টেনে হিঁচড়ে তরুণীকে নিয়ে গেল গাড়ি, রক্তে ভাসল রাস্তা, দিল্লিতে নারী সুরক্ষা এখনও বিশ বাঁও জলে?

Delhi Woman Car Accident : কিন্তু ২০২৩-এর প্রথম দিনেই এমন ঘটনা বুঝিয়ে দিল, এখনও অবস্থা ফেরেনি। নারী সুরক্ষা এখনও বিশ বাঁও জলে।

তখন সবেমাত্র নতুন বছরের আতসবাজি জ্বালানো শেষ হয়েছে। ডিজে ও অন্যান্য গানও থেমেছে, নৈশযাপনে যারা বেরিয়েছিলেন তাঁরাও একটু একটু করে ঘরে ফিরছেন। ভোর রাত ৩টে পেরিয়ে গিয়েছে। হঠাৎই একটি গাড়ির দিকে চোখ গেল। গাঢ় ছাই রঙের গাড়িটা যে একটু জোরেই আসছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। সামনেই বড় রাস্তা এপার ওপার করার জায়গা। সেখান থেকেই ইউ টার্ন নিল চারচাকার গাড়িটি। তখনই দেখা গেল বীভৎস এক দৃশ্য। কয়েক সেকেন্ড আগেও যা কেউ কল্পনা করতে পারেননি। দেখা গেল, গাড়িটির ঠিক নিচে আটকে রয়েছেন এক যুবতী। গাড়ির চাকায় আটকে গিয়েছে তাঁর শরীর। সেই অবস্থাতেই চারচাকা গাড়িটি তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে যে অল্প কয়েকজন জেগেছিলেন, তাঁরা চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু গাড়ির ভেতরে থাকা আরোহীদের কোনও হেলদোল নেই।

নতুন বছরের শুরুতেই এমন ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী থাকল দেশের রাজধানী দিল্লি। সুলতানপুরী এলাকায় ১ জানুয়ারির ভোরেই দুর্ঘটনার শিকার হন এক যুবতী। নববর্ষের ভোর রাতে স্কুটারে করে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎই একটি চারচাকা গাড়ি তাঁকে ধাক্কা মারে। তারপরের ঘটনার সামান্য বিবরণ তো দেওয়াই হল। গাড়ির নিচে আটকে থাকা অবস্থাতেই ওই তরুণীকে প্রায় ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায় গাড়ির আরোহীরা। শেষমেশ অবশ্য কাঞ্ঝাওয়ালা রোডের ওপরই তরুণীর নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। গাড়ির নম্বর দেখে ওই গাড়ির পাঁচ আরোহীকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

কিন্তু এটুকুতেই থেমে নেই এই ঘটনা। বর্ষবরণের ভোরে এমন একটি ঘটনা কার্যত নাড়িয়ে দিয়েছে দিল্লিকে। দুর্ঘটনা ঘটার পরও কী করে টের পেল না ওই পাঁচজন? এমনকী তাদের গাড়ির নিচে ওই তরুণী আটকে রয়েছে, সেটাও বুঝতে পারেনি তারা! তাহলে কি চূড়ান্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল ওই পাঁচজন? দিল্লির মহিলা কমিশন এই সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে না। পুলিসও তাই মনে করছে। কিন্তু সেইসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসছে। আদৌ কি এটি ‘দুর্ঘটনা’?

