শুধু প্রসাদ বিতরণ নয়, লাগবে কর্মসংস্থান
Exclusive Pranab Bardhan Interview: দক্ষিণপন্থীরা কি মানুষের আবেগতাড়িত প্রবণতার সুযোগ নিচ্ছে? বামেদের নেতৃত্বে ঠিক কোন বদল এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি? একান্ত কথোপকথনে অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন।
অর্ক: আপনার বই 'ওয়ার্ল্ড অফ ইনসিকিওরিটি', বাংলায় বললে বিশ্বজোড়া অনিশ্চয়তা-য় আপনি বৈষম্য-অনিশ্চয়তার দিকগুলি তুলে ধরতে তিনটে দেশ বেছে নিয়েছেন, ভারত, তুরস্ক, ব্রাজিল। কলম্বিয়া, চিলি, পেরুর মতো দেশগুলি নিয়ে আপনি এখনও ক্ষীণ আশাবাদী। কিন্তু ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে, এই ব্যতিক্রম বাদ দিলে, দক্ষিণপন্থীরা রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পরিসরগুলি হেলায় দখল করে নিচ্ছে। স্বৈরাচারের প্রতি, একনায়কতন্ত্রের প্রতি মানুষের সমর্পণ কেন বাড়ছে?
প্রণব: এর অনেক কারণ, আমার বইতে তার বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথমত, দক্ষিণপন্থীরা মানুষের কতগুলি আবেগতাড়িত প্রবণতার সুযোগ নিচ্ছে। ইওরোপে ও আমেরিকায় বিদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন নিয়ে দেশি শ্রমিকদের অসন্তোষকে ব্যবহার করা হয়, ভারতবর্ষে মুসলমান-বিদ্বেষকে কাজে লাগানো হয়। দ্বিতীয়ত, এই নতুন দক্ষিণপন্থীরা জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। ভারতবর্ষে যেমন মোদি গরিবদের জন্য কিছু কিছু জনকল্যাণকর নীতি চালু রেখেছেন। এছাড়া মানুষজনকে বোঝানো হয় গণতন্ত্রে বাগবিতণ্ডায়, বিক্ষোভে অনেক সময় নষ্ট হয়, একনায়কতন্ত্রে নেতা চটজলদি মানুষের সমস্যার সমাধান করে দেবার ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেন। গণতন্ত্রে দলীয় দুর্নীতির কথা বলা হয়, এদিকে একনায়কতন্ত্রে নেতার বা তাঁর দলের নানা দুর্নীতি চেপে রাখা সহজ হয়।
অর্ক: সিএএ চালু হয়ে গেল। অর্থাৎ এনআরসি-র ভয়টা আরও একবার ভোটের সময় সামনে আনা গেল। বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে বলছেন, ৩৭০টি আসনে জিতলে সংবিধান বদলে দেবেন। সঙ্ঘের যে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়, তা পূরণের পথে সত্যিই কি কোনও বাধা আছে?
প্রণব: এখনও আশা যে বিজেপি হয়তো ৩৭০টি আসন পাবে না। ২০১৯ সালে ওরা উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বেশিরভাগ আসনই পেয়েছিল, সেখানে আর বাড়াবার বিশেষ জায়গা নেই। ৩৭০-এর বেশি পেতে হলে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে আগের চেয়ে অনেক বেশি আসন পেতে হবে। সেটা অসম্ভব নয়, তবে কঠিন।
আরও পড়ুন- বাংলার একপেশে রাজনীতি বিজেপিকে জায়গা করে দিল । মুখোমুখি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
অর্ক: দেউলিয়া অনিল আম্বানি থেকে আদানি গোষ্ঠী, সকলেই মোদি সরকারের সঙ্গে গভীর দেনাপাওনায় জড়িত। ভাই-বেরাদারি পুঁজিবাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা আমাদের গণতন্ত্রকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে?
প্রণব: একচেটিয়া পুঁজিবাদের দিকে। এতে কিছু নেতা ও তাদের স্যাঙাৎ ব্যবসায়ীরাই ছড়ি ঘোরাবে, ছোট ব্যবসায়ীরা পাত্তা পাবে না।
অর্ক: যত দিন যাচ্ছে, চাকরির নিশ্চয়তা ততই কমছে। আমাদের দেশের যুবসমাজের বড় অংশ গিগ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। কেউ ওলা-উবের চালাচ্ছেন, কেউ সুইগি ব্লিঙ্কিটের ডেলিভারি কর্মী। রাজ্য সরকার নানা ধরনের চুক্তিভিত্তিক চাকরি করেছে। ভারতীয় সেনাতেও চালু অগ্নিবীর প্রকল্প। এই পরিস্থিতিতে তো ট্রেড ইউনিয়নগুলির আরও অনেক সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল। কর্মক্ষেত্রে প্রেশার-গ্রুপ কেন প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে?
