রবীন্দ্রনাথের নামে ডাইনোসর রয়েছে খাস কলকাতায়! দেখে আসতে পারেন স্বচক্ষে

Rabindranath Tagore Dinosaur: বন্যা বা ওই জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তীব্র জলের তোড়ে ভেসে গিয়ে বেচারা প্রকাণ্ড ডাইনোসোর সম্ভবত মারা যায়

কবিগুরু স্যানিটারি স্টোর। কবিগুরু শু হাউজ, রবিঠাকুর স্পেশ্যাল চাট, বিশ্বকবি পোলট্রিফার্ম। শান্তিনিকেতনপ্রেমী বঙ্গবাসী মাত্রই জানেন, একটা নামও মস্করা নয়। এমন দোকান, ঠেলা হামেশাই চোখে পড়বে শান্তিনিকেতনে ঢোকামাত্রই। শান্তিনিকেতন না হলেও চলবে, বাঙালি সংস্কৃতি ভালোবেসে, ঐতিহ্যবাহী কোনও প্রবাসী দেশে বা বিদেশেও খুলে বসতে পারেন কবিগুরু এফ এল শপ। ভালোবাসার অত্যাচার আর কী, শ্রদ্ধা বড়ই বিষম বস্তু। তবে এসব হার্ডওয়্যার, পোলট্রিফার্মের বাইরেও কবিগুরুর নামে যে ঠিক কীসের কীসের নামকরণ হয়েছে জানলে তাজ্জব হতে হয়। খাস কলকাতা শহরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রয়েছে এক ডাইনোসর! মানে এককালে সে ডাইনোসরই ছিল, এখন কালের প্রবাহে জীবাশ্ম! বিশালাকার এক ডাইনোসোরের জীবাশ্মের নামকরণ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নামে, ‘বরাপাসোউরাস টেগোরেই’!

কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের মিউজিয়ামের জিওলজি বিভাগের ঘরে সযত্নে রাখা আছে এই জীবাশ্মটি। ডাইনোসরের সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথের সময়ও কোনও ডাইনোসর ছিল না। কোনও ডাইনোসরই সাহিত্য বা দর্শন চর্চা করেনি, রবীন্দ্রনাথও ডাইনোদের নিয়ে সাহিত্য রচনা করেননি। তাহলে এত কিছু ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে কেন নামকরণ হলো এই ডাইনোসরের? দেখা যাক ইতিহাস ঘেঁটে।

আরও পড়ুন- বাড়িতে পোষেন ডাইনোসর! জ্যোতির্ময় দত্তকে নিয়ে এমনই বিশ্বাস অনেকের

সাল ১৯৩১-৩২। বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উদ্যোগে বরানগরে প্রতিষ্ঠিত হলো ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট। রাশিবিজ্ঞানের পাশাপাশি ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব নিয়েও গবেষণা চলত এই কেন্দ্রে। ডাইনোসর বিষয়টি নিয়ে মাতামাতি ও চর্চা দুই-ই শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জুরাসিক যুগ নিয়ে গবেষণা শুরু করে সেই সময়। ১৯৫৭ সালে গবেষক-অধ্যাপক পামেলা লামপ্লাউ রবিনসনকে আমন্ত্রণ করেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে পামেলা রবিনস, এলেক স্মিথ প্রমুখ গবেষক ভারতে আসেন ডাইনোসোরের খোঁজে। স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটও যুক্ত হয় সেই গবেষণায়। স্টাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে গবেষণায় যোগ দেন বি রায়চৌধুরী, এস এল জৈন, তপনকুমার চৌধুরীর মতো গবেষকরা। তবে কলকাতায় নয়, দক্ষিণ ভারতে চলতে থাকে ডাইনোসরের সন্ধান। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি এবং স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট মিলে অধুনা তেলঙ্গানার নালগোন্ডায় গোদাবরী নদী উপত্যকায় খনন শুরু করে।

