অর্থনৈতিক আক্রমণ চালানোর পথপ্রশস্ত করা হল। এবছর সেপ্টেম্বরে বিবিসি প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, কাশ্মীরের সাংবাদিকরা  ভাবেন, তাঁদের প্রত্যেকটি লেখাই শেষ লেখা। এর পরে কী হবে কেউ জানেন না। আদৌ কাল বেঁচে থাকবেন কিনা জানেন না তাঁরা। একের পর এক সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা হচ্ছে। 'গ্রেটার কাশ্মীর'-কে চুপ করানো হল, প্রায় মুছে ফেলা হল 'দ্য কাশ্মীর ওয়াল্লা' সংবাদমাধ্যমটিকেও। শুধুমাত্র নিরাপত্তার খাতিরে? নাকি কোনও প্রশ্নই করা যাবে না—এমনটা বোঝাতে চাইছে বিজেপি সরকার? সশস্ত্রবাহিনীর উপস্থিতিতে যেভাবে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে তা ভয়ানক। রোজকার সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তাই কাশ্মীরের কোনও দুর্দশার খবর আমরা সেভাবে পাচ্ছি না।  কাশ্মীরটাকে বিরোধীরাও খুব একটা ইস্যু করতে পারবেন বলে যনে হয় না। তাঁরা কেউ বলছেন না, ঘৃণা নয়, ভালোবাসাই একমাত্র পথ। কাশ্মীরকে যদি ভারতের অংশ মনে করি, কাশ্মীরীদেরকেও তো ভারতীয় মনে করতে হবে! তাঁদের সমস্যা ভারতের সমস্যা, ভারতীয়দেরই সমস্যা—এই বোধটা থাকা দরকার। একজন ভারতীয়র প্রতি অন্যায় দেখলে আমাদের মুখ খোলা প্রয়োজন, বিরোধিতা করা প্রয়োজন। বাইরে থেকে লোক এনে জায়গা দখল করে দাদাগিরি চলতে পারে, আত্মীয়তা তৈরি করা যায় না। ভারতের মূল শক্তি বিভিন্নতাকে স্বীকার করতে পারা। সেখানকার সাধারণ মানুষের সমস্যা না বুঝলে কাশ্মীর নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকবে। চিন্তার গোড়ায় গলদ থেকে যাচ্ছে। প্রত্যেক ভারতবাসীর কর্তব্য ভারতবাসী হিসেবে কাশ্মীরীদের পাশে থাকা।

আরও পড়ুন: কাশ্মীরের দুর্দশার জন্য দায়ী নেহরু, বলছেন অমিত শাহ! কী বলছেন কাশ্মীরে মানুষ?

সম্বিত পাল (অধ্যাপক-সাংবাদিক)

কাশ্মীরের তরুণদের সামনে ভয়াবহ বেকারত্বের সমস্যা। অথচ মানুষ আলোচনা করছে শুধুমাত্র নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে। হয় জাতীয় নিরাপত্তা নয় সন্ত্রাসবাদ। এর মাঝে হারিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ কাশ্মীরীরা। কাশ্মীরের বাস্তব আমরা কতটা জানতে পারছি? কাশ্মীরের কতবার ইন্টারনেট কতবার বন্ধ করে রাখা হয়েছে? এমন নজির আর সম্ভবত নেই। ফারুক আবদুল্লাহ হঠাৎ গাজা শব্দটা কেন আনলেন? গাজা একটা বিচ্ছিন্ন অবহেলিত জায়গার অনুসঙ্গ আনে। কাশ্মীরের মানুষও আসলে উপেক্ষিত। তাঁদের সমস্যা নিয়ে ভাবছে কেউ? মনোজ সিনহা বলছেন কাশ্মীর খুব ভালো আছে। তাহলে কেন প্রেসক্লাবে তালা ঝোলাতে হচ্ছে? কেন ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে? জাতীয় নিরাপত্তার কথা ভেবে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে কিছু বলা যাবে না—এমনটা তো হতে পারে না! ৩৭০ তুলে নেওয়ার পরে কাশ্মীরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য আর সামনে আসছে না। তা ক্রমাগত চেপে দেওয়া হচ্ছে। রাজৌরি-পুঞ্চ এলাকাতেও সংরক্ষণ নিয়ে জটিলতায় ক্ষোভে ফেটে পড়ছে গুজ্জর-রা। সেটাও একটা সমস্যা। সেগুলিও মানুষের সামনে আসা উচিত। জম্মু-কাশ্মীরে নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন হওয়াটা খুব প্রয়োজন। এখন পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করছে না। চিনও খুব তৎপর নয় লাদাখ নিয়ে। এ অবস্থায় আমরা এটাই আশা করতে পারি, সুষ্ঠু ভাবে জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচন হোক। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আসুন। সংসদে তাঁদের সমস্যাগুলি তুলে ধরুন। ভুলত্রুটি থাকবেই। কিন্তু কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ যেন নিজেদের কথাগুলি তুলে ধরতে পারে!

More Articles