শেষবেলায় মমতার মুখে কেন এনআরসি?
Eid 2024: এদিন ইদের মঞ্চ থেকে মমতার মুখে শোনা যায় বিজেপি বিরোধিতার ডাক। মঞ্চ থেকে তিনি বলেন, “বাংলায় আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছি। একটা ভোটও অন্য কাউকে দেবেন না।”
লোকসভা ভোটের আর দেরি নেই। ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জোরদার প্রচার। সকলেই সকলের মতো করে প্রচারে ব্যস্ত। আর এই লোকসভা ভোটের মরসুমে ইদ। ভোটের আগে আগেই সিএএ কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। যা নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দেশের বড় অংশ। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে বৃহস্পতিবার ইদের সকালে রেড রোডে নমাজের অনুষ্ঠানে যোগ দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে লোকসভার ভোটগ্রহণ। প্রথম দফায় উত্তরবঙ্গে ভোট রয়েছে বাংলার। ফলে দক্ষিণবঙ্গে জেলা ও শহরাঞ্চলে এখনও বেশ কিছুদিন প্রচারের সুযোগ পাবেন প্রার্থীরা। এর মধ্যেই পড়েছে ইদ। রমজান মাস শুরু হওয়ার মুখে মুখেই দেশ জুড়ে সিএএ কার্যকর করার কথা ঘোষণা করে দিয়েছিল বিজেপি সরকার। গোড়া থেকেই বিজেপির সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-র বিরোধী এ রাজ্যের তৃণমূল।
এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ আনেন অনেকেই। এ দিকে বিজেপির মূল শক্তি হিন্দুত্ববাদ। এই পরিস্থিতিতে ভোটের আগে ইদের মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে যে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে চলেছে সেই সিএএ ইস্যু, তা খানিকটা প্রত্যাশিতই ছিল। এ রাজ্যে তৃণমূল ভোটের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সংখ্যালঘু ভোট। তাদের দিকে তাকিয়েই এদিন ইদের মঞ্চ থেকে শোনা যায় বিজেপি বিরোধিতার ডাক। মঞ্চ থেকে তিনি বলেন, “বাংলায় আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছি। একটা ভোটও অন্য কাউকে দেবেন না।” বৃহস্পতিবার রেড রোডে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোট এবং ইদের মরসুমকে সামনে রেখে সংক্ষীপ্ত বক্তৃতা দেন তিনিও।
২০২৪ সালে লোকসভা ভোট হতে চলেছে, এ কথাটা কারওরই অজানিত ছিল না। নতুন বছর পড়তে না পড়তেই সিএএ ধুয়ো তুলেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। যতবার তিনি বাংলায় এসেছেন, প্রতিবার সিএএ ঘোষণার ভবিষ্যদ্বাণী শোনা গিয়েছে শাহের মুখে। গত বুধবার বালুরঘাটে জনসভায় উপস্থিত হয়ে অমিত শাহ অবশ্য বলে বসেন, সিএএ নিয়ে রাজ্যবাসীকে ভয় দেখাচ্ছেন আসলে মমতা। বলেন, ‘হাতজোড় করে বাংলার জনতাকে বলতে চাই, মমতা দিদি বাংলার লোকেদের বোকা বানাচ্ছেন। আমি বলতে চাই, ভয় না পেয়ে যত শরণার্থী এসেছেন, তাঁরা যেন নাগরিকত্বের আবেদন করেন। কারও নাম বাদ যাবে না।’’
আরও পড়ুন: ডায়মন্ড হারবারে নৌশাদের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’-র জবাব দিতে পারবেন বামেদের লড়াকু প্রতীক উর?
