পাড় ভেঙে দুর্দশায় লাখো মানুষ! গঙ্গা ভাঙন রোখার কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে কোথায়?
Ganga River Bank Erosion: দেড় লাখ পরিবারের মধ্যে মাত্র দশ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন দিয়েছে সরকার। সেটাও আবার গনি খান চৌধুরীর সময়ে— ১৯৭৬-৮০ সময়কালে।
শাসক বদলায়, বদলায় না আম জনতার দৈন্যদশা। গঙ্গা ভাঙনে মালদা ও মুর্শিদাবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখো লাখো পরিবার। প্রাকৃতিক নয়, এই গঙ্গা ভাঙনকে ‘ম্যান মেড’ বলছে ‘গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি’। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের দাবি, আগে গঙ্গা ভাঙন হতো প্রকৃতির নিয়মে। একূল ভাঙলে ওকূল গড়ত। তাছাড়া তখন এত তীব্রতাও ছিল না গঙ্গা ভাঙনের। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্রিজ নির্মাণের পর থেকেই এই সমস্যার সূত্রপাত। গঙ্গা তার প্রায় ২০০০ কিলোমিটার গতিপথে যে পলিমাটি বহন করে আনে, তা ফারাক্কা ব্রিজের কারণে নিচের দিকে বয়ে যেতে পারে না। ফলে পাটনা থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত প্রায় ৪০টি বড় বড় চর তৈরি হয়েছে পলিমাটি জমে। বর্ষার সময় যখন অতিরিক্ত জল আসে, তা এসে ধাক্কা মারে নদীর পাড়ে এবং বাঁধ ভাঙে। যার কারণে গঙ্গার তলায় চলে যাচ্ছে মানুষের ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি সব।
এখানে বলে রাখা ভালো, বন্যা আর নদী ভাঙন এক নয়। বন্যার কারণে সাময়িক ক্ষয়ক্ষতি হয় কিন্তু জল একসময় নেমে যায়। স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষদের জীবন। কিন্তু নদী ভাঙনে চিরতরে জলের তলায় চলে যায় মানুষের ভিটে-মাটি, চাষের জমি।
আরও পড়ুন- গঙ্গার পবিত্র উৎসমুখে এবার মানববর্জ্য! গঙ্গোত্রীতে যে ভাবে ছড়াচ্ছে দূষণ
গঙ্গা ভাঙন রোধের জন্য যারা লড়াই করছেন, মালদায় এমন কিছু যোদ্ধার সঙ্গে দেখা করে সেখানের সমস্যাগুলি জানার চেষ্টা করি ২০২৪-এর ডিসেম্বরে। তাঁদের একজন মোসারেকুল আনোয়ার। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে জানতে পারি, মালদা জেলার ৫টি ব্লক (কালিয়াচকের ১, ২, ৩ ও মানিকচক এবং রতুয়া ব্লক) এবং ৭৬টি মৌজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে গঙ্গা ভাঙনের ফলে। প্রায় ১ হাজার স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে গঙ্গা ভাঙনের শিকার ৭-৮ লাখ মানুষ এবং প্রায় দেড় লাখ পরিবার। মুর্শিদাবাদে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩-৪ লক্ষ মানুষ। যাদের অনেকেই সম্পন্ন পরিবারের। তারা আজ জমি-ভিটে হারিয়ে একপ্রকার উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছেন। যারা পেরেছেন নদীর ধার থেকে দূরে গিয়ে অন্যত্র জায়গা কিনে আবার বাড়ি করেছেন, কেউ বা সরকারের PWD জায়গায় থাকছেন। নদীর চরেও বাস করছেন বহু মানুষ। সংখ্যাটা প্রায় আড়াই লক্ষ। আবার অনেকেই নদীর ধারেই ভয়ে ভয়ে রাতের পর রাত কাটাচ্ছেন। এই বুঝি আবার এক ধাক্কায় তলিয়ে যাবে তাদের ঘর— এই চিন্তা মাথায় নিয়েই ঘুমোতে যাচ্ছেন প্রতি রাতে।
