ড্রাগ থেকে প্রতারণা, সুস্মিতার জীবনসঙ্গী 'ফেরার' ললিত মোদির জীবন ভরা বিতর্কে

পলাতকের এই প্রত্যক্ষ প্রেম উদযাপন অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। ভারতীয় সরকারের অকর্মণ্যতার উদাহরণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে একে। আবার অনেকে তাঁদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের নজির টানছেন। যাই হোক, ফের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছ...

এককালে ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে ললিত মোদির নাম জুড়ে গিয়েছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে। যাবতীয় ক্রিকেট-আলোচনা তাঁকে ছাড়া সম্পূর্ণ হতো না প্রায়। ললিত মোদি সফল ব্যবসায়ী। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ তথা আইপিএল-এর ধারণা তাঁরই মাথা থেকে বেরিয়েছিল। সেই ললিত মোদি বর্তমানে পলাতক। সেই অবস্থাতেই নিজের ইনস্টাগ্রামে তিনি জানিয়েছেন, প্রথম ভারতীয় মিস ইউনিভার্স সুস্মিতা সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে তাঁর। ডেটে যাচ্ছেন দু'জনে। এই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। পলাতকের এই প্রত্যক্ষ প্রেম উদযাপন অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। ভারতীয় সরকারের অকর্মণ্যতার উদাহরণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে একে। আবার অনেকে তাঁদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের নজির টানছেন। যাই হোক, ফের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছেন ললিত মোদি।

ললিতের জন্ম ১৯৬৩ সালে, দিল্লিতে। আইপিএল-এর একক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই বেশি বিখ্যাত তিনি। আইপিএল-এর প্রথম চেয়ারম্যান এবং কমিশনার ছিলেন তিনি। ২০০৭-এ প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত সাউথ আফ্রিকাকে হারানোর পর পরই শুরু হয়েছিল আইপিএল। ৫৮ বছর বয়সি এই শিল্পপতির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে পড়াশোনা পুরোটাই আমেরিকায়।

ছাত্রাবস্থা থেকেই বিতর্কে জড়িয়েছেন ললিত। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কোকেন কিনতে গিয়ে ধরা পড়েন, বিক্রেতা তাঁর কাছে থেকে ১০,০০০ ডলার ছিনিয়ে নিয়েছিল। যাই হোক, আমেরিকার খেলাধুলো নিয়ে ব্যবসা তাকে প্রভাবিত করেছিল। ফলে ভারতের মাটিতেও সেই ব্যবসাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালেই ৫০ ওভারের একটি ঘরোয়া লিগের পরিকল্পনা করেছিলেন ললিত, প্রোজেক্টের নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ লিমিটেড’। কিন্তু বিসিসিআই সেই ধারণাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। তখন ললিত মোদি ভারতীয় রাজনীতিতে জায়গা করার চেষ্টা শুরু করলেন। ক্ষমতার সহযোগিতা পেলে নিজের মতো আখের গোছানো সম্ভব। বিজেপি-র সঙ্গেও তাঁর সদ্ভাব ছিল, কংগ্রেসের সঙ্গেও। ২০০৮-এ আইপিএল চালু হলো, এবং ললিত মোদি হলেন এক এবং অদ্বিতীয় উদ্যোক্তা। টি-টোয়েন্টি লিগ এযাবৎ শুরু হয়ে গিয়েছিল, এবং তার জনপ্রিয়তা অনেকাংশেই কাজে লাগালেন ললিত। পরের বছর ভারতে নির্বাচনের জন্য আই পি এল যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল, তখনই বোঝা গিয়েছিল, ভারতের বাইরেও এই লিগের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনন্ত।

আরও পড়ুন: প্রেম না হয় করলেন, সুস্মিতা আদৌ ললিত মোদির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন?

কিন্তু ২০১০-এর আইপিএল ফাইনালের পরেই ললিতকে বিসিসিআই থেকে বহিষ্কার করা হল। ক্ষমতার অপব্যবহার, উচ্ছৃঙ্খলা এবং অর্থ নয়ছয় করা– ইত্যাদি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তাকে। বিসিসিআই একটি বিশেষ তদন্ত শুরু করে। ২০১৩ নাগাদ ললিত মোদি দোষী সাব্যস্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে আজীবন ব্যান করা হয়। সে সময়েই ললিত পালিয়ে আসেন লন্ডনে। তারপর থেকে বহুবার নানা সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনে বসেই নিজেকে নির্দোষ প্রচার করে চলেছেন ভদ্রলোক। এদিকে মুম্বইয়ের একটি বিশেষ আদালত তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ২০১৫ সালে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট তাঁর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের যে অভিযোগ আনে, তার ভিত্তিতে এই পরোয়ানা। ২০১০ নাগাদ বিজয় মালিয়ার মেয়ের সঙ্গে ললিত মোদির নাম জড়িয়ে একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আয়কর বিভাগের একটি তদন্তের সময় লায়লা মেহমুদকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেই সময় বিজয় মালিয়া বিতর্ক এড়িয়ে বলেন, “মেয়ে ওখানে কাজ করে, তদন্তের বিষয়ে কিছুই জানতাম না।"

