জ্যামে জেরবার জীবন, মেট্রোতেই মুক্তির স্বাদ পেতে দিন গুণছেন ঢাকাবাসী

Dhaka Metro: ঢাকার যানজট যাচ্ছেতাই, একেবারেই বিশৃঙ্খল অবস্থা।  যানজট ও অতিরিক্ত যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় শহরের আবহাওয়াও মারাত্মকভাবে দূষিত। এই কারণেই বাংলাদেশ মুক্তি খুঁজছে মেট্রোপথে।

পদ্মা সেতুর পর অচিরেই বাংলাদেশের আর একটি স্বপ্নপূরণের সামনে দাঁড়িয়ে – আর সেটি হল ঢাকায় মেট্রো রেল।

রাজধানী ঢাকার ২০ বছরের দীর্ঘ পরিবহণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়াস অবশেষে প্রত্যক্ষ করতে চলেছে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের প্রথম মেট্রো রেল ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ৫১ তম বার্ষিকীতে রাজধানীর উত্তরা-আগারগাও সেকশনে চালু হতে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ থেকে ২০১০ সালে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার ওপর জরিপ পরিচালনা ও অধ্যায়নের জন্য জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) কে আমন্ত্রণ জানায়। এবং সেখান থেকে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেড (ডি এম টি সি) প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয় যা ২০১৩ সালের জুনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।


২০১২ সালে, সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নিবাহী কমিটি (ই সি এন ই সি) প্রকল্পটি অনুমোদন করে। বাংলাদেশ সরকার এবং জাইকা ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০২২ সালের হিসাবে, মেট্রো রেল ব্যবস্থায় একটি লাইন রয়েছে যা এমআরটি(ম্যাস রাপিড ট্রানজিট) লাইন-৬ প্রথম পর্ব হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, লাইন-৬ দ্বিতীয় পর্বের সাথে ভবিষ্যতে ৭টি অন্যান্য মেট্রো রেল লাইন যুক্ত করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ অগাস্ট ২০২২ মঙ্গলবার শেরে-বাংলা নগরে এনইসি মিলনায়তনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বক্তৃতাকালে বলেন, ঢাকা মেট্রো রেলের মালিকানাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পর তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যাবে।

কেমন হবে পরিষেবা

ঢাকা মেট্রো প্রতি ঘণ্টায় ৬০,০০০ এরও বেশি যাত্রীকে আনুমানিক ৪ মিনিট অপেক্ষার সময় দিয়ে পরিষেবা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লাইন-৬-এ ১৬টি এলিভেটেড স্টেশন রয়েছে যার প্রতিটি ১৭০ মিটার দীর্ঘ এবং ২০.১ কিলোমিটার বিদ্যুৎ-চালিত হালকা রেল ট্র্যাক রয়েছে। পুরো রুটটি ১০০ কিলমিটার/ঘণ্টা গতিতে ৪০ মিনিটেরও কম সময়ে ভ্রমণ করতে সক্ষম হবে। এতে ঢাকার রাস্তায় প্রাইভেট কারের সংখ্যা এবং তাদের সম্ভাব্য ৭ ঘণ্টা দীর্ঘ স্থবিরতা ব্যাপকভাবে হাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মোট রুটের সংখ্যা

সিস্টেমটি স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছে। যদি মেট্রো রুটের কথা বলা হয় তাহলে মোট ৮টি রুট রয়েছে যার মধ্যে এমআরটি-১ (বিমানবন্দর রুট), এমআরটি-১(পূর্বাচল রুট), এমআরটি-২, এমআরটি-৪, এমআরটি- ৫(উত্তর রুট), এমআরটি-৫(দক্ষিন রুট), এমআরটি-৬ ফেজ ওয়ান এবং এমআরটি- ৬ ফেজ টু রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার এমআরটি- ১(বিমানবন্দর রুট) হবে ১৯.৮৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ লাইন।শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে থামবে। লাইনে ১২টি ভূগর্ভস্থ স্টেশন থাকবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনাল ৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল পূর্ব, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর রেল স্টেশন ঘিরে নির্মাণ করা হবে এমআরটি-১ বিমানবন্দর রুট। এমআরটি-১ (পূর্বাচল রুট) হবে ১১.৩৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এতে থাকবে নতুন বাজার, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসারস হাউজিং সোসাইটি, মাস্তুল, পূর্বাচল পশ্চিম, পূর্বাচল কেন্দ্র, পূর্বাচল সেক্টর-৭ এবং পূর্বাচল ডিপো।

