ঘন ঘন বদলাচ্ছেন মোবাইল, স্মার্ট ওয়াচ! পৃথিবীকে যেভাবে গিলে খাচ্ছে ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য

E Waste Management: ২০২২ সালে সারা বিশ্বে যে ৬২ বিলিয়ন কেজি ই-ওয়েস্টের হদিস মিলেছিল তার অর্ধেকটাই কোনও না কোনও খনিজ পদার্থ, আর বাকি অর্ধেকের সিকি ভাগেরও বেশি প্লাস্টিক।

"এ লোহা ভাঙা, টিন ভাঙা... আছে নাকি ভাঙাচোরা?" ছোটবেলায় এই আওয়াজ শুনলে আমরা দৌড় দিতাম, পাছে ভাঙা খেলনা, পুরনো ব্যাটারি বদল দিয়ে চানাচুর মেলে! এখনও মাঝে মধ্যে সে ডাক শোনা যায়। তবে সেই ডাক কিঞ্চিৎ বদলে গেছে। এখন কানে আসে, "পুরনো কম্পিউটার বিক্রি করবেন, মনিটর বিক্রি করবেন, ভাঙা মোবাইল ফোন বিক্রি করবেন।" যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্জ্য পদার্থও কেমন বদলে গেছে। টিন ভাঙা, লোহা ভাঙার তালিকা লম্বা হতে হতে ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-ওয়েস্টে এসে ঠেকেছে। কী নেই এই তলিকায়! আমাদের পুরনো ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, প্রিন্টার, মেমোরি কার্ড, হার্ড ড্রাইভ, সিডি, ডিভিডি, পেন ড্রাইভ, আরও কত কী! সকাল থেকে রাত অবধি সবসময়ই আমরা কোনও না কোনও ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের সঙ্গে ঘর করছি। কিছুদিন ব্যবহারের পর আবার নতুন নতুন মডেলের দিকে ঝুঁকছি, হরেক রকমের সুবিধার জন্য। ফলত দিনে দিনে লম্বা হচ্ছে ই-ওয়েস্টের ফিরিস্তি। ২০২২ সালে বিশ্বে ই-ওয়েস্টের পরিমাণ ছিল ৬২ মিলিয়ন টন, যা ২০১০ সালে উৎপন্ন ই-ওয়েস্টের প্রায় দ্বিগুণ! এইভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের গোড়ায় এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৮২ মিলিয়ন টন!

আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের যেকোনও ইলেকট্রনিক গ্যাজেট খারাপ হলেই পরিণত হয় ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-ওয়েস্টে। এই ব্যাপারে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে আছে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলি, কারণ ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহারের প্রবণতা সেখানে অনেক বেশি। ২০২২ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইউরোপে মাথা পিছু ১৭.৬ কেজি, অস্ট্রেলিয়াতে ১৬.১ কেজি, আমেরিকাতে ১৪.১ কেজি, এশিয়াতে ৬.৪ কেজি ও আফ্রিকাতে মাত্র ২.৫ কেজি ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে কিছু খারাপ হলে সারানোর পরিবর্তে নতুন যন্ত্রপাতি কেনাই বেশি সাশ্রয়ী। এশিয়া ও আফ্রিকাতে ইলেকট্রনিক বর্জ্য কম উৎপন্ন হলেও এর কুফল তারাই বেশি ভোগ করে, কারণ উন্নত বিশ্ব বেশিরভাগ ই-ওয়েস্ট রপ্তানি করে ভারত, বাংলাদেশ, আফ্রিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। তারপর সেগুলো যতটা সম্ভব নিষ্কাশন করে আবার কাঁচামাল হিসাবে নিজেদের দেশে আমদানি করে।

আসলে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের চক্রে অধিকাংশ কোম্পানিই নিত্য নতুন পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত। স্মার্ট ফোনের ক্যামেরার সামান্য পরিবর্তন করে, বা দু-একটা নতুন ফিচার ঢুকিয়ে সব সময়ই হরেক রকমের মডেল মার্কেটে নিয়ে আসছে এই কোম্পানির। হয়তো অনেক সময় সে সব ফিচার কোনও কাজেই লাগে না আমজনতার। কিন্ত এর ফলে ইলেকট্রনিক বর্জ্য জমে জমে পাহাড় হচ্ছে। আগেকার ফোনগুলোর ব্যাটারি খুব সহজেই বদলানো যেত কিন্ত এখন প্রায় সব স্মার্ট ফোনে সোল্ডারিং ব্যাটারি ব্যবহার করায় ব্যাটারির সমস্যার জন্য সেগুলির জীবনকাল ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, আর পরিণত হচ্ছে ই-বর্জ্য পদার্থে। প্লাস্টিকের মতোই এদেরও বিনাশ করা বেশ শক্ত, কারণ এতে থাকা অধিকাংশ উপাদানই পরিবেশের সঙ্গে মেশে না।

আরও পড়ুন- গঙ্গার পবিত্র উৎসমুখে এবার মানববর্জ্য! গঙ্গোত্রীতে যে ভাবে ছড়াচ্ছে দূষণ

