কথায় কথায় বেহাত ব‍্যক্তিগত তথ‍্য! সরকারের প্রতিশ্রুতি শুধুই ভাঁওতা? যে প্রশ্ন উঠে আসছে

Data Protection Bill: যে-দেশের প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হতে পারে, সে-দেশের সাধারণ মানুষের তথ্য কতটা সুরক্ষিত?

আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, আমাদের কাছে ‘গোপনীয়তা’ বা ‘তথ্য সুরক্ষা’ এই শব্দগুলোর কি কোনও তাৎপর্য আছে? আমরা কি আদৌ চিন্তিত, কীভাবে এবং কারা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংশ্লেষ করে আমাদেরই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ব্যবহার করছে? এই যে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা আমাদের ফোন করেন, কিভাবে তাঁরা আমাদের নম্বর পান, কীভাবে তাঁরা বোঝেন, আমাদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা? আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, আমরাই কি প্রাথমিকভাবে আমাদের গোপনীয়তার অধিকারে অন্যকে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দিইনি? বিভিন্ন জায়গায়, আমরা যে আমাদের ফোন নম্বর না চাইতেই দিয়ে থাকি, বিভিন্ন কেনাকাটার সময়ে আমাদের থেকে ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে যে আমাদের ফোন নম্বর নেওয়া হয়, এবং আমরাও যে আহ্লাদিত হয়ে তা দিয়েও দিই, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কি আমাদের গোপনীয়তা প্রথমেই লঙ্ঘিত হয় না? এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই বেশ কিছু বহুজাতিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

একজন ব্যক্তিমানুষকে যদি তাঁর নাম, লিঙ্গ, বয়স দিয়ে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে তা তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য, কিন্তু এই চিহ্নিতকরণের বিষয়গুলো সরিয়ে যদি কোনও একজন ব্যক্তির ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলোকে এক জায়গায় আনা যায়, তাহলে তাই হয়ে ওঠে বেনামি তথ্য। অনেক সময় একজন মানুষের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্য, তাঁর আর্থিক তথ্য কিংবা তাঁর জাত বা ধর্মবিষয়ক কোনও তথ্য বা আরও বেশ কিছু সংবেদনশীল বিষয়ের তথ্যাদি ও রাষ্ট্রের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

২০১৯ সালে যে তথ্য সুরক্ষা বিল পেশ হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, ইচ্ছে করলে সরকার ব্যক্তিগত তথ্য ছাড়াও বেশ কিছু সংবেদনশীল তথ্যও সংগ্রহ করতে পারে। শুধু তাই নয়, আরও বলা হয়েছিল, বিজ্ঞাপনদাতারা যাতে আরও নির্দিষ্টভাবে তাঁদের লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছতে পারেন, তাই তাঁদের সুবিধার্থে তাঁরাও এই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। এই সমস্ত তথ্য হয়তো একজন ব্যক্তিমানুষের কাছে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ না মনে হতে পারে, কিন্তু যাঁরা এই তথ্য হাতে পাবেন, তাঁদের কাছে এই তথ্য অত্যন্ত দামী। একটু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝা জরুরি। একজন ব্যক্তি তাঁর আধার নম্বর দিয়ে রেশনের ভরতুকি-যুক্ত চাল বা বিনামূল্যে চাল পাচ্ছেন, তাহলে কোনও শাসক দলের কাছে যদি এই তথ্য থাকে, কোন মোবাইল নম্বরের অধিকারী বিনামূল্যে রেশনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাচ্ছে, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে কে পাচ্ছেন না জানা গেলেও, নির্বাচনের সময়ে তাঁর কাছে কি সরকারের গুণগান গাওয়া বিজ্ঞাপনী বার্তা পাঠানো সম্ভব নয়? এই মুহূর্তে কথা চলছে, ভোটার কার্ডের সঙ্গে আধারের সংযোগের, তাহলে সরকারের কাছে যদি এই তথ্য থাকে, কোন আধার নম্বর এবং কোন ফোন নম্বর সরকারি কী কী সুবিধে নিয়েছে, তাহলে সেই ফোন নম্বর বা সেই ব্যক্তি বা পরিবারকে কি চিহ্নিত করা খুব কঠিন? সরকারি যে কোনও সুযোগসুবিধার সঙ্গে আধার যুক্ত করা হলে, এবং ভবিষ্যতে তা দিয়ে যদি নির্বাচন করানো বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে এই ধরনের নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও কলঙ্কবিহীন বলা যাবে?

