দোতলার ঐতিহ্য গিয়েছিল আগেই, অবশেষে অতিমারী কোপ বসাল বাস চলাচলেই?

একদিকে বাসে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে যতগুলো সিট, শুধু ততজন যাত্রী নিয়ে চলা বাস আর নতুন নীল-হলুদ বেসরকারি বাসের চটকে আমরা পুরনো বেসরকারি বাসকে ভুলে গেলাম।

"টিকিট... টিকিট... দেখি টিকিট।"

"চালানোর ইচ্ছে নেই? সাইডে দাঁড় করিয়ে দে।"

"বাঁয়ে চাপ, যা যা।"

"আস্তে লেডিজ! পা চালিয়ে নামুন।"

"আরেকটা পেছনে চলে এসেছে। এইবার দৌড়বে।"

 

যাঁরা বাসে উঠেছেন, তাঁরা সকলেই কমবেশি এই কথাগুলো শুনেছেন। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, ছোটবেলায় যতরকমের বাস দেখেছি, তার মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল দোতলা বাস আর সবথেকে অপছন্দ ছিল মিনিবাস। এই দুই ধরনের বাস ছাড়াও ছিল বেসরকারি আর লাল বাস। সরকারি বাসকে আমরা একসময় 'লাল বাস' বলতাম। বাড়ির সামনে দিয়ে চলা একমাত্র লাল রঙের সরকারি বাস ছিল দুই নম্বর রুটের বাস। স্কুলের সময় ভিড়ে ঠাসা সেই বাসে রোজ একই কনডাক্টর থাকত। সদাহাস্যময় সেই কনডাক্টর রোজ স্কুলযাত্রী বাচ্চা এবং তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে গল্প করতেন।

 

আমরা, নব্বইয়ের প্রজন্ম স্কুলে পড়ার সময় থেকেই প্রথমে দোতলা বাস এবং আস্তে আস্তে লাল বাস রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেল। দোতলা বাসের বদলে নতুন কিছু না এলেও লাল বাসের বদলে এল নতুন ধরণের নীল বাস। লাল বাসের কোনও ছাপ তার মধ্যে নেই। লাল বাসের উঁচু তিনজনের ছেঁড়া সিটের বদলে এল ছোট, আরামদায়ক সিট। পুরোনো হলুদ বাল্বের বদলে এল নতুন সাদা আলো। বৃষ্টির সময় আটকে থাকা, ওপর থেকে নিচের দিকে বন্ধ করা জানলার পাল্লার বদলে এল সহজে পাশাপাশি বন্ধ করা জানলার পাল্লা। সিট, আলো, জানলার সঙ্গে টিকিটও বদলে গেল। পুরনো বাসের শুধু ভাড়ার মূল্য লেখা টিকিটের বদলে এল মেশিন থেকে সেই মুহূর্তে প্রিন্ট হওয়া টিকিট, যার মধ্যে টিকিটের মূল্য ছাড়া গন্তব্য লেখা থাকে।

 

আরও পড়ুন: কলকাতার গর্ব ট্রাম এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে? মুছে যাচ্ছে যে স্মৃতিগুলো

 

কলেজে পড়ার সময়, ২০১৩-'১৪ সাল নাগাদ বুঝলাম, এইবার যাওয়ার পালা পুরনো বেসরকারি বাসের। সেই উচু পাদানি, পাশ করে বসানো সিট আর সাদা সবুজ রঙের বেসরকারি বাসের বদলে রাস্তায় চলতে শুরু করল দুই ধরনের নতুন নীল, হলুদ বাস। বাসে দু'জন কনডাক্টরের বদলে একজন রইল, কারণ একটাই গেট হওয়ার কারণে দ্বিতীয় জনের দরকার রইল না। যদিও তখন সকলের মধ্যমনি হয়ে উঠল এয়ার কন্ডিশন থাকা নীল রঙের সরকারি বাস। গরমকালে অফিসের সময় এমনি বাস যতই ফাঁকা হোক, একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সরকারি বাস এলে সবাই সেই দিকেই ছুটতে শুরু করল। বেশি ভাড়া এবং সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও এই বাসগুলো যাত্রীসংখ্যার বিচারে অন্য বাসকে বলে বলে দশ গোল দিতে শুরু করল। এই এয়ার কন্ডিশনড বাসের চটক কাটতে না কাটতে চলে এল আর এক নতুন ধরনের বাস। এই ধরনের বাস অনেকের খুব পছন্দ হলো, কারণ এই বাসে যতগুলো সিট, ততজন যাত্রী উঠতে পারবেন, অর্থাৎ কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। কেউ এই বাসের নাম দিল সাদা বাস, কেউ আবার একেই বাস বলে ডাকতে শুরু করল।