তক্কে তক্কে ছিল তৃণমূলও। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মত, বৃহস্পতিবার রেড রোডের মঞ্চ থেকে শাহের সেই আক্রমণেরই জবাব দিলেন মমতা। এ রাজ্যের একাধিক জেলা মুসলিম অধ্যুষিত। ফলে সেই সব জেলা থেকে তৃণমূলের ভোট পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশ বেশি। আর সেই সব জায়গার ভোটারদের বার্তা দেওয়ার জন্য ইদের মঞ্চের থেকে ভালো জায়গা আর কী-ই বা হতে পারত। বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ মনে করছে, ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগে আলাদা করে বিশেষ স্টান্ট দেখানোর প্রয়োজন হয়নি বিজেপির। গোড়া থেকেই এই ভোট নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী গেরুয়া শিবির। হবে না-ই বা কেন! ২০২৩ সালটাকে যে সম্পূর্ণ ভাবে রামমন্দির গড়ার পিছনে নিয়োগ করেছিল বিজেপি। স্বাভাবিক ভাবেই বিতর্কিত বাবরি মসজিদের জাগয়ায় গড়ে ওঠা রামমন্দির নিয়ে আলোচনা যে সব স্তরে হবে, তা-ই ছিল সর্বোত ভাবে প্রত্যাশিত।
তবে উত্তর বা পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের যেমন প্রতাপ, তা কোনও দিনই বাংলায় তেমন ভাবে ছিল না। ফলে বাংলার মাটিতে সংখ্যালঘু ভোট বিরাট এক গেম চেঞ্জার। মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর-সহ একাধিক কেন্দ্রে সেই ছাপটাই স্পষ্ট। এমনকী যে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র নিয়ে এত হইচই, তারও কিন্তু একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সংখ্যালঘু ভোট।
বৃহস্পতিবার পরবের মঞ্চ থেকে বক্তব্যের শুরুতেই ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানান মমতা। বলেন, “আপনারা এককাট্টা থাকলে কেউ আলাদা করতে পারবে না।” প্রথমে বিজেপির নাম না করেই তিনি বলেন, “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) আনছে। আমরা ঘৃণাভাষণ চাই না, এনআরসি চাই না, সিএএ চাই না। আমাদের লক্ষ্য সর্বধর্ম সমন্বয়।” সিএএ প্রসঙ্গ তুলে বিজেপির উদ্দেশে মমতার প্রশ্ন, “আমরা নাগরিক না হলে কাদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন?”
সিএএ লাগু হল এ রাজ্যে সর্বৈব ভাবে বিপদে পড়বেন মুসলিমরা, এমন একটা ধারণা সফল ভাবে গড়ে তুলেছে মুসলিমেরা। আর তা যে একেবারে অমূলক-তা-ও নয়। ফলে এই ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে সিএএ প্রসঙ্গ যে বিশেষ ভাবে জায়গা করে নেবে, তা আর অবাক কথা কী!
একুশের বিধানসভাতেও তৃণমূলের জন্য জরুরি ছিল ৩০ শতাংশ ভোটব্যাঙ্ক। নিন্দুকেরা অনেকেই বলেন, মুখ্যমন্ত্রী এই ভোটটাকে হাতে রাখারই চেষ্টা করেন সর্বদা। গত বিধানসভা তো বটেই, গত লোকসভা ভোটেও এই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলি থেকে ভালো ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। তবে এ বছর সেই ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনাও প্রবল ভাবে রয়েছে। সিপিএমের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে ঐক্যে পৌঁছতে না পারলেও এই লোকসভা ভোটে রাজ্যের একাধিক লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছে আইএসএফ। বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে তো বটেই। বহু কেন্দ্রে যেখানে বামেরা প্রার্থী দিয়েছে, সেখানেও প্রার্থী দিয়েছে আইএসএফ। বসিরহাট, ডায়মন্ডহারবারের মতো একাধিক কেন্দ্র রয়েছে সেই তালিকায়।