বছরে ঘুরতে না ঘুরতেই, ১৯৫৮ সালে গোদাবরী উপত্যকা অঞ্চলের পোচামপল্লি গ্রাম লাগোয়া অঞ্চল থেকে পাওয়া যায় বেশ কিছু বিশালাকার জীবের পায়ের হাড়ের জীবাশ্ম। দক্ষিণ ভারত হলেও ওই অঞ্চলে খননের কাজে নিযুক্ত ছিলেন হিন্দিভাষী শ্রমিকরাই। ফলে পশুর বড় বড় পা হয়ে গেল 'বড়া পা'। জীবাশ্মগুলিকে ডাকা হতে থাকে ওই নামেই। আরও খোঁড়াখুঁড়ির পর প্রায় তিনশোর মতো হাড়ের জীবাশ্ম মেলে। সেই সমস্ত জীবাশ্ম পরীক্ষা করে গবেষকরা জানান, সরীসৃপ গোত্রের এক নতুন ধরনের ডাইনোসোরের জীবাশ্ম সেটি। ‘বড়া পা’ এবং তার সঙ্গে গিরগিটি বা লিজার্ডের গ্রিক প্রতিশব্দ ‘সোউরাস’ মিলিয়ে প্রারম্ভিক জুরাসিক যুগের ওই ডাইনোসোরের গোত্রের নামকরণ হয় ‘বরাপাসোউরাস’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কই?

আরও পড়ুন- ক্রিকেটার কবিগুরু! যে রবীন্দ্রনাথকে আজও চেনেই না বাঙালি

কয়েক টন ওজনের সেই জীবাশ্মগুলি নিয়ে আসা হয় কলকাতায় স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে। বছরখানেক ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সেই টুকরোগুলিকে জোড়ার কাজ শুরু হয়। সেই জীবাশ্মের টুকরো জুড়ে জুড়ে প্রাণীটি আসলে কেমন দেখতে ছিল, তার একটা আনুমানিক চেহারা দেওয়া হয়েছে। বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের সংগ্রহশালার জিওলজি বিভাগের ঘরে সাজানো রয়েছে ভারতের মাটি থেকে পাওয়া প্রথম ডাইনোসোরের কঙ্কাল! ঘাড় থেকে ল্যাজের ডগা পর্যন্ত এই ডাইনোর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৬ ফুট! তবে বেচারা মুণ্ডহীন। বন্যা বা ওই জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তীব্র জলের তোড়ে ভেসে গিয়ে বেচারা প্রকাণ্ড ডাইনোসোর সম্ভবত মারা যায় এবং মুণ্ডু ভেসে চলে যায় অন্যত্র। পরে সংস্থার অনুরোধে বিদেশ থেকে একটি মাথা উপহার হিসেবে আসে। ডাইনো একটি কৃত্রিম মাথা পায়!

ডাইনোসরের গোত্র না হয় ঠিক হলো, বারাপাসোউরাস। কিন্তু কোন প্রজাতির ডাইনো এটি? যে বছর এইসব কর্মকাণ্ড চলছে সেই ১৯৬১ সালটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রস্তাব দিলেন, কবিগুরুকে সম্মান জানিয়েই ডাইনোসরের নাম দেওয়া হোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদবির ইংরেজি উচ্চারণ টেগোর অনুসারে ডাইনোসোরের প্রজাতির নাম দেওয়া হলো ‘টেগোরাই’। ডাইনোসোরের নাম হলো ‘বরাপাসোউরাস টেগোরেই’। বরাহনগরের এই ক্যাম্পাসে কয়েক বার এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। প্রশান্তচন্দ্র এবং রানি মহালানবিশের বিয়ের সময় রবীন্দ্রনাথ যে আশীর্বাদী লিখে দিয়েছিলেন, এখানকার সংগ্রহশালায় এলে ডাইনোসরের পাশাপাশি দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের সেই লেখাটিও।

More Articles