এসব স্টেশন এর মধ্যে বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসেবে নতুন বাজার ও যমুনা ফিউচার পার্ক ভূগর্ভস্থ হবে। এমআরটি-২ বসিলা, ঝিগাতলা, সায়েন্স ল্যাব, আজিমপুর, শহীদ মিনার, গোলাপ শাহ মাজার, মতিঝিল, মুগদা এবং ডেমরা হয়ে গাবতলিকে চট্রগ্রাম রোডের সাথে সংযুক্ত করবে। এই লাইনের দৈর্ঘ্য হবে ২৪ কিলোমিটার। ১৬ কিলোমিটার লম্বা এমআরটি লাইন-৪ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনকে সংযুক্ত করবে নারায়ণগঞ্জের সাথে।

এমআরটি লাইন-৫(উত্তর রুট) সাভার উপজেলার হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে ভাটারায় শেষ হবে। উত্তর রুটটি ১৩.৫ কিলোমিটার ভুগভস্থ এবং ৬.৫ কিলোমিটার উঁচু হবে। এতে ১৪টি স্টেশন থাকবে যার মধ্যে ৯টি স্টেশন হবে আন্ডারগ্রাউনড। এমআরটি- ৫(দক্ষিণ রুট) প্রায় ১৭.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি গাবতলি থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত বিস্তৃত। এমআরটি লাইন-৬ এর দুইটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম ধাপে উত্তরা থেকে শুরু হয়ে আগারগাওয়ে শেষ হবে নয়টি স্টেশন। এর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১১.৭৩ কিলোমিটার। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে আগারগাও থেকে এবং শেষ হবে মতিঝিলে। এটি ৮.৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এবং এতে থাকবে সাতটি স্টেশন।

ছয় বছরের শ্রম

২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার জাপান ইন্টারন্যাশনাল ক-অপারেশন এজেন্সির সঙ্গে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে স্বাক্ষর করে। ২৬ জুন ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপত্তিতে একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

শহিদদের প্রতি উৎসর্গ

ছয় বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে ঢাকার গুলশানের ক্যাফের নিশংস হামলার ঘটনা। হলি আরটিসান বেকারি অ্যান্ড ক্যাফেতে ১ জুলাই,২০১৬ সালে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে ১৭ বিদেশি-সহ ২৩ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তদন্তে দেখা গেছে, হামলাকারীরা ৬ মাস ধরে এই হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের দুইটি লক্ষ্য ছিলঃ বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বাংলাদেশ সরকার ঢাকা ম্যাস রাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ এ একটি তথ্য কেন্দ্র উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেইসব জাপানি নাগরিকদের জন্য যারা মেট্রো রেলের কাজে জড়িত ছিলেন এবং ১ জুলাই,২০১৬ সালের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন।