সংখ্যালঘু ভোট ঘরে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি সিপিআইএমও। জায়গা বুঝে দলের মুসলিম নেতাদের প্রার্থী করেছে তাঁরা। উত্তর ও দক্ষিণ মালদহ লোকসভা আসনের ফল বররাবরই সংখ্যালঘু ভোটে নির্ধারিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, উত্তর মালদহে ৫৫ শতাংশ এবং দক্ষিণ মালদহে ৬৫ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে। এই ভোট যখন যার দিকে গিয়েছে, তারাই জয়ের মুখ দেখেছে। এর আগে, বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে তৃণমূল জেলার ১২টি আসনে সে ভাবে দাঁত ফোটাতে পারত না। কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনে জেলার আটটি আসন তারা দখল করে এবং সেগুলি বেশির ভাগই সংখ্যালঘু প্রভাবিত এলাকাতেই। এমনকি, সংখ্যালঘু প্রভাবিত যে সুজাপুর বিধানসভা এলাকা কয়েক দশক ধরে কংগ্রেসের ‘গড়’ বলে পরিচিত ছিল, সেখানেও লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত হয় কংগ্রেস প্রার্থী! বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, ‘সিএএ’, ‘এনআরসি’-জুজুতেই সে বার সংখ্যালঘু ভোট বেশির ভাগটাই তৃণমূলের দিকে চলে গিয়েছিল। তবে গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল উত্তর মালদহ আসনে দ্বিতীয় স্থানে ও দক্ষিণ মালদহ আসনে তৃতীয় স্থানে ছিল। তৃণমূলের একাংশের দাবি, কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগিতেই ওই পরিস্থিতি। এ বার পঞ্চায়েত ভোটেও সংখ্যালঘু ভোটের একাংশ তৃণমূলের থেকে মুখ ফেরায় বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত।
আরও পড়ুন: নজরে সন্দেশখালি প্রতিবাদী প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদই বসিরহাটে ভরসা বামেদের
গত ভোটে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুরের মতো একাধিক জায়গায় বাম-কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল সংখ্যালঘু ভোট। যার ফায়দা তুলেছিল বিজেপি। তবে দেশ জুড়ে সিএএ চালু হওয়ার পর থেকেই তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে সংখ্যালঘুদের পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছেন তাতে সিএএ আতঙ্কে বিজেপিকে রুখতে বাম-বিজেপিতে চলে যাওয়া ভোট আবার তৃণমূলে ফিরবে বলে শাসক দলের নেতাদের অনেকেই মনে করছেন। প্রকাশ্যে না বললেও সিএএ কার্যকর হওয়ায় যে সংখ্যাগুরুদের ভোট এককাট্টা হয়ে তৃণমূলের ঝুলিতে আসতে পারে তা প্রকারান্তরে মেনে নিচ্ছেন গেরুয়া শিবিরের অনেক নেতাই।
এদিন অবশ্য ইদের মঞ্চে তিনি গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই। তবে ভোট যত কাছে আসে, সেই সব ণত্ব-স্বত্ব ঝেড়ে ফেলে প্রচারই মূল বিষয় হয়ে ওঠে যে কোনও দলের কাছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী মমতার পাশাপাশি তৃণমূলনেত্রী হিসেবে এই সুবিধাটুকু নিতেই হত মমতাকে। একটা গোটা গোষ্ঠীকে এই ভাবে একত্রিত ভাবে পাওয়ার সুযোগ রোজ রোজ আসে না। ফলে সেই পরবের মঞ্চ থেকে যে আরও একবার চেনা-কার্যকর অস্ত্রেই আরও একটু শান দেবেন তিনি ভোটের আগে আগে, তা খানিকটা প্রত্যাশিত ছিল বলেই মনে করছে অভিজ্ঞমহল। এমনিতেই একাধিক দুর্নীতি মামলায় রাজ্যে ভরাডুবি অবস্থা তৃণমূলের। বিজেপির বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ এ সময়ে যত না কাজে আসবে, তারে চেয়ে যে অনেক বেশি মোক্ষম সিএএ, এমআরসি-র মতো ইস্যু, তা তো বোধহয় শিশুও জানে।