সেনা নিয়োগের ফাঁদ! গরিব ভারতীয়দের যেভাবে যুদ্ধের বলি করছে রাশিয়া
Ukraine, Russia and war: গত বছর ৩১ ডিসেম্বর তারিখে শেষবার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছিল আসফান। এর কিছুদিন পরেই আসে তাঁর মৃত্যুর খবর।
বিদেশ মানেই আরও ভালো জীবন, আরও বেশি রোজগার। আর সেই রোজগারের লোভে অসংখ্য তরুণ-তরুণী দিশেহারার মতো ছোটেন। পঞ্জাবের একটি এলাকায় বিদেশ যাওয়ার জন্য রীতিমতো মানত করে মানুষ। বাড়ির ছাদে সিমেন্টের উড়োজাহাজ পর্যন্ত বানায় লোকে। 'ডানকি' সিনেমার দৌলতে সে ছবির সঙ্গে এতদিনে পরিচিত দর্শক। আর সে গল্প যে এককণাও যে মিথ্যে নয়, তার প্রমাণ মিলেছে হায়দরাবাদে আরও একবার। চাকরির লোভে রাশিয়া উড়ে গিয়েছিলেন হায়দরাবাদের সেই যুবক। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁকে জোর করে লাগিয়ে দেওয়া হল যুদ্ধে। অবশেষে ইউক্রেন থেকে ফিরল তাঁর মৃত্যুর খবর।
বরাবর বিদেশে গিয়েই বসবাসের ইচ্ছা ছিল হায়দরবাদের বাসিন্দা মহম্মদ আসফানের। বন্ধুবান্ধবের কাছেও তেমনটাই বলতেন সবসময়। হয় ইংল্যান্ড নয় অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে থাকতে চাইতেন। অবশেষে এসেছিল রাশিয়া যাওয়ার সুযোগ। ভালো চাকরির প্রতিশ্রুতিও জুটেছিল। মোটের উপর খুশিই ছিলেন আসফান।
আরও পড়ুন: পেশায় কাঠমিস্ত্রি পুতিনের ‘বডি ডবল’! রুশ প্রেসিডেন্টের অবর্তমানে তাঁর হাতেই কি দেশের রাশ?
গত বছর নভেম্বরে রাশিয়া উড়ে যান বছর তিরিশের যুবক। বাড়িতে স্ত্রী, দুই সন্তান, তিন ভাই আর বৃদ্ধ বাবা। মা গত হয়েছেন বছর দুটি। দু'টি সন্তানেরই বয়স দু'বছরের কম। তাদের রেখেই আরও ভালো আয়ের আশায় রাশিয়া উড়ে যান আসফান। শুধু আফসানই নয়, আসফানের মতো আর ২০ জন ভারতীয়কে সে দেশে ভালো কাজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাশিয়ায়। বলা হয়েছিল, রুশ সরকারের দফতরে আধিকারিক হিসেবে কাজ দেওয়া হবে তাদের।
কিন্তু আদতে তেমনটা হয়নি। সেই ২০২২ সালে ফের ইউক্রেনে নতুন করে আক্রমণ করে বসে রাশিয়া। সেই থেকে যুদ্ধ চলছে দু-দেশের। হার মানেনি ইউক্রেনও। সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে তারা। ইউক্রেনের যেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তেমন ভাবেই বিপুল সংখ্যক রুশ সেনারও মৃত্যু হয়েছে এই যুদ্ধের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, সেনার জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে পুতিন সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই রুশ সেনার পদে এখন প্রচুর কর্মখালি। কিন্তু ভিনদেশি, যারা ভাগ্যান্বেষণে রাশিয়া আসতে চান, তাদের সেনার কাজ দিলে তারা করবেই বা কেন। অগত্যা মিথ্যা বলে বিভিন্ন দেশ থেকে সেনাজওয়ান নিযুক্ত করা শুরু করে রাশিয়া। বিভিন্ন দালাল, এজেন্টের মাধ্যমে ভুয়ো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলতে থাকে সেনাবৃদ্ধির কাজ।
দিন কয়েক আগেই এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ভারতের বিদেশমন্ত্রক। এখানকার বহু যুবককে ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে যুদ্ধের জন্য, বলে অভিযোগ করা হয়। আসফানের পরিবার জানিয়েছে, হায়দরাবাদের আরও দু'জন গিয়েছিলেন রাশিয়ায় তাঁর সঙ্গে। জানা গিয়েছে, গত বছর ৩১ ডিসেম্বর তারিখে শেষবার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছিল আসফান। এর কিছুদিন পরেই আসে তাঁর মৃত্যুর খবর। ভারতের রুশ দূতাবাসের তরফ থেকে টুইট করে জানানো হয়েছে, তাঁরা সম্প্রতি ভারতীয় নাগরিক মহম্মদ আসফানের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে পেরেছেন। আফসানের পরিবার ও রুশ কর্তৃপক্ষ দু'জনের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছে রুশ দূতাবাস। কীভাবে আফসানের দেহাংশ দেশে ফেরানো যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাশিয়া যাওয়ার