প্রণব: আমাদের বামপন্থীদের এখানেই চরম ব্যর্থতা। কৃষকরা যতটা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, শ্রমিক আন্দোলন সেই তুলনায় অনেক স্তিমিত। এই শ্রমিক আন্দোলনে শুধু স্বল্পসংখ্যক সংগঠিত শ্রমিকদের মাইনে বাড়ানোর দাবি না করে বহুসংখ্যক অসংগঠিত কর্মী (গিগ কর্মীরা তার অল্প অংশ) তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে।
অর্ক: একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে পড়লাম, ভারতে গত বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি লোক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কোর্স করছে। ভারতের কাজের বাজারে এআই-এর ভূমিকা আগামী দিনে কী হবে?
প্রণব: কৃত্রিম মেধার অনেক ইতিবাচক দিক আছে, যেমন স্বাস্থ্যপরিষেবার জগতে। কৃত্রিম মেধা শুধু বর্তমান শ্রমিকের বিকল্প না হয়ে নতুন চাকরির দিক খুলে দেবে কিনা তা খানিকটা নির্ভর করবে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক আন্দোলন ও তার দাবিগুলি কতটা জোরদার হতে পারে তার উপর।
অর্ক: ভোটের কথায় আসি। ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য আসার পর দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি দলই বন্ডে টাকা নিয়েছে, ব্যতিক্রমী সিপিএম। দেখা যাচ্ছে, বহু সংস্থা চাঁদা দিয়ে বাড়তি সুবিধে পেয়েছে, কাজের বরাত পেয়েছে। আবার বহু সংস্থার ক্ষেত্রে ইডি-সিবিআই লাগিয়ে লাগাতার চাঁদা তোলা হয়েছে। এই ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব সাধারণ মানুষের মনে পড়বে?
প্রণব: বিজেপি নানাভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে বহুলোককে বুঝিয়েছে যে, বিরোধীরাই বিশেষ করে দুর্নীতিগ্রস্ত। পশ্চিমবাংলায় অনেকে ভুলে যায় যে, তৃণমূল দল যদি চোর হয়, বিজেপি ডাকাততুল্য, ওরা পুকুরচুরি করে ক্ষমতার বলে তাকে চাপা দিতে পারে। স্যাঙাৎতন্ত্রের পুঁজিবাদ হলো এক ধরনের দুর্নীতিলিপ্ত পুঁজিবাদ। এছাড়া বিরোধী যে নেতাদের বিজেপি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে গাল দিয়েছে, তারা যখন বিজেপিতে যোগ দিয়েছে তখন তাদের গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দুর্নীতিমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
ইলেক্টরাল বন্ডের কেলেঙ্কারি এখনও পর্যন্ত সাধারণ ভোটদাতাকে খুব বিচলিত করেছে বলে মনে হচ্ছে না।
অর্ক: আপনি হয়তো দেখেছেন, মুকেশ আম্বানির কনিষ্ঠসন্তানের বিয়েতে হাজার কোটি টাকা খরচ হলো। বলিউড থেকে রাজনীতি-জগৎ সকলে বাঁদরনাচ নাচলেন। দিন সাতেকের জন্য গোটা দেশের মিডিয়াস্পেস প্রায় জবরদখল হয়ে গেল। বেকারত্ব, অসাম্য, শিশুমৃত্যুর হার, অপুষ্টির পরিসংখ্যানকে প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ার কোনও প্রতিনিধি এই প্রদর্শনের পাশাপাশি রাখল না। সংবাদমাধ্যমের কাজ ছিল জনমতের প্রতিফলন ঘটানো। সংবাদমাধ্যমের চরিত্রবদল আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে?
প্রণব: অনেক স্বৈরতান্ত্রিক দেশের মতো আমাদের দেশেও সংবাদমাধ্যমের শতকরা পঁচানব্বই অংশই সরকারের পেটোয়া হয়ে গেছে। এদের নির্লজ্জতা আম্বানিদের নির্লজ্জতার চেয়ে কম নয়।
অর্ক: আপনি আপনার বইয়েও সমাজমাধ্যমের বিষময় ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। সংগঠিত ট্রোলের কথা যদি বাদও দিই, বারবার দেখি এই স্পেসে একজোট হয়ে ভিন্নমত দমন করা হয়। আক্রমণকারীদের মূল শত্রু মুসলিম সমাজ। আর আক্রমণটা ধেয়ে আসে মূলত লেফট-লিবারেলদের দিকে। সেকু-মাকু গালাগালের চালু লব্জ। এই সহিংস ডিজিটাল সমাজের সঙ্গে লড়াইয়ের কোনও পথ কোনও রাজনৈতিক দলই কিন্তু সচেতনভাবে খুঁজছে না। পরিত্রাণ আদৌ সম্ভব?