বর্তমানে ফের একটি মামলায় ফেঁসেছেন মোদি। এবার ইংল্যান্ডেই। গুরপ্রীত গিল মাগ সাত মিলিয়ন ডলারের একটি আইনি চ্যালেঞ্জ করেছেন ইংল্যান্ডের উচ্চ আদালতে। অভিযোগ, ২ মিলিয়ন ডলারের একটি বিনিয়োগ করতে তিনি প্ররোচিত করেন গুরপ্রীতকে। আইওন কেয়ান নামে একটি ক্যানসারের চিকিৎসা উদ্যোগে বিনিয়োগ করেন গুরপ্রীত। কিন্তু তাঁকে যে সব রাজকীয় বিনিয়োগকারীর নাম বলে রাজি করিয়েছিলেন ললিত, তাদের সবটাই ভুয়া। এমনকী, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুত্র প্রিন্স অ্যান্ড্রিউ-ও এই উদ্যোগে বিনিয়োগ করছেন বলে গুরপ্রীতকে জানিয়েছিলেন মোদি। স্বাভাবিকভাবেই এতে ভরসা পেয়েছিলেন গুরপ্রীত। এমনকী, তাঁকে ললিত মোদি এও বলেছিলেন যে, বিশ্বজোড়া একটি ক্যানসার চিকিৎসা উদ্যোগের কথা তিনি ভাবছেন। একটিমাত্র রেডিওথেরাপির ডোজেই কাজ হবে বলে দাবি করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন তাঁর স্ত্রীও এর সুফল পেয়েছিলেন। সাত বছর বাঁচানো গিয়েছিল তাঁকে। মারা গিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। আরও কী কী বলেছিলেন ললিত, কোর্টে সমস্ত খুলে বলেন গুরপ্রীত। দ্য সানডে টাইমস-এ সেই ইনভেস্টমেন্ট ডকুমেন্ট ছাপা হয়েছে। যা দেখিয়ে বিনিয়োগে রাজি করাচ্ছিলেন মোদি। তাতে প্রিন্স অ্যান্ড্রিউ, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ভূতপূর্ব সচিব জেনারেল কোফি আন্নান এবং ইউনাইটেড আরব এমিরেটস-এর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার শেখ মানশুর বিন-জায়েদ-আল নাহিয়ানের নাম পর্যন্ত রয়েছে বিনিয়োগকারী হিসেবে। গিল মাগ জানিয়েছেন, এছাড়াও থাইল্যান্ডের ভূতপূর্ব প্রধান মন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াত্রা– নানা নামিদামি ব্যক্তিত্বর কথাও বলেছিলেন ললিত। যদিও ললিত মোদি এবারও নিজেকে নির্দোষ প্রচার করছেন, সেই ভিত্তিতেই কেস লড়ছেন। যদিও প্রিন্স অ্যান্ড্রিউ সাফ জানিয়েছেন, এমন কোনও কোম্পানিতেই তিনি কখনও বিনিয়োগ করেননি, কোম্পানির নামও শোনেননি তিনি কখনও। ২০১৯ সালে প্রোজেক্টটি সম্পূর্ণ ফ্লপ করলে গিল মাগ আইনি ব্যবস্থা নেন। এখনও সেই কেস চলছে।

দেশে-বিদেশে ললিত মোদির সুখ্যাতি কম না। কখনও ড্রাগ, কখনও টাকা নয়ছয়, কখনও মিথ্যে বলে বিনিয়োগে রাজি করানো– ইত্যাদি নানা ঘটনায় বেশ নাম অর্জন করেছেন তিনি। ইতিমধ্যে তাঁর এই ঘোষণা আরেকবার বিতর্ক তৈরি করেছে। ন'বছরের পুরনো ট্যুইটও খুঁজে বের করেছেন লোকজন। ২০১৩ সালের সেই ট্যুইটে কমিটমেন্ট, প্রমিস ইত্যাদি কিছু রোমান্টিক শব্দ আদানপ্রদান হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে এমনটাই দাবি মানুষের। তখনও মিনাল, অর্থাৎ ললিত মোদির স্ত্রী বেঁচে। তারপরে দীর্ঘ বারো বছর পর এই ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই নানারকম চর্চা উসকে দিয়েছে।

 

More Articles