রোবোট দিয়ে অস্ত্রোপচার, স্কিৎজোফ্রেনিয়ার ওষুধ! বিজ্ঞান যে পথে এগোল এই বছরে

Medicine 2024: শরীরের যে অংশে অস্ত্রোপচার করা প্রায় অসম্ভব বা ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে অনায়াসেই দূর থেকে অস্ত্রোপচার করছে মিনিয়েচারাইজড ইন ভিভো রোবোটিক অ্যাসিসট্যান্ট

দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও একটা বছর। এবার একবার ঘুরে দেখার পালা। যেভাবে ইঁদুর দৌড়ে কতটা এগোলাম, সারা বছরে কোথায় কোথায় ঘুরলাম, কী কী করলাম, কতটা বড় হলাম বা বুড়ো হলাম, তার আমরা প্রত্যেকেই অল্প-বিস্তর হিসেব-নিকেশ করি, ঠিক তেমনই ফিরে দেখা যাক বিজ্ঞান কতটা এগোল এবছর। কেবল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই নয়, বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিপুল উন্নতি দেখেছে পৃথিবী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্দেশ্য সমাজের উন্নতি সাধন, মানুষের কল্যাণ সাধন। প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষকে ব্যতিরেকে তার সাফল্য মাপা যায় না। ২০২৪-এ বিজ্ঞান কীভাবে উন্নতি করল মানুষের? রইল তারই সংক্ষিপ্ত এক ফর্দ।

ক্যান্সার নিরাময়ের জন্যে প্রথমবার অনুমতি পেল সেল থেরাপি

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্বকের ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিআই) অনুমতি দিয়েছিল অ্যামট্যাগভি বা লিফাইলিউসেলকে। ত্বকের ক্যান্সার (মেলানোমা) নির্মূলের জন্য তৈরি করা এটি প্রথম সেলুলার থেরাপি, যেখানে রোগীর নিজের দেহের কোশকেই ব্যবহার করা হবে সেই রোগীরই ক্যান্সার নিরাময়ে। এক্ষেত্রে টি-সেলকে ক্যান্সার কোশ নির্মূল করতে ব্যবহার করা হয়।

এই সেলুলার থেরাপি বিশেষ করে সেই ধরনের ত্বকের ক্যান্সারের জন্য, যেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করেও ক্যান্সার নির্মূল হয় না কিংবা যে ক্ষেত্রে ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ধরনের ক্যান্সার ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং মৃত্যুর কারণও হতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে ক্যান্সার চিকিৎসায় এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ পরবর্তীতে মেলানোমা ছাড়াও অন্যান্য ধরনের ক্যান্সার নিরাময়ের পথ দেখাচ্ছে। এফডিএ-এর রিপোর্ট বলছে, এর আগে ত্বকের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য যে ধরনের ড্রাগ ব্যবহার করা হয়ে এসেছে, সেগুলির থেকে অনেক বেশি কার্যকরী এই অ্যামট্যাগভি বা লিফাইলিউসেল। পিডি-১ ব্লকিং অ্যান্টিবডি, বিআরএএফ ইনহিবিটার কিংবা বিআরএএফ ইনহিবিটারের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবহার করা এমএকে ইনহিবিটার এ যাবৎ ব্যবহৃত হওয়া ড্রাগগুলির মধ্যে অন্যতম।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে অ্যামট্যাগভির দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে রক্তাল্পতা, গুরুতর রোগ সংক্রমণ, হার্ট, ফুসফুস কিংবা কিডনির জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে জ্বর, ক্লান্তি, অস্বাভাবিক দ্রুত হার্ট রেট (ট্যাকিকার্ডিয়া), ডায়রিয়া, ফেব্রাইল নিউট্রোপেনিয়া, র‍্যাশ, রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরে অক্সিজেনের হার কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যেতে পারে।

আরও পড়ুন- জিনঘটিত রোগের মুশকিল আসান! যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল বিজ্ঞানীদের

স্কিৎজোফ্রেনিয়া চিকিৎসার যুগান্তকারী ওষুধ- কোবেনফাই

এ যাবৎ স্কিৎজোফ্রেনিয়া চিকিৎসার জন্য যে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলির কিছু সমস্যাজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল। ফলে চিকিৎসা শুরু হলেও প্রায়শই মাঝপথে হাল ছেড়ে দিতেন ভুক্তভোগীরা। ওষুধ বন্ধ হলে, আবার ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো ফিরে আসত। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে, মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা ব্রিস্টল মায়ার্স স্কুইব তৈরি করেছিল স্কিৎজোফ্রেনিয়া চিকিৎসার ওষুধ কোবেনফাই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিআই) এই ওষুধকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার করার অনুমতিও দিয়েছে ২০২৪ সালে। কোবেনফাইকে যুগান্তকারী ওষুধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ঘোষিতভাবেই এটি বিগত সত্তর বছরে আবিষ্কার হওয়া প্রথম স্কিৎজোফ্রেনিয়ার ওষুধ যা রীতিমতো চিকিৎসার ইতিহাসে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

কোবেনফাই আদতে জেনোমেলাইন আর ট্রস্পিয়াম ক্লোরাইড নামের দু’টি ড্রাগের মিশ্রণ। এ যাবৎ আবিষ্কার হওয়া স্কিৎজোফ্রেনিয়ার ওষুধের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতিতে কাজ করে এই ড্রাগ, আর সে জন্যই আশার আলো দেখাচ্ছে এই ওষুধ। এ যাবৎ স্কিৎজোফ্রেনিয়ার ওষুধগুলি সরাসরি ডোপামাইনের কাজে বাধা দিয়ে, রোগের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করত। ডোপামাইনের অভাব যেমন ক্ষতিকর, তেমন এর অস্বাভাবিক সক্রিয়তার ফলে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো সমস্যা দেখা যায়। কোবেনফাই সরাসরি ডোপামাইনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে না ঠিকই, তবে এটি ব্রেনের মাস্কারিনিক রিসেপ্টরের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। যা আবার ডোপামাইনের কাজকে প্রভাবিত করে।