প্রণব: পরিত্রাণ কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। আমাদের দেশে তো এখন ডিজিটাল প্রযুক্তিতে পারদর্শী লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী। তাদের অনেকে যদি সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বিজেপির মিথ্যা ও ঘৃণাময় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বিকল্প বিশ্বাসযোগ্য সমাজমাধ্যম ছড়িয়ে দিতে পারে দেশের মহল্লা মহল্লায়, তাহলে কাজের কাজ হয়। আমি শুনেছি তাইওয়ানে সাম্প্রতিক নির্বাচনের সময় চিনের বিদ্বেষী অপপ্রচারে যখন সমাজমাধ্যম প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পাড়ায় পাড়ায় তাইওয়ানর যুবসমাজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে।
আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধির সঙ্গে দু’ দশ মিনিট
অর্ক: রামমন্দিরের পাল্টা আমাদের রাজ্যে ৭০০ কোটি টাকার ধর্মীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। সস্তায় রিলিজিয়াস ট্যুরিজমই কি এখন নিচুতলার মন দখলের একমাত্র উপায়?
প্রণব: ধর্মীয় আচার বা মন্দির দর্শন দিয়ে বিজেপির মোকাবিলা করা মুশকিল। একসময় বামপন্থীরা গণনাট্য, জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন করে পশ্চিমবাংলার দিকে দিকে সমাজচেতনার বার্তা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। আজ আবার প্রয়োজন হয়েছে একটা বড়মাপের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের।
অর্ক: নানা প্রকল্পের সৌজন্যে বাংলার নারীসমাজে তৃণমূল অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বাংলার মেয়েদের ভোট বামপন্থীরা ফেরাতে পারবে?
প্রণব: নারীদের ভোট পেতে গেলে সরকারি প্রসাদ বিতরণ ছাড়াও কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত লাগবে, আর লাগবে নারীদের জনপরিসরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা পাকা করা। কন্যাশ্রী ইত্যাদি প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেবার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ দেশের বেশিরভাগ রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে আছে। মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে মা-বাবা বয়ঃসন্ধির অল্প পরেই মেয়ের বিয়ে দিতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন, নিরাপত্তার ভার শ্বশুরবাড়ির উপর চাপাতে সচেষ্ট হন।
অর্ক: আপনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বামেরা শ্রেণির রাজনীতি করলেও বর্ণবাদের সমস্যার দিকে মন ফেরায়নি। এখনও কি সেই স্থিতাবস্থা আছে?
প্রণব: কেরলে বামপন্থীরা শ্রেণির রাজনীতির সঙ্গে জাতপাতের রাজনীতির খানিকটা সমন্বয় করতে পেরেছেন। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী নেতৃত্বে বরাবরই উচ্চবর্ণ ভদ্রলোকদের প্রতিপত্তি, তাঁরা এ ব্যাপারে বিশেষ মাথা ঘামাননি। বামপন্থী নেতৃত্বে অতি সত্ত্বর প্রয়োজন বেশ কিছু তরুণ নিম্নজাতির ও আদিবাসী নেতাদের নেওয়া ও তাদের হাতে সমন্বয়ের রাজনীতির দায়িত্ব দেওয়া।
অর্ক: আমাদের দেশে এখন বিরুদ্ধমত মানেই জেলযাত্রা পাকা এবং একবার জেলে যাওয়া মানে দীর্ঘদিন বিনা বিচারে পড়ে থাকা। আমরা শারজিল ইমামকে দেখছি, উমর খালিদকে দেখছি। নাগরিক সমাজের আওয়াজ কি এই ভয়েই সংকুচিত হয়ে আসছে? কয়েক বছর আগেও তো আমরা সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন দেখেছি! এখন কি সেই আন্দোলন ফের গড়ে তোলা সম্ভব?
প্রণব: এসব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও উত্তর ভারতে চাষিরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন করেছে। হাজার হাজার লোককে জেলে পোরা সহজ নয়।
অর্ক: শেষ প্রশ্ন, আমরা মাঝেমাঝেই দুঃখ করি, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হয় না। একই কথা কি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? গত দশকে বাংলায় আপনার স্মৃতিকথা 'স্মৃতিকুণ্ডায়ন' প্রকাশিত হয়েছে। সে লেখার মাধুর্য ভোলার নয়। কিন্তু ভবতোষ দত্ত, অশোক মিত্রর উত্তরাধিকার বজায় থাকছে কি? অর্থনীতি দুর্বল বলেই কি অর্থনীতিবিদরা বাংলায় তেমন লেখেন না?
প্রণব: অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মৈত্রীশ ঘটক, অভিরূপ সরকার, সুগত মারজিত প্রমুখরা এখনও বাংলায় লিখছেন। বৃহত্তর সমস্যা হচ্ছে যে, আজকাল ভালো ছাত্রদের অনেকেই ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে পড়ছে, সেখানে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও হিন্দি নিচ্ছে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সুবিধার জন্য। তাছাড়া অনেক উচ্চবিত্ত বাঙালি ছাত্ররা বড়ই হচ্ছে বাংলার বাইরে। এসবের সঙ্গে অনেক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থার আপেক্ষিক অধোগতির সমস্যাটি অবশ্যই জড়িত।