২০২২ সালে সারা বিশ্বে যে ৬২ বিলিয়ন কেজি ই-ওয়েস্টের হদিস মিলেছিল তার অর্ধেকটাই কোনও না কোনও খনিজ পদার্থ, আর বাকি অর্ধেকের সিকি ভাগেরও বেশি প্লাস্টিক। এতে থাকা বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, যেমন লেড, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, প্রভৃতি পরিবেশের প্রভূত ক্ষতিসাধন করছে, এমনকী এর ভিতরে ৫৮ হাজার কেজি পারদ ও ৪৫ মিলিয়ন কেজি প্লাস্টিক মিলেছে, পরিবেশের জন্য যেগুলি খুবই ক্ষতিকারক। এতে থাকা অ্যান্টিমনির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের চোখ, ত্বক, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস। এতে থাকা বিসমাথ আবার শ্বাসকষ্ট, অনিদ্রার মতো রোগের জন্যে দায়ী। ফুসফুসের ক্যানসার, পাকস্থলীর সমস্যা, আলসার, অ্যালার্জি প্রভৃতির উৎস ক্যাডমিয়াম, যেটি প্রায় প্রতিটি ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের প্রয়োজনীয় উপাদান, এমনকী অতি মাত্রায় এটি মানব দেহে প্রবেশ করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। থাইরয়েডের সমস্যা, অ্যাস্থমা প্রভৃতি বাড়ে কোবাল্টের জন্য। ই-বর্জ্যে থাকা আর একটি ক্ষতিকর খনিজ মলিবডেনাম, যেটি হাত, পা, হাঁটু, কনুই প্রভৃতি অঙ্গে ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া জীবজগৎ ও পরিবেশের ওপর লেড বা সীসার প্রভাব আমরা সবাই কম বেশি জানি। এর ফলে আমাদের মস্তিষ্ক, কিডনির ক্ষতি হতে পারে, বাড়তে পারে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা। এই উপাদানগুলি অসাবধানতা বশত আশে পাশে ফেলে দিলে, মাটির আর্দ্রতার সংস্পর্শে এসে ভূ-গর্ভস্থ জলকেও দূষিত করে।

কীভাবে মুক্তি মিলবে এর থেকে? সেজন্য আমাদের ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ বা এর রিসাইক্লিং সম্পর্কে জানতে হবে। সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যেই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। ধাতব এবং অধাতব উপাদানগুলির নিয়মমাফিক পৃথকীকরণ ও পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিকর পদার্থের প্রভাবকে অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। সে জন্য ই-বর্জ্য জমা ও বাছাই করার জন্য স্তূপ করে রাখা হয়। তারপরে ভেঙে বা গলিয়ে ফেলা হয়। তবে এই পদ্ধতিতে ঝুঁকিও রয়েছে। ই-বর্জ্য পদার্থ গলানোর সময় বাতাসে প্রচুর দূষিত গ্যাস মেশার আশঙ্কা থাকে, যেগুলি মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া বর্জ্য পদার্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ডিএনএ-র গঠনের ক্ষতি হতে পারে। বৈদ্যুতিন দ্রব্যের কেসিং-এর মধ্যে থাকা পলিভিনাইল ক্লোরাইড পরিবেশের ক্ষতি করে। ফলে ঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করলে এই বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণও বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।

আরও পড়ুন- ৬০৪টি তাজমহলকে ঢেকে ফেলতে পারে ভারতের প্লাস্টিক-বর্জ্য! সামনে এল যে ভয়ঙ্কর তথ্য

এক টন ই-ওয়েস্ট নিষ্কাশন করে প্রায় ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত সোনা পাওয়া যেতে পারে, যেখানে এক টন সোনার আকরিক থেকে মাত্র ৫ গ্রামের মতো সোনা পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলো নিজেদের দেশে এই ই-ওয়েস্ট রিসাইকেল করে না! কেন? কারণ সেখানে এইসবের জন্য কঠোর নিয়মনীতি রয়েছে। যার ফলে এই ই-ওয়েস্ট থেকে বিভিন্ন ধাতব পদার্থ নিষ্কাশন করতে যা খরচা লাগে, তার থেকে নিয়মে বা বেনিয়মে এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলিতে সেগুলি রপ্তানি করা সোজা, কারণ সেখানে শ্রমিক আইন অত কড়া নয়, শ্রমের দামও কম। যদিও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য অধিকাংশ কোম্পানিই প্রাকৃতিক খনিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। শুধুই উৎপাদন মূল্যের নিরিখে বিচার করলে হবে না, নিষ্কাশিত খনিজ পদার্থ নতুন ইলেকট্রনিক গেজেট তৈরিতে ব্যবহার করতে পারলে ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কিছুটা সহজ হবে, তাতে দাম একটু বেশি পড়তে পারে।

যে কোনও নতুন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কেনা মানেই পরিবেশে ই-ওয়েস্ট বাড়ানো। তাহলে এই আধুনিক যুগে, মানুষ ই-গ্যাজেট ব্যবহার বন্ধ করে দেবে? এটা কোনও সমাধান হতে পারে না। আমাদের সচেতন হতে হবে, সরকার ও প্রশাসনকে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে, এই সমস্ত নীতি বাক্য হাজারবার বলেও কোনও লাভ নেই। আগামীতে ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ব্যবহার কমানোই পথ। প্রয়োজন ছাড়া শুধু চোখের আরামের জন্যে বারবার স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ এসব না বদলানো, টুকটাক খারাপ হয়ে যাওয়া যন্ত্রাংশ বদলে পুনরায় যন্ত্রকে ব্যবহারের চেষ্টা করা, নিত্যান্ত ব্যবহারের অযোগ্য পদার্থগুলোকে এখানে ওখানে না ফেলে অন্তত নিষ্কাশনের সঙ্গে যুক্ত ফেরিওয়ালাদের কাছে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করা, মানসম্মত গ্যাজেট ব্যবহারের চেষ্টা করাই এর থেকে মুক্তির পথ। সরকারের কাছে দাবি জোরদার করতে হবে যে, শুধু আইন প্রণয়ন করে নয়, তার পর্যাপ্ত বাস্তবায়ন করে ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ আমরা একেবারে চরম সীমারেখার উপরেই দাঁড়িয়ে আছি!

More Articles