দেড়শো বছর আগের সেই অক্টোবরে বাংলায় চলেছিল ধ্বংসলীলা! ফিরে দেখা সেই ভয়াবহ ইতিহাস

1864 Cyclone: বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং নথি থেকে আমরা ১৮৬৪ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানতে পারি।

আয়লা, আমফান। বাংলার মানুষের কাছে খুব পরিচিত এবং কিছু ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসা দু'টি নাম। যদিও এই প্রথম নয়, আজ থেকে প্রায় দুই শতক আগেও এইরকম এক ঘূর্ণিঝড় বাংলার মানুষের জন্য দুঃসংবাদ হয়ে চারদিক তছনছ করে বয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং নথি থেকে আমরা ১৮৬৪ সালের সেই ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানতে পারি।

১৮৬৪ সালের এই ঘূর্ণিঝড়ের সূচনার কথা এক জাহাজের নথি থেকে জানা যায়। আন্দামানের পশ্চিমে অবস্থানরত সেই জাহাজের নাবিকরা প্রথম বিরূপ আবহাওয়ার কথা নথিবদ্ধ করেছিল। ১ অক্টোবর, ১৮৬৪ সালের আবহাওয়া সম্পর্কে লেখা হয়েছিল যে, অন্ধকার আকাশ, ঝোড়ো হাওয়া এবং বৃষ্টি চলছে। অক্টোবরের দুই এবং তিন তারিখ কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করা জাহাজ ওয়েফেয়ারার দমকা হাওয়া এবং প্রবল বৃষ্টির কবলে পড়েছিল। অক্টোবরের চার তারিখ থেকে কলকাতা এবং তার নিকটস্থ উপকূলবর্তী এলাকায় প্রবল ঝড় এবং দফায় দফায় বৃষ্টি শুরু হয়। অবিভক্ত বাংলায় বহু এলাকায় সেই সময়ে কলের এবং অন্যান্য জলবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু মানুষ সেই সময়ে আক্রান্ত ছিলেন। তারই মধ্যে অক্টোবরের পাঁচ তারিখ ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে।

সেই সময়ের বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায় যে, অক্টোবরের পাঁচ তারিখ ভোর তিনটের সময় কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় হাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে এক থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এই থমথমে পরিবেশ প্রায় একঘণ্টা বজায় ছিল। তারপর হঠাৎ দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। সকাল প্রায় দশটা অবধি এই পরিবেশ বজায় থাকলেও হঠাৎ বৃষ্টি এবং দমকা হাওয়ার জোর কমে এসেছিল। প্রায় আধঘণ্টা কিছুটা শান্ত পরিস্থিতি বজায় থাকার পর আগের থেকেও জোরে ঝোড়ো হওয়া বইতে শুরু করেছিল। তার সঙ্গে শুরু হয়েছিল প্রবল বৃষ্টি। সকাল আন্দাজ সাড়ে দশটার পরে এই ঝোড়ো হাওয়া এবং প্রবল বৃষ্টির পরে বিভিন্ন নদী এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় জলরাশি উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কথিত আছে যে, ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগে প্রবেশ করার পরে বিভিন্ন নদীতে প্রবল জলোচ্ছাস দেখা গিয়েছিল। কোথাও সেই জলোচ্ছাসের উচ্চতা ছিল তেরো ফুট আবার কোথাও প্রায় চল্লিশ ফুট। দুপুর আন্দাজ তিনটের পর সেই প্রবল ঝোড়ো হাওয়া দিক পরিবর্তন করে বইতে শুরু করেছিল। বিকেল পাঁচটা অবধি এই পরিস্থিতি বজায় থাকার পরে আবহাওয়ার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। খেজুরির কাছে অবস্থিত এক লাইটহাউসের নথি থেকে জানা যায় যে, বিকেল পাঁচটার পরে আবহাওয়ার উন্নতি হলে সেই বাতিঘরের কর্মীরা দেখতে পান, বাতিঘরের চারদিকে কোমরসমান জল জমে রয়েছে।

আরও পড়ুন: ৫১ বছর আগে যে ঘূর্ণিঝড় জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশের

১৮৬৪ সালের অক্টোবর মাসের সেই ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডবলীলা চালিয়ে চলে যাওয়ার পর তার ধ্বংসের হিসে‌ব পাওয়া যায়। সরকারি মতে মোট ৯৯,২০০ টাকার সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলে ডুবে, বাড়ি চাপা পড়ে, গাছ চাপা পড়ে এবং পরবর্তীকালে জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ষাট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার আগে ঝড়-বৃষ্টির ফলে বহু মানুষ নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে প্রবল হাওয়া এবং জলোচ্ছাসের জোড়া আঘাত বহু বাড়ি সহ্য করতে পারেনি। ঘুর্ণিঝড়ের সময় বিভিন্ন বড় গাছ উপড়ে বাড়ির ওপরে পড়েছিল। খড় এবং টালির চালের পক্ষে সেই আঘাত সামলানো সম্ভব ছিল না।

এইসব কারণে বহু মানুষের কাছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল তাদের মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছিল। তাই বহু মানুষ বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। খেজুরি এবং হিজলী বন্দর সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। নদী এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় বহু নৌকা এবং জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ডুবে গিয়েছিল। বহু গবাদি পশু এই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে মারা গিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য একটি তহবিল তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কথিত আছে যে, এই ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তীকালে ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত হিসেব করতে গিয়ে এক কৃষককে ফসলের ক্ষতি-সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হয়েছিল। তার উত্তরে কৃষক বলেছিল যে, ফসল খাওয়ার জন্য আর কে-ই বা রইল? সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে এই ভয়ানক স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে গেলেও ইতিহাসের কিছু নথিতে সেই ক্ষতচিহ্ন যেন আজও টাটকা হয়ে রয়েছে।

More Articles