আগে হায়দরবাদেরই একটি পোশাক বিপণীতে কাজ করতেন আসফান। এরই মধ্যে দুবাইয়ের এক এজেন্টের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর, যে ইউটিউবে 'বাবা ভ্লগস' নামে একটি চ্যানেল চালাতেন। কীভাবে বিদেশে কাজের পারমিট পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে নানা টিপস দেওয়া হত তাক চ্যানলে। শুধু আফসানকেই নয়, বহু যুবককেই রাশিয়ায় মোটা বেতনের চাকরি করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে। তার বিনিময়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা করেও নিয়েছিল সেই এজেন্ট। আরও বেশি রোজগার, আরও একটি স্বচ্ছ্বল ভাবে থাকার আশায় কোনও মতে সেই টাকাটা জোগার করে ওই এজেন্টের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আফসান। মস্কো পৌঁছনোর পর তাঁদের দিয়ে রুশ নথিপত্রে সই করানো হয় বলে অভিযোগ। আরও পরে তাঁরা বুঝতে পারেন, অন্য কোনও কাজ নয়, রুশ সেনার হেল্পার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে তাঁদের। এমনটাই জানিয়েছেন আফসানের ভাই ইমরান। সম্প্রতি আফসানের ব্যাপারে ওই এজেন্ট তাঁর পরিবারকে জানায়, আফসানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়ে গিয়েছে। আফসান আহত। কিন্তু মৃত্যুর কথা চেপে যায় সেই প্রতারক।
পরে এআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসির কাছ থেকেই আসফানের মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে পারে পরিবার। ওয়াইসি সম্প্রতি বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের কাছে রাশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া ভারতীয়দের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। বিদেশমন্ত্রীকে প্রতারণার ব্যাপারেও জানান তিনি। শুধু হায়দরাবাদ নয়, দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকেই বহু যুবককে ভালো কাজ দেওয়ার নাম করে যুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছে রাশিয়া। ক্রমশ এর একটি বড় চক্র সক্রিয় হয়েছে দেশ জুড়ে।
ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন আসফান। প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার শহিদ আফ্রিদির বিরাট ভক্ত ছিলেন। বিকম পাশ করার পর ওই পোশাক বিপণীতে কাজ পান। মোটামুটি চলে যেত সংসার। কেন যে আরও বেশি রোজগারের ভূতটা মাথায় চাপল, কপাল চাপড়াচ্ছেন বাড়ির লোক। পরিবারের কেউই প্রাণবন্ত, ছটফটে ছেলেটির এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। আপাতত তাঁর মরদেহটুকু পাওয়ার জন্য ভারত সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছেন আসফানের পরিবার।
আরও পড়ুন: অসুস্থ পুতিন এবার সরে দাঁড়াবেন? আমূল বদলে যাবে রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি?
পাশাপাশি মস্কোর ভারতীয় দূতাবাসের বিরুদ্ধে কর্তব্য গাফিলতির অভিযোগ এনেছে মৃতের পরিবার। তাঁদের বক্তব্য, খবর পাওয়ার পরই যদি দ্রুত পদক্ষেপ করত দূতাবাস, তাহলে এই শোচনীয় পরিস্থিতি হত না আসফানের। খবর পাওয়ার পর রুশ সেনাবাহিনীকে ভারতীয় দূতাবাস চিঠি দিয়েছিল বলে দাবি করা হয়। তবে সে বিষয়ে আর কোনও খবরাখবর নেয়নি তারা। ইতিমধ্যেই ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, রাশিয়ায় কাজ করতে যাওয়ার নামে প্রতারিত যুবকদের উদ্ধারের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেবে ভারত সরকার। ইতিমধ্যেই রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে নিয়মিত যোগাযোগও করছে নয়াদিল্লি। বাকি যুবকদের পরিণতিও আসফানের মতো হবে না তো। দুই দেশের অস্ত্রশক্তির পরীক্ষায় বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে না তো তৃতীয় বিশ্বের অন্য একটি দেশের দরিদ্র, স্বপ্নদেখা যুবকদের! সেই চিন্তাই এখন কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে প্রতিটি পরিবারকে।