কত খরচ

১৫,৮৫৬.৮০ কোটি টাকার মেট্রো রেলের সামগ্রিক প্রাক্কলিত ব্যায়ের ৮টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। অনুমোদিত ৮টি প্রকল্পের মধ্যে ৪টি নতুন এবং ৪টি সংশোধিত প্রকল্প। মোট প্রকল্প ব্যায়ের মধ্যে ১২,৪৪৪.২৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে, ১৩৪.৫৭ কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজিশও তহবিল থেকে এবং বাকি ৩,২৭৭.৯৮ কোটি টাকা প্রকল্প সহয়তা হিসাবে আসবে। এমনটাই জানিয়েছেন  বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্য বলছে, এমআরটি লাইন-৬-এর সার্বিক অগ্রগতি ৮১.৭০ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ে নির্ধারিত উত্তরা থেকে আগারগাঁও রুটে কাজের অগ্রগতি ৯৩.৮৬ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্ধারিত আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৮১.৮৬ শতাংশ এবং বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮৩.৩৪ শতাংশ।

ঢাকা মেট্রোর জন্য রেলওয়ে কোচ, ইঞ্জিন এবং বক্স মেশিনারি সহ অত্যাধুনিক পণ্য গুলো জাপানের কোবে বন্দর থেকে জাহাজে করে বিভিন্ন সময়ে এখন পর্যন্ত এগারোবার বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে চালান এসে পৌঁছেছে ।

২৯ আগস্ট,২০২১ সালে প্রথম মেট্রো ট্রায়াল রান চালানো হয় রাজধানীর দিয়া বাড়ি থেকে উত্তরা পর্যন্ত। এখন প্রতিদিনই ট্রেনের পারফরম্যান্স টেস্ট চলছে। মেট্রো রেলের যাত্রী পরিবহনে শেষ ধাপের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হতে যাচ্ছে ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২।

ঢাকা মাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক জানান, ইন্টিগ্রেশন ট্রায়াল রান বা সমন্বিত পরীক্ষামূলক চলাচল সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন থেকে শুরু হবে। তিনি আরো বলেন,

‘প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হবে, সেই পর্বে চলবে ১০টি ট্রেন। প্রথম দিন ১০ মিনিট পর পর ট্রেন চলাচল করবে। দ্বিতীয় দিন হয়তো সাত মিনিটে নামিয়ে আনা হবে। ক্রমান্বয়ে যাত্রীর চাপের ওপর নির্ভর করবে কতক্ষণ পর পর ট্রেন ছাড়া হবে।’

‘আমি ঢাকায় ছিলাম, মানে আমি যানজটে আটকে ছিলাম। কথাটি আরও সঠিকভাবে অন্যভাবেও বলা যেতে পারেঃ আমি যানজটে আটকে ছিলাম, তাই আমি ঢাকায় ছিলাম।’

এমনটাই লিখে ব্যঙ্গাত্মকভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে ঢাকার ট্রাফিক নিয়ে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ট্রাফিক একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। ঢাকার যানজট যাচ্ছেতাই, একেবারেই বিশৃঙ্খল অবস্থা।  যানজট ও অতিরিক্ত যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় শহরের আবহাওয়াও মারাত্মকভাবে দূষিত। এই কারণেই বাংলাদেশ মুক্তি খুঁজছে মেট্রোপথে।

সমীক্ষা বলছে ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম প্রতিদিন ৩.২ মিলিয়ন কাজের সময় নষ্ট করে। এবং এর ফলেই শহরের অর্থনীতি প্রতি বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে যায়। ট্রাফিক ইনডেক্স ২০২২ সাল এর অনুযায়ী ২৪১টি শহরের মধ্যে ঢাকা ৭ নম্বরে। ঢাকার যানজট থেকে নির্গত ধোঁয়া ঢাকা শহরের বায়ু দূষণেরও প্রধান কারণ। বায়ুর গুণমান সূচকে ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় দুষিত শহরের স্থান পেয়েছে। যার ফলে ঢাকাবাসী সুস্বাস্থ্যতা ও প্রতিদিনের সাধারণ জীবনযাপনে দীর্ঘ সময় ধরে চরমভাবে ভোগান্তির স্বীকার।

আর এ সকল সমস্যা কাটিয়ে উঠতে মেট্রো রেলকেই ইতিবাচক সমাধান হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের জনগণ।

More Articles