আরও পড়ুন: ভারতেও কি বাধ্যতামূলক হবে ভোট দেওয়া! বোলসেনারোর হার সবক শেখাবে বিজেপিকে?

মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, বেশ কিছু তথ্যভান্ডার থেকে বহু মানুষের তথ্য চুরি হয়েছে, তারপর সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি যা বয়ান থাকে, তাতে বলা হয়, সবার তথ্য সুরক্ষিত আছে, কিন্তু আদৌ কি তা সুরক্ষিত থাকে? ভারতের আধারের ক্ষেত্রেও এই ধরনের অভিযোগ শোনা গেছে বহুবার। অনেকে বলে থাকেন, আধারের তথ্যভান্ডারে ডেমোগ্রাফিক তথ্য ও বায়োমেট্রিক তথ্য রাখা থাকে, যদি চুরিও হয়, তাহলেও শুধু ডেমোগ্রাফিক তথ্য, অর্থাৎ একজন মানুষের বহিরঙ্গের কিছু তথ্য চুরি গেলেও তাঁর বায়োমেট্রিক তথ্য, অর্থাৎ হাতের ছাপ, চোখের মণি এইজাতীয় তথ্য সুরক্ষিতই থাকে। কিন্তু শুধু ডেমোগ্রাফিক তথ্যই কি যথেষ্ট নয়, সেই মানুষটি সম্পর্কে জানার জন্য, কিংবা তাঁকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর জন্য?

তথ্য সুরক্ষার যে খসড়া বিল সাম্প্রতিক সময়ে আনা হয়েছে এবং নাগরিকদের মতামত চাওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, যদি এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে, তাহলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে জানাতে হবে, যাতে তাঁরা সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতেপারেন। অতীতে এই ধরনের কোনও ব্যবস্থা না থাকলেও, এই খসড়া বিলে এই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা আছে, কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকের কি এই সচেতনতা আছে, কীভাবে তাঁর তথ্যকে তিনি সুরক্ষিত রাখবেন? প্রথমত, যদি তিনি জানতেও পারেন, তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়েছে, তাহলে তিনি কার কাছে অভিযোগ করবেন, তা কি তিনি জানেন? যদি তাও জানেন, কী পদ্ধতিতে এই অভিযোগ করা হবে, তাঁকে মেল করতে হবে, না কি মৌখিকভাবে বা লিখিতভাবে এই অভিযোগ দায়ের করতে হবে, তা কি একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে জানলেও, করা সম্ভব?

যে-দেশের প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হতে পারে, সে-দেশের সাধারণ মানুষের তথ্য কতটা সুরক্ষিত, সেই প্রশ্ন করার কি সময় আসেনি? ভারতের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কি সবাই ইংরেজি ভাষায় এতটাই দক্ষ, যে তাঁরা সকলে ইংরেজিতে এই বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন? গুগলের নিজস্ব রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৯০ শতাংশ মানুষই নিজের মাতৃভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। দেখা গেছে, ৫ শতাংশরও কমসংখ্যক মহিলা সাধারণভাবে সামাজিক মাধ্যমে সড়গড় হলেও, ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং করেন। তাহলে কত শতাংশ মানুষ এই ‘তথ্য সুরক্ষা বিল'-এর খসড়ায় তাঁদের মতামত দিতে পারবেন? সরকার হয়তো ‘তথ্য সুরক্ষা’ বিল নিয়ে মতামত চাইছে, কিন্তু সেই মতামত কারা দেবেন, কীভাবেই বা দেবেন, তা নিয়ে কি সরকার চিন্তিত? না কি এই মতামত চাওয়াটাও একটা লোক দেখানো কাজ? আগামী ১৭ ডিসেম্বর অবধি এই মতামত চাওয়া হয়েছে, দিতে হবে mygov.in-এ, কিন্তু ভারতের ৭৬ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কতজনই বা জানেন, বা ইচ্ছুক এই বিষয়ে মত দিতে?

More Articles