সম্প্রতি সামনে এসেছে ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ। সেইসঙ্গে অভিযুক্তদের বয়ানেও অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। প্রথমে ওই পাঁচজনই বলেছিল, তারা নাকি কেউই দুর্ঘটনার কথা বুঝতে পারেনি। কিন্তু পরে আবার বয়ান বদল করে বলে, প্রথমদিকে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। পরে বুঝতে পেরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তরুণীর দেহ গাড়ি থেকে ছাড়িয়ে দেয়। তারপর তড়িঘড়ি গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয়। পুলিসি তদন্ত এখনও জারি রয়েছে।

কিন্তু এখানেই সামনে এসেছে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান। দীপক দাহিয়া নামের এক ব্যক্তি ওই সময় কাঞ্ঝাওয়ালা রোডে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাঁর নিজস্ব দোকান রয়েছে। তিনি ওইদিনের বীভৎস ঘটনার বয়ান দেন। সোয়া তিনটের সময় হঠাৎই দীপক দাহিয়া একটি বিকট আওয়াজ পান। প্রথমে ভেবেছিলেন, টায়ার ফাটার আওয়াজ। পরে দেখেন, বেশ জোরেই একটি চারচাকা গাড়ি রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে। আর ওই গাড়িটির তলায় আটকে রয়েছেন ওই তরুণী। দীপকের বক্তব্য, তিনি গাড়ির চালকদের বারবার ডাকলেও কোনও সাড়া মেলেনি।

খানিকটা এগিয়ে চারচাকা গাড়িটি ইউ টার্ন নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে আসে। এভাবে বেশ কয়েকবার একই জায়গা দিয়ে ইউ টার্ন নেয় গাড়িটি। তখনও ওই তরুণী গাড়ির নিচে আটকে। দীপক দাহিয়াই প্রথম পুলিসকে ফোন করে খবর দেন। তারপর নিজেই বাইক নিয়ে গাড়িটির পিছনে ধাওয়া করেন। বেশ কিছুটা এগোনোর পর দেখা যায়, গাড়িটি চম্পট দিয়েছে। আর রাস্তার মধ্যে পড়ে রয়েছে তরুণীর রক্তাক্ত দেহ।

এখানেই বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে। দীপক দাহিয়া বারবার বলছেন, গাড়িটির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল না এটি কোনও সামান্য অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা। বরং তাঁর দাবি, ঠাণ্ডা মাথায় এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে! মৃতার মাও বলছেন, যদি দুর্ঘটনা হয়, তাহলে মেয়ের কাপড়ের এমন অবস্থা হল কী করে? উল্লেখ্য, রাস্তা থেকে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় তরুণীর দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অবশ্য পুলিসের বক্তব্য, তরুণীর জামাকাপড় সত্যিই ছিঁড়ে গিয়েছে। দেহেও অনেক জায়গায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু সেগুলো এই দুর্ঘটনার কারণেও হতে পারে। তবে খুন কিনা, সেটাও তদন্ত করে দেখছে পুলিস।

কিন্তু কেন বারবার অপরাধের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠছে দিল্লি? বিশেষ করে মেয়েরা কি একেবারেই সুরক্ষিত নয় রাজধানীতে? নির্ভয়া থেকে শ্রদ্ধা ওয়ালকর – ঘটনা পরম্পরা অব্যাহত। সেই তালিকায় যোগ হল আরও একটি মর্মান্তিক মৃত্যু। দিল্লিবাসীদের প্রশ্ন, নববর্ষের মুহূর্তে বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের ঘটনা হামেশাই ঘটে। তাহলে পুলিস কেন বাড়তি নজরদারির বন্দোবস্ত করল না? পথ নিরাপত্তা কি তাহলে শূন্যের খাতায় নেমে এসেছে? আদৌ দিল্লির ওই অংশে পুলিসের নজরদারি ছিল? নারী সুরক্ষা নিয়ে বারবার আন্দোলন হয়। মোমবাতি মিছিল থেকে বিভিন্ন রকমের প্রতিবাদে মুখর হয় রাজধানী। কিন্তু ২০২৩-এর প্রথম দিনেই এমন ঘটনা বুঝিয়ে দিল, এখনও অবস্থা ফেরেনি। নারী সুরক্ষা এখনও বিশ বাঁও জলে। এমনটাই বলছেন দিল্লিবাসীরা। ফের প্রতিবাদ উঠেছে, কিন্তু সুরক্ষা কি তাতে মজবুত হবে? 

More Articles