 

একদিকে বাসে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে যতগুলো সিট, শুধু ততজন যাত্রী নিয়ে চলা বাস আর নতুন নীল-হলুদ বেসরকারি বাসের চটকে আমরা পুরনো বেসরকারি বাসকে ভুলে গেলাম। সেও কাউকে কোনও অভিযোগ না জানিয়ে পালিয়ে গেল। একদিন হঠাৎ খবর পেলাম যে তিন নম্বর রুটের বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুনে 'আহা, উহু' করলাম বটে, কত স্মৃতি ছিল সেই বাসকে জড়িয়ে, তা রোমন্থন করলাম। কিন্তু ওই পুরনো বাসের বদলে নতুন ধরনের বাস কেন কেনা হয়নি, সেই প্রশ্নও উঠে এল‌। শেষে শুধু তিনটে বাস চলত এই পুরো রুটে।

 

এই ভাবেই বাস নিজের রূপ বদলে নিজেকে টিকিয়ে রাখছিল, কিন্তু গোল বাধাল অতিমারী। লকডাউন পর্বে বাস চলা বন্ধ হলো। যখন লকডাউন শেষ হলো, তখন জানা গেল যে, বহু বাস চলছে না, কারণ তারা ক্ষতি সামলাতে পারেনি। বাসের ভাড়া সকলের অজান্তে বেড়ে যাওয়ার ফলে কনডাক্টর এবং যাত্রীদের মধ্যে প্রায় বচসা হতে লাগল। কিছু বাসে পোস্টার পড়ল যে, অতিমারী পরিস্থিতিতে বাস-শিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে, তাই পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং অতিমারীর জোড়া ফলা থেকে বাঁচতে যেন তাদের সাহায্য করা হয়। এই রকম সময়ে একদিন বাসের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে বাসেরই কয়েকজন যাত্রীর কথোপকথন শুনেছিলাম। সেখানে এক দলের বক্তব্যের সারাংশ এই যে, বাসের ভাড়া যেভাবে বেড়ে চলেছে, তার থেকে লোন নিয়ে বাইক অথবা গাড়ি নিয়ে নেওয়া ভালো। কারণ তাতে যাতায়াতের কষ্ট কম হয়, সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায় এবং লকডাউন পরিস্থিতিতে কাজে যেতে অসুবিধে হয় না। দ্বিতীয় পক্ষ বিপ্রতীপে অনেক যুক্তি দিচ্ছিল‌। এর মধ্যে এক ভদ্রলোক একটা কথা বললেন। তিনি বললেন, "এই বাসে চল্লিশ জন যাচ্ছে একসঙ্গে। বাসটা কতটা জায়গা নিচ্ছে, আর কতটা দূষণ করছে। এইবার ভাবুন, এই চল্লিশ জন যদি প্রত্যেকে একটা করে গাড়ি নিয়ে বেরোয়, তাহলে ট্রাফিকের অবস্থা কী হবে? দূষণের কথা তো না হয় বাদই দিলাম, ওই পরিস্থিতিতে সময়ে গন্তব্যে পৌঁছবেন কীভাবে? তা 'বলে কি আমি গাড়ি কিনতে বারণ করছি? একদম না! কিন্তু সেটার ব্যবহার বুঝে করতে বলছি।"

 

বাকি কথা আর শোনা হয়নি। আমার স্টপ এসে যাওয়ায় আমি নেমে পড়ে হাঁটতে শুরু করলাম। পাশ দিয়ে একদম নতুন ইলেকট্রিক বাস হুস করে বেরিয়ে গেল।

 

 

More Articles