স্যাটেলাইটকেও ফাঁকি! নজরদারি এড়িয়ে যে কৌশলে ফসলের গোড়া পোড়াচ্ছেন চাষিরা
Burning Crops Pollution: দুপুর ১.৩০টার পর থেকে ‘অ্যাকোয়া’ ও ‘সুওমি-এনপিপি’ স্যাটেলাইটের নজর এড়িয়ে কৃষকরা ফসলের গোড়া পোড়াচ্ছেন।
এ বছর নভেম্বরের প্রথম থেকেই দেশের রাজধানীর অবস্থা খারাপ। বাতাসের গুণগত মান সূচক এত নীচে নেমে এসেছিল যে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাওয়াও একপ্রকার দুষ্কর হয়ে ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের কড়া ধমকের পর দিল্লি সরকার নড়েচড়ে বসে। সেই সময় প্রশাসন ও পরিবেশকর্মীরা আঙুল তুলছিলেন পড়শি রাজ্য পঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকদের দিকে। মাঠ থেকে ফসল ঘরে তোলার পর, চাষের জমিতে পড়ে থাকা ফসলের গোড়া (চলতি ভাষায় যাকে আমরা ন্যাড়া বলি) পোড়ানোর ধোঁয়ায় নাকি দূষিত হচ্ছে দিল্লির আকাশ বাতাস। হ্যাঁ, খারিফ শস্য সংগ্রহের পর, সস্তায় দ্রুত মাঠ পরিষ্কারের জন্য পঞ্জাব হরিয়ানার চাষিরা প্রথাগতভাবে ফসলের গোড়া পোড়ান এবং দেশের উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বায়ুর সৌজন্যে সেই আগুনের ক্ষতিকারক পদার্থ নতুন দিল্লির বাতাসে মিশছে ঠিকই কিন্তু এটিই একমাত্র রাজধানীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে, বললে সিকিভাগ সত্যি কথাও বলা হবে না।
ঠিক কোথায় কোথায় পোড়ানো হচ্ছে ফসলের গোড়া, তা খুঁজতে স্যাটেলাইটের সাহায্য নিচ্ছে সরকার। ‘অ্যাকোয়া’ আর ‘সুওমি এনপিপি’ নামক নাসার দুটো স্যাটেলাইটের থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে ভারত সরকার। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিষয়ক তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০০২ সালে নাসা ‘অ্যাকোয়া’ নামক স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করে, যার ভেতরে একটি মডারেট ইমেজিং স্পেকট্রোরেডিওমিটার (MODIS) আছে, যার কাজ হলো নিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় অঞ্চলের যেকোনও পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা। MODIS-এর উন্নত ভার্সন হচ্ছে ভিসিবল ইনফ্রারেড রেডিওমিটার সুট (VIIRS), যেটি ‘সুওমি-এনপিপি’ স্যাটেলাইটের মধ্যে ইনস্টল করা আছে, এটি নাসা ২০১১ সালে উৎক্ষেপণ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণের জন্য। এই স্যাটেলাইট দু'টি স্থানীয় সময় দুপুর দেড়টা ও রাত দেড়টায় কোনও জায়গাকে পর্যবেক্ষণ করে। ফলে, তাদের মধ্যে থাকা MODIS ও VIIRS যন্ত্র দু'টি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওই সব জায়গার দৃশ্যমান
এবং অবলোহিত ছবি সংগ্রহ করে, যেগুলো বিশ্লেষণ করে আগুন ও ধোঁয়ার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ‘সুওমি-এনপিপি’-তে থাকা ওজোন ম্যাপিং এবং প্রোফাইলার স্যুট বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসলের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে, যা আগুন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া এবং বায়ু দূষণে তাদের ভূমিকাও নির্ধারণ করতে সক্ষম।
আরও পড়ুন- দরিদ্র দেশের উপর দূষণের অভিশাপ চাপিয়ে দিচ্ছে ধনী দেশ