দশকের পর দশক ধরে গঙ্গার রোষে ভুগছে পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলা। গঙ্গা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকাও। যার কারণে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফারাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার দাবিও তুলেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গঙ্গা ভাঙনকে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ বলে ঘোষণা করেনি কেন্দ্র সরকার। রাজ্য সরকারের ভূমিকাতেও খুশি নয় মালদা-মুর্শিদাবাদের মানুষ। মোসারেকুল আনোয়ার বলেন, এখনও পর্যন্ত দেড় লাখ পরিবারের মধ্যে মাত্র দশ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন দিয়েছে সরকার। সেটাও আবার গনি খান চৌধুরীর সময়ে— ১৯৭৬-৮০ সময়কালে।
গঙ্গা ভাঙন রোধেও রাজ্য সরকারের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। ভাঙন রুখতে সরকার যে অর্থ বরাদ্দ করে, তার বেশিরভাগই নয়ছয় হয়ে যায়! 'গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি’র এক সদস্যের কথায়, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “গঙ্গা ভাঙন রোধে ১৪০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। অথচ আমরা মালদার বিভিন্ন ভাঙন এলাকায় গিয়ে রিভিউ করে ১৫ কোটি টাকার কাজও খুঁজে পাইনি। বরাদ্দ অর্থের ৩০% অর্থ ভাঙন রোধে কাজে লাগালে ৭০% অর্থ লুট হয়ে যায় স্থানীয় নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে”। তাঁর মতে, বালির বস্তা দিয়ে গঙ্গা ভাঙন রোধ সম্ভব নয়। তাঁদের ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, পাথরের রিং করে, নেট দিয়ে, ৮টা বাঁধ করেও এই গঙ্গা ভাঙন আটকানো যায়নি। তাই বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা মানে টাকা জলে ফেলে দেওয়া।
আরও পড়ুন-ধূ ধূ মরুভূমিতে শস্য-শ্যামল কৃষিক্ষেত! যেভাবে অসাধ্যসাধন করেছিলেন রাজা গঙ্গা সিং!
তাহলে গঙ্গা ভাঙন রোধ কীভাবে সম্ভব? ‘গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি’র দাবি, নতুন এক টেকনোলজি বেরিয়েছে জিওসিন্থেটিক ব্যাগ। যে ব্যাগের দৈর্ঘ্য ৮০ ফুট, প্রস্থ ২০ ফুট, উচ্চতা ১০ ফুট। এই জিওসিন্থেটিক ব্যাগে বালি ভর্তি করলে ৩০০ টন ওজন হবে। নদীর পাড়ে এই জিওসিন্থেটিক বালির বস্তার পাহাড় তৈরি করতে হবে। আর নদীর মাঝে যে ছোট ছোট চর তৈরি হয়েছে তা কেটে পাড়ে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে নদীর জলপ্রবাহ সোজা বেরিয়ে যাবে। ফলে নদীর পাড়ে জলের ধাক্কা কম এসে লাগবে ফলে ভাঙনও কমবে। কিন্তু সরকার তা করছে না আর পুনর্বাসনও দিচ্ছে না ক্ষতিগ্রস্তদের। ফলে বিশ বাঁও জলে গঙ্গা ভাঙন রোধের চেষ্টা।
বছরের পর বছর গঙ্গা ভাঙন রোধ হবে এই আশা দিয়ে লক্ষ লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভোট নিয়ে যে-ই ক্ষমতায় আসছে, ভোটের পর প্রতিশ্রুতি ভুলে যাচ্ছে। জীবন জীবিকা চালাতে পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে এই দুই জেলার পুরুষরা। গ্রামের পর পর গ্রামে মহিলারা বিড়ি বেঁধে সংসারের ঘানি টেনে চলেছেন। আর একটা বছর। ফের রাজ্যে গদি দখলের লড়াই। ক্ষমতা ধরে রাখতে হয়তো আবারও গঙ্গা ভাঙন রোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। কিন্তু বরাবরের মতোই লঙ্কায় রাবণই সিংহাসনে বসবে! আর কবে ক্ষতিপূরণ পাবে গঙ্গা ভাঙনে নিঃস্ব মানুষরা?