কিন্তু কোবেনফাই কি পুরোপুরি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত? তা কিন্তু নয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গা গোলানো, বমি হওয়া, এমনকী কোষ্ঠকাঠিন্যও হতে পারে। তবে নির্মাতা সংস্থা সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নয়। অবশ্য স্কিৎজোফ্রেনিয়া অ্যান্ড সাইকোসিস অ্যাকশন অ্যালায়েন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড্যানিয়েল ফুলফোর্ড বস্টন ইউনিভার্সিটির এক সাংবাদিক প্রকাশনায় জানিয়েছেন, এই ওষুধ আশার আলো দেখাচ্ছে ঠিকই কিন্তু একে ‘যুগান্তকারী’ ওষুধ বলে দাগিয়ে দেওয়ার সময় এখনও আসেনি, অন্তত এযাবৎ হাতে আসা তথ্য দেখে তা এখনও বলা যায় না। পাশাপাশি তিনি এ কথাও জানিয়েছেন যে, কোবেনফাই অবশ্যই স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মূল উপসর্গ যেগুলি – যেমন হ্যালুসিনেশন, ডেলিউশন, দুঃশ্চিন্তা ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা – সেগুলির প্রায় ৩০ শতাংশের উপশম ঘটায়। এই মুহূর্তে বাজারচলতি অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ যেগুলি রয়েছে, সেগুলিও একইরকম ভাবে কার্যকারী হলেও, এগুলির কুপ্রভাব অনেক বেশি। ফুলফোর্ডের মতে, সেই কথা মাথায় রেখে এই ওষুধকে ‘গেম-চেঞ্জিং’ ড্রাগ বলা চলে।

স্কিৎজোফ্রেনিয়ার নির্দিষ্ট কারণ নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে বিজ্ঞানীমহলে। এবং এর কারণ একটি না-ও হতে পারে, বরং একাধিক কারণ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই কারণগুলির মধ্যে শারীরিক, জেনেটিক, মানসিক, এবং অবশ্যই পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাব রয়েছে। অধিকাংশ সময়েই এই বিষয়গুলো একে-অপরকে প্রভাবিত করে জটিল ভাবে কাজ করে।

আরও পড়ুন- গ্লোবাল ওয়ার্মিং আসলে একটি বিশুদ্ধ মিথ্যা? চমকে দেবে বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা

অস্ত্রোপচারের জন্যে অতি ক্ষুদ্র রোবোট তৈরি করলো ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা-লিঙ্কন

২০২৪ সালের ফেব্রিয়ারিতে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে সাফল্যের সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, সেই মাসেই মিনিয়েচারাইজড ইন ভিভো রোবোটিক অ্যাসিসট্যান্ট বা মিরাকে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার করার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিল এফডিআই। পৃথিবীর একমাত্র ক্ষুদ্র সার্জারি রোবোট এখন সাফল্যের সঙ্গে কোলেক্টোমিতেও উত্তীর্ণ হয়েছে। শরীরের যে অংশে অস্ত্রোপচার করা প্রায় অসম্ভব বা ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে অনায়াসেই দূর থেকে অস্ত্রোপচার করছে এই যন্ত্র। কম্পিউটারের মাধ্যমে দূর থেকেই এটিকে চালনা করা যায় এবং কীভাবে ও কোথায় যন্ত্রটি কাজ করছে, তা-ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

প্রথমবারের জন্যে সফল হ’ল বিলুপ্তপ্রায় গন্ডারের আইভিএফ

নর্দার্ন হোয়াইট রাইনোর একটি সাব-স্পেশিস এখন বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু এখনও আশার আলো দেখাচ্ছে নর্দার্ন হোয়াইট রাইনোর কৃত্রিমভাবে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনে সাফল্য। এই পদ্ধতি নর্দার্ন হোয়াইট রাইনোর আরেকটি সাবস্পেশিসে পরীক্ষা করে সফলও হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের রিপোর্ট বলছে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে নাজিন আর ফাতু নামে দু’টিই মাত্র নর্দার্ন হোয়াইট রাইনো বেঁচে রয়েছে। পৃথিবীর শেষ পুরুষ নর্দার্ন হোয়াইট রাইনোটি মারা গাছে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। অথচ এই সাব-স্পেশিস একসময়ে মধ্য আফ্রিকায় আকছার চোখে পড়ত। কিন্তু লাগামহীন গন্ডার হত্যার ফলে এরা এখন বিলুপ্তির পথে। দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা সাদা গন্ডারের এই সাব-স্পেশিসের স্টেম সেলকে কাজে লাগিয়ে নতুন ডিম্বাণু ও শুক্রাণু তৈরির চেষ্টা করছিলেন। অবশেষে কৃত্রিমভাবে তৈরি সেই জননকোশ থেকে ল্যাবরেটারিতে কৃত্রিমভাবে ভ্রূণ তৈরি এবং সাদার্ন হোয়াইট রাইনোর সাব-স্পেশিসে তার প্রতিস্থাপনে সাফল্যের মুখ দেখেছেন বিজ্ঞানীরা।

More Articles