গণ্ডগোল বাঁধে অন্য জায়গায়। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের এক বিজ্ঞানী, হিরেন জেথভা ২ অক্টোবর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ৪০% কম ন্যাড়া পোড়ার ঘটনা ঘটেছে এবং তিনি আশাবাদী এবছরও সেই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে৷ সপ্তাহ তিনেক পরে, ২৪ অক্টোবর তিনি আবার লেখেন, “২০২৪ সালে শস্যের মাঠে আগুনের সংখ্যা গত দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন বলে মনে হচ্ছে।" তিনি আরও অনুমান করেন যে, "প্রশাসনের সক্রিয়তায় ন্যাড়া পোড়ানোর ঘটনা কমেছে বা স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ এবং ওভারপাসের পর পোড়ানোর কাজ সংঘটিত হচ্ছে, তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও স্থানীয় তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন”। অর্থাৎ
তাঁর বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, দুপুর ১.৩০টার পর থেকে ‘অ্যাকোয়া’ ও ‘সুওমি-এনপিপি’ স্যাটেলাইটের নজর এড়িয়ে কৃষকরা ফসলের গোড়া পোড়াচ্ছেন।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ২০১৮ সালে GEO-KOMPSAT 2A নামক একটি "জিওস্টেশনারি ওয়েদার স্যাটেলাইট" (ভূসমলয় উপগ্রহ) উৎক্ষেপণ করে, যার কাজ পৃথিবীতে আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য পাঠানো। জেথভা এটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে ‘অ্যাকোয়া’ ও
‘সুওমি-এনপিপির’ তথ্যের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখেন যে পঞ্জাব ও হরিয়ানার ফসলি জমির উপর ধোঁয়ার আবরণ ক্রমাগত ঘন হয়ে আসছে। অর্থাৎ অ্যাকোয়া এবং সুওমি-এনপিপির পর্যবেক্ষণের পরে, কৃষকরা মাঠে আগুন জ্বালাচ্ছেন। এই প্রবীণ বিজ্ঞানী আরও লেখেন যে, বাতাসে অ্যারোসলের পরিমাণ মোটামুটি আগের বছরগুলির মতোই ছিল কিন্তু অ্যাকোয়া এবং সুওমি-এনপিপি অনেক কম সংখ্যক আগুনের ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছিল।
আরও পড়ুন- গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জিয়নকাঠি! যেভাবে পরিবেশের সর্বনাশ করছে কার্বন ডাই অক্সাইড
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই গরমিল কেন? এটা কতটা বাস্তবসম্মত?
২০২০ সালে, ভারত সরকার একটি কমিশন গঠন করে এবং ২০২১ সালে দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বায়ুর গুণমান নিয়ন্ত্রণের জন্য সংসদে আইন করে CAQM নামে একটি কমিশন গঠন করে, যার কাজ হলো বায়ুর উন্নতির জন্য সমস্যাগুলি আলোচনা করা, শনাক্ত করা এবং তাদের সমাধানের উপায় বের করা। এই কমিশন জনসাধারণের মধ্যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে, ফসলের মাঠে আগুনের সংখ্যা কমে গেছে আগের চেয়ে। যদিও স্থানীয় চাষিদের থেকে জানা গেছে, কিছু সরকারি কর্মকর্তা তাদের বিকাল চারটের পর ফসলের গোড়া পোড়াতে বলেছিলেন। এই CAQM সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৬.৪% আগুন লাগানোর ঘটনা কমেছে। ওদিকে পঞ্জাব সরকার এবং ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাপ্ত তথ্য বলছে আগুন লাগার ঘটনা যথাক্রমে ২৪% ও ১৫% কমেছে।
সুপ্রিম কোর্টের কাছে অভিযোগ আগে থেকেই ছিল যে স্যাটেলাইটগুলির পর্যবেক্ষণের সময় কৃষকরা আগে থেকেই জানতেন এবং এই ঘটনার সঙ্গে কিছু সরকারি আধিকারিক জড়িত। বছরের পর বছর ধরে আগুনের ফলে সৃষ্ট বায়ু দূষণ প্রশমিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট CAQM-কে সম্প্রতি তিরস্কার করেছে। এসবের মধ্যে আবার কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান দাবি করেন, খড় পোড়ানোর ঘটনা অন্য বছরের তুলনায় এ বছর কমেছে। সুপ্রিম কোর্টে CAQM আরও জানিয়েছে যে, তারা ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ISRO) অধীনস্থ সংস্থা, NRSC-কে পোড়া এলাকা পরিমাপের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল তৈরি করতে বলেছে। বর্তমানে,
পোড়া এলাকার তথ্য প্রতি পাঁচদিনে একবার আসে CAQM-এর কাছে, যেটি থেকে সঠিক পর্যালোচনা করা কঠিন।