মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত কিনা বাড়িতে বসেই জানতে পারবেন! তাক লাগাচ্ছে নতুন যে প্রযুক্তি
Monkeypox Test: সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই মাঙ্কিপক্স নিয়ে সাবধান না হলে তা মহামারী বা প্যান্ডেমিকের আকার ধারণ করবে।
মাঙ্কিপক্স ছড়ায় মূলত পশু ও সংক্রমিত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষের মধ্যে। এই রোগের উপসর্গ বলতে জ্বর, গায়ে ব্যথা, র্যাশ বা গুটি বেরনো, ক্ষত তৈরি হওয়া, লিম্ফ নোডে জল জমাই অন্যতম। কিন্তু এই উপসর্গগুলির বেশিরভাগেরই, অন্যান্য ভাইরাল ইনফেকশনের সঙ্গে মিল রয়েছে। আর ঠিক সেই কারণেই শরীরে উপসর্গ বয়ে বেড়ানো একজন মানুষকে চোখে দেখে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, তিনি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কিনা। এর জন্য কিছু পরীক্ষর প্রয়োজন হয়। মাঙ্কিপক্স শনাক্তকরণের জন্যে এই মুহূর্তে স্বীকৃত পরীক্ষাগুলির মধ্যে কেবল পিসিআর টেস্ট বা পলিমারেজ চেইন রিয়্যাকশন টেস্টই রয়েছে। কিন্তু কোভিড মহামারীর সময়ে আমরা দেখেছি, পিসিআর টেস্টের রিপোর্ট আসতে কতটা সময় লাগে! পাশাপাশি, বিষয়টিও বেশ খরচসাপেক্ষও।
আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলির ক্ষেত্রে এই ব্যয়বহুল পরীক্ষা করাতে আরও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। খরচের ভয়ে পরীক্ষাই করাতে চান না অনেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে মাঙ্কিপক্স যে হারে ছড়াচ্ছে তাতে এই রোগ যে কোনও সময়ে মহামারীর আকার নিতে পারে, আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। সেই সমস্ত কথা মাথায় রেখে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিন ও বস্টন ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী ও গবেষক মিলে একটি অপটিক্যাল সেন্সার তৈরি করেছেন, যা নিমেষেই মাঙ্কিপক্স শনাক্ত করবে। গত মাসেই এই গবেষণাটি ‘বায়োসেন্সার অ্যান্ড বায়োইলেকট্রনিক্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুন- গ্লোবাল ওয়ার্মিং আসলে একটি বিশুদ্ধ মিথ্যা? চমকে দেবে বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা
বিশ্বজুড়ে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের হার
এই ডিএনএ-যুক্ত ভাইরাসকে দু'টি শাখায় ভাগ করা হয় – ক্লেড ১ ও ২। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে কঙ্গো এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে ৫০,০০০-এর বেশি মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে এবং এই কারণে ১,০০০-এর বেশি মৃত্যু হয়েছে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেছে সেন্ট্রার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৯,০০০-টি ঘটনাকে মাঙ্কিপক্স বলে
সুনিশ্চিত করা গেছে।
এছাড়াও সংক্রমিত অঞ্চল থেকে ভ্রমণ করে কানাডা, জার্মানি, ভারত, কেনিয়া, সুইডেন, থাইল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাম্বিয়া, জিম্বাবোয়েতে যাওয়ার প্রভাবে এই দেশগুলিতেও ছড়িয়েছে সংক্রমণ। গত মাসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবার ক্লেড ১ মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা সামনে এসেছে। তবে সেক্ষেত্রে সংক্রমিত ব্যক্তি মাঙ্কিপক্স-আক্রান্ত অঞ্চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে সারাবিশ্বের ১২২টি দেশ থেকে প্রায় এক লাখ ক্লেড ২ মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা নজরে এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে। যার মধ্যে আবার ১১৫ টি দেশে এর আগে কখনও মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুনে ক্লেড ১ ও ২ উভয়ের সংক্রমণের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে ঘটে থাকলেও, অন্যন্য অনেক দেশে এই ঘটনা প্রথম।
বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্স এখনও অতিমারি বা এন্ডেমিকের রূপে থাকলেও, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই মাঙ্কিপক্স নিয়ে সাবধান না হলে তা মহামারী বা প্যান্ডেমিকের আকার ধারণ করবে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানী ডঃ পার্থ রায় এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি সাংবাদিক প্রকাশনায় তিনি বলেছেন,
যে কোনও সংক্রামক রোগের মতোই, মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ রুখবার প্রথম ধাপই হলো একদম ঠিক সময় রোগটিকে শনাক্ত করা। আর যার জন্য অত্যাবশ্যক এমন প্রযুক্তির যা স্বল্প খরচে দ্রুত জানান দেবে, কোনও ব্যক্তি আদৌ মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত কিনা।
“মাঙ্কিপক্সের উপসর্গগুলির যেহেতু হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস ও কাউপক্স ভাইরাসের সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে, তাই অন্যান্য ভাইরাল ইনফেকশনের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সকে আলাদা করা ভীষণ জরুরি”, ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন ডঃ পার্থ রায়।
আরও পড়ুন- মেঘ পাতলা করা, সূর্যরশ্মি আটকে দেওয়ার নামে যে বিপুল ক্ষতি করছেন জিও-ইঞ্জিনিয়াররা
সিঙ্গেল পার্টিকেল ইন্টারফেরোমেট্রিক রিফ্লেকটেন্স ইম্যাজিং সেন্সর টেকনোলজি প্রযুক্তি আসলে কী?
প্রথমত এই প্রযুক্তি নমুনা পরীক্ষা করে ডিজিট্যালি জানান দেবে কোনও ব্যক্তির মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ ঘটেছে কিনা। শনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত অপটিক্যাল সেন্সর কোনও লেবেল ব্যবহার করে না। এলাইজার মতো অনেক ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়া শনাক্তকারী প্রযুক্তি ‘লেবেল’ ব্যবহার করে। এই লেবেল আসলে একটি রাসায়নিক মৌল যা অ্যান্টিজেনের গায়ে ‘ট্যাগ’ হিসেবে আটকে গিয়ে অ্যান্টিজেনের
উপস্থিতি জানিয়ে দেয়। অ্যান্টিজেন আসলে ব্যাক্টিরিয়া বা ভাইরাসের কোশে থাকা প্রোটিন। আবার এই লেবেল সংক্রামক অণুজীবের ডিএনএ বা আরএনএ মৌলের সঙ্গেও ‘ট্যাগ’ হতে পারে। নতুন এই প্রযুক্তিতে অন্তত সেই জটিলতা নেই।
এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন ‘ইন্টারফেরোমেট্রিক রিফ্লেকটেন্স ইম্যাজিং সেন্সর টেকনোলজি' বা আইআরএস। তাঁদের নিজেদের ল্যাবে আগে তৈরি ‘সিঙ্গেল পার্টিকেল ইন্টারফেরোমেট্রিক রিফ্লেকটেন্স ইম্যাজিং সেন্সর টেকনোলজি’-কে আরেকটু ঘষামাজা করে এবার তাঁরা মাঙ্কিপক্স শনাক্ত করার কাজে লাগিয়েছেন।
খুব সোজাভাবে যদি বলা যায়, এই প্রযুক্তি পুরোই আলোর খেলা। সিঙ্গেল পার্টিকেল ইন্টারফেরোমেট্রিক রিফ্লেকটেন্স ইম্যাজিং সেন্সর টেকনোলজি এপিইল্যুমিনেশন বা রিফ্লেক্টেড লাইট মাইক্রোস্কোপি নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে আলোর উৎস আর ডিটেক্টর একই দিকে অবস্থান করে। আলো এসে নমুনার (এক্ষেত্রে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস ও তার গায়ে আটকানো অ্যান্টিবডি) গায়ে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটালে সেই আলোই প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে আসে আলোর উৎসের দিকে, যেখানে বসিয়ে রাখা রয়েছে ডিটেক্টর। অ্যান্টিজেনের উপস্থিতির কারণে বিচ্ছুরিত হওয়া আলোর তরঙ্গে কিছু অদলবদল হয়, যা শনাক্ত করবে ডিটেক্টর। আলোর সাহায্যেই জানা যায় কোনও ব্যক্তির শরীর থেকে সংগ্রহ করা নমুনাতে মাঙ্কিপক্স রয়েছে কিনা।
নির্দিষ্ট তালা যেমন নির্দিষ্ট চাবি দিয়েই খোলে, ঠিক তেমনই নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন, নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেই বিক্রিয়া শুরু হবে। সেই বিক্রিয়া উল্টোদিক থেকে আসা আলোর তরঙ্গেও কিছু অদলবদল ঘটাবে। ডঃ পার্থ রায়ের মতে, “আমাদের তৈরি এই প্রযুক্তি এলাইজা টেস্টের থেকেও নির্ভুল।" ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি যাচাই করতে এলাইসা টেস্টের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে গোটা বিশ্বের ক্লিনিকগুলি কিন্তু এই প্রযুক্তিতে এলাইজার মতো লেবেল ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন- ধর্ষণের আগে ধর্ষিতা পালাতে কেন পারেন না? বিজ্ঞান কী বলছে?
ইন্টারফেরোমেট্রি কী?
নাম শুনেই বোঝা যায় ইন্টারফেরোমেট্রিক রিফ্লেকটেন্স ইম্যাজিং সেন্সর টেকনোলজি ইন্টারফেরোমেট্রির সাহায্য নেয়। গবেষণা বলছে, নমুনায় খুব সামান্য পরিবর্তন শনাক্ত করার জন্য ইন্টারফেরোমেট্রি অত্যন্ত শক্তিশালী ও উপযোগী একটি পদ্ধতি। এবং এই প্রযুক্তি যদি অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপিতে ব্যবহার করা যায়, তাহলে জৈব ন্যানোপার্টিকলে সামান্য অদলবদল হলেও নজরে আসবে। রাসায়নিক লেবেল দিয়ে তাদের দাগিয়ে না দিয়েই চিহ্নিত করা যাবে।
কিন্তু এই আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে খুব অল্প কিছু কথায় বুঝতে হবে ন্যানোপার্টিকল কী? এক মিটারকে যদি একশো কোটি ভাগে ভাগ করা যায়, তাহলে এক ন্যানোমিটার আকারের একটি কণা পাওয়া যায়। সোজাভাবে বললে, আপনার হাত থুতনি অবধি যাওয়ার সময়ের মাঝে, