জান জান মহমেডান, তুমকো লাখোঁ সেলাম!
Mohammedan SC I-League: ’৩৪ থেকে ’৩৮ অবধি মহমেডানের যে অভূতপূর্ব জয়যাত্রা, তাকে মুসলিম লিগ নিপুণভাবে কাজে লাগায়, মুসলমানদের ‘উদ্বুদ্ধ’ করায়।
মহমেডান স্পোর্টিং আই-লিগ জিতল, খুব একটা কারও কিছু এসে গেল? মানে, খেলার পাতা-টাতা, যে ক'টি টিমটিম করে, সেখানে নিশ্চয়ই খবর হয়েছে, খেলার পাতার বিষয় আফটার অল। কিন্তু ওই যে প্রাণ খুলে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ, তা অন্তত আমার খুব একটা নজরে আসেনি। এমনকী ফেসবুকেও না। তিনটে কারণ মনে হয়। এক, বাংলার ফুটবল নিয়ে অতি কম সংখ্যক মানুষ আজকাল চিন্তিত, সে যে কারণেই হোক না কেন। দুই, বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি, আর একালে বিশেষ করে, ইতিহাস যেভাবে হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে, তাতে তো আরওই অবস্থা খাদের কিনারে, বলাই বাহুল্য। তিন, শুনতে খানিক বিতর্কিত হলেও, ব্যাপারটির মধ্যে একটি হিন্দু-মুসলমান দিক রয়েছেই। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে, এই মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল মূলত হিন্দুদের আর মহমেডান, মুসলমানেদের, বিভাজন প্রায় শুরুর দিন থেকেই ছিল। প্রত্যেকবারই এই বিভাজন কাজ করে গিয়েছে ইতিহাস জুড়ে, এমনটা নয়। খানকতক বিবরণ তো পাওয়াই যায় যেখানে, ‘হিন্দু’ মোহনবাগানের শিল্ড জয়ে আনন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছেন মহমেডান-সমর্থক মুসলমানেরাও। আবার ১৯৩৪ সালে ‘মুসলমান’ মহমেডানের অনবদ্য লিগ জয়ে (১৯৩৮ অবধি তারা টানা পাঁচ বার লিগ জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করবে) ‘হিন্দু’-দের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসাও পাওয়া যায়। এমনকী, সেই সময়ে কলকাতার মেয়র নলিনীরঞ্জন সরকার মহমেডানের এই জয়ে আপ্লুত হয়ে একটি শানদার সংবর্ধনারও ব্যবস্থা করেন, খরচ হয়েছিল ১০০০ টাকা। খেয়াল করার যে, ঠিক এক সপ্তাহ আগে শহরে মহাত্মা গান্ধির সমর্থনে একটি বিশাল মিছিল যখন অনুষ্ঠিত হয়, মেয়রের কাছ থেকে তাতে বরাদ্দ হয়েছিল মাত্র ১০ টাকা!
এই যে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের কথা বললাম, তা কিন্তু প্রকাশ্যে আসছে যে সময়টায়, তখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াচ্ছে মুসলিম লিগ। এবং, ’৩৪ থেকে ’৩৮ অবধি মহমেডানের যে অভূতপূর্ব জয়যাত্রা, তাকে মুসলিম লিগ নিপুণভাবে কাজে লাগায়, মুসলমানদের ‘উদ্বুদ্ধ’ করায়। বাংলায় সে কাজ করে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি। হাওয়ায় ঘুরতে থাকে, নানা ক্ষেত্রেই মুসলমানদের প্রতি ‘বঞ্চনা’-র অভিযোগ এবং মহমেডান যেন প্রতি জয়ের সঙ্গেই উত্তর দিচ্ছিল, পায়ের তলায় হারানো জমিও খুঁজে নিচ্ছিল সেই ‘বঞ্চিত’ মুসলমানদের হয়ে। বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক ও এলিট মুসলমানদের এই দড়ি টানাটানিতে মহমেডান কতটা ‘ব্যবহৃত’ হয়েছিল বা অন্যভাবে বলতে গেলে কতটা মাঝদরিয়ায় পড়ে গিয়েছিল, তা অন্য তর্কের বিষয়। অন্য ভাবনার বিষয় তো এও যে মোহনবাগানের ১৯১১ সালের শিল্ড জয়কে যে রূপ জাতীয়তাবাদী এক আস্ফালন হিসেবে দেখা হয়, মহমেডানের টানা পাঁচ বার লিগ জয় কেন স্বাধীনতা পর্বের অসম্ভব জরুরি এক ক্ষণে তেমন সূর্যের আলোয় স্নাত নয়? প্রশ্ন জাগে, তবে কি মহমেডানকে যথেষ্ট ‘ভারতীয়’ হিসেবে দেখা হচ্ছে না? যদি না দেখা হয়, তবে দেখছে না কে? হিন্দুরা? নাকি খোদ মুসলমানরাও? এই দেখা, না-দেখার যে প্রবল আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, তা-ই কিন্তু পাওয়া যায় সে কালের ছাপা অক্ষরে। অর্থাৎ বলতে চাইছি, মহমেডানের সাংঘাতিক কীর্তি সর্বদাই যেন তেলে-জলে মিশ খাওয়ার মতো করেই রয়ে গিয়েছে ভারতীয় ইতিহাসে। শুধু ফুটবল ইতিহাসে নয়। কিছু উদাহরণ দিই।
আরও পড়ুন- এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…
বিখ্যাত পত্রিকা ‘সওগাত’-এ লেখা হচ্ছে — ‘মোহামেডান দলই সর্ব্বপ্রথম মুসলমানকে মঞ্চে তুলিয়াছে, অভিনেতার পাঠ দিয়াছে, করতালির প্রাপকের পদে উন্নীত করিয়াছে। খেলার মাঠে, জীবনের ক্ষেত্রে, যে মুসলিম ছিল অলক্ষ্যের ভিড়ের দর্শক মাত্র, তারাই হইয়াছে আজ অভিনেতা, তারাই সাজিয়াছে আজ যুদ্ধপোশাকে, তাদেরই দিকে আজ লক্ষ চক্ষু চাহিয়া আছে। ... মোহামেডান দলই সে মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূতের কাজ করিয়াছে।’ এখানে খেয়াল করুন ‘…অলক্ষ্যের ভিড়ের দর্শক মাত্র…’ অংশটি। মহমেডান এখানে এক বিরাট সংখ্যক মানুষের আইডেন্টিটি গড়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে। ‘বঞ্চনার’ জবাবে সে শেষমেশ জেগে উঠছে। সে আইডেন্টিটিকে আরও হাওয়া দিচ্ছেন কবি শাহাদাৎ হোসেন, ‘জিন্দাবাদ’ কবিতায়। দলের বন্দনা করে তিনি লিখছেন —
‘মহা-কঙ্কাল জাগিয়াছে সেই, নড়িয়া উঠেছে গলিত শব,
বিপুল জীবনে রুদ্র জোয়ার কল্লোলে জাগে বিজয় রব।
প্রতি লোমকূপে জেগেছে জীবন—গৌরবে ভরে সারাটী বুক,
মুস্লীম দল সারা ভারতের উজল কোরেছে মলিন মুখ।’
কাজী নজরুল আবেগমথিত হয়ে লিখছেন —
‘যে চরণ দিয়ে ফুটবল নিয়ে জাগাইলে বিস্ময়,
সেই চরণের শক্তি জাগুক আবার ভারতময়।
এমনি চরণ-আঘাতে মোদের বন্ধন ভয়-ডর
লাথি মেরে মোরা দূর করি যেন; আল্লাহু আকবর!’
গোলাম মোস্তাফা ‘লীগ বিজয়’ কবিতায় লিখছেন —
‘নয় রে নয় এ লীগ্-বিজয়—
আজকে মোদের দীগ্-বিজয়!
হর্ ঘরে আজ জ্বালাও বাতি, প্রাণ খুলে আজ গাওরে গান,
নীল গগনের আঙ্গিনাতে উড়াও আজি লাল্-নিশান।
কিসের বাঁধা? কিসের ভয়?
বুক ফুলিয়ে বলরে সবাই—
জয় মোহামেডান-র জয়?’
আব্বাসউদ্দিনও গান বাঁধছেন দল নিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে গান মুখে মুখে ফিরছে। তবে মুখে ফেরার কথা তুললে, নিম্নলিখিত গানের জুড়ি মেলা ভার। ’৩৪ সালের লিগ জয়ের পর এই গান খুব জনপ্রিয় হয় —
মহমেডান স্পোর্টিং তুমকো লাখোঁ লাখোঁ সেলাম/হম্ অব্ দেশকা বাদশাহ্ বনে, অওর সব হ্যায় গুলাম…
আবার বলব লব্জ ব্যবহার খেয়াল করুন। অবশ্যই এখানে ‘সব হ্যায় গুলাম’ শব্দগুলির মধ্যে দিয়ে ক্রীড়াশৌর্যের দিকেই আলোকপাত করা হয়েছে কিন্তু যে আবহে এমন কিছু উচ্চারিত হচ্ছে, তখনই কিন্তু ধীরে জাগছে টু-নেশন থিওরি। ফলে যে কোনও পক্ষেরই অনায়াসে শব্দের অর্থ ঘুরিয়ে নেওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ ছিল। অর্থাৎ আগুন ও বারুদের মধ্যে তফাত বেগদাখানিকও ছিল না। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, ঠিক কী হয়েছে, ঠিক কী হয়নি ইতিহাস যাচাই করবে কিন্তু বিস্ফোরণের সম্ভাবনা মজুত ছিল এবং সেই সম্ভাবনা তৈরি হয় কীভাবে? তৈরি হয় গ্রাউন্ড রিয়্যালিটির হেতু। যে বাস্তব এই আজকের দিনে যেন আরও খুনখার রূপ ধারণ করেছে। সিএএ বা গরুর মাংস রাখার ‘দোষে’ মব লিঞ্চিং বা এমনও আরও বহু উদাহরণ আছে, কালে কালে আরও জমবে, বোধ হচ্ছে। ‘গুলাম’ বানানোর নিপুণ এক প্রকল্প শুরু হয়েছে দেশে, বিশেষ করে বিশেষ এক ধর্মের মানুষকে তো বটেই। অতএব মহমেডানের জয় নিয়ে ন্যূনতম উচ্ছ্বাস (সে ভারতীয় ফুটবল নিয়ে মারকাটারি ভাবিত কেউ হলেও) এ আবহে নিতান্তই গণ্ডগোলের! আরও সমস্যা হচ্ছে সেই ইতিহাস বিগড়ে যাওয়ার বা ‘ফেব্রিকেটেড’ হওয়ার বিষয়টি। আচ্ছা, কেন বলুন তো মেটিবুরুজ থেকে উঠে আসা মহম্মদ সেলিমের কথা প্রায় কেউই (ঘোরতর ইতিহাসবিদ ছাড়া) জানেন না? জানেন কি, তিনিই ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক স্তরে খেলা ফুটবলার? স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লাব সেল্টিক-এ তিনি খেলেছিলেন। খালি পায়ে খেলে তাকও লাগিয়ে দিয়েছিলেন এবং কিছুদিন পর যখন তাঁর বাড়ির জন্য মনকেমন করে এবং তিনি ফিরে আসতে চান, সেল্টিক থেকে তাঁকে অনেক রকমভাবে অনুরোধ করা হয়, যাবেন না দয়া করে। তাঁর সম্মানে চ্যারিটি ম্যাচও আয়োজন করা হয়। তুমুল ভিড়ও হয়। না, নিছক গল্পকথা নয়। এর জন্য ইতিহাস ঘাঁটার কষ্টটি করতে হবে সন্দেহবাতিককে।
আরও পড়ুন- বাড়াবাড়ি করলেই এনআরসি, তাড়িয়ে দেব, ফুটবলে বলা যায়?
আরও মজার কথা হচ্ছে এ ঘটনার বহু বছর পর সেলিমের পুত্র, পিতার ভগ্ন শরীরের কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন ক্লাবে, তাঁর আসলে উদ্দেশ্য ছিল এইটা দেখা, সেলিমকে অত বছর পরও কি মনে রেখেছে সেল্টিক? পুত্র রশিদকে চমকে দিয়ে উত্তর আসে, সঙ্গে সাহায্যের ব্যাঙ্ক ড্রাফ্টও। সাহায্যের অর্থ এখানে মূল নয়, রশিদ আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন এই স্মরণচিত্র দেখে। এই সেলিম কিন্তু গোলাম মোস্তাফার ভাষায় ‘দীগ্-বিজয়’ করা মহমেডানের এক মূল স্তম্ভ ছিলেন, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন অলরেডি! মনে রাখিনি আমরা কেউই, হিন্দু, মুসলমান বা অন্য যে কোনও ধর্মের মানুষই মনে রাখিনি তাঁর কথা। মনে রেখেছি কি, মহমেডানই ছিল সেই অর্থে প্রথম ‘প্যান-ইন্ডিয়া’ দল অর্থাৎ যেখানে অবিভক্ত ভারতের নানা প্রদেশ থেকে — তা বর্তমান পাকিস্তানের কোয়েটা বোক বা পেশাওয়ার হোক, বা হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু বা ঢাকা — প্লেয়ার তুলে দল গঠন করা হতো। এমনকী, বাঘা কর্মকর্তা আজিজের, প্লেয়ারদের বিশেষ হালকা বুট পরে খেলানোর সিদ্ধান্ত, মহমেডানে এনে দিয়েছিল আধুনিকতার জোয়ার, সঙ্গে গৌরবময় ইতিহাসও। এই এখানেই, মানে এই 'ইতিহাস' শব্দের জটেই তো আমাদের গোটা ভাবনাপ্রবাহখানি জড়িয়ে-মড়িয়ে একাকার হয়ে গেল। না?
এনিওয়ে, এই করেই তো দরকচা মেরে গেলাম, অবস্থা যে তিমিরে, সে তিমিরেই। নাকি, ভুল বললাম, বা এতক্ষণ ধরে বৃথা বকলাম, অবস্থা এখন আরও গুরুতর। তবুও কোথাও যেন একটা অল্প হলেও জ্বলন্ত শিখা দেখলে মন নেচে ওঠে। মনে হয়, খেলা ঘুরবেই, যেমন ঘুরিয়েছিল মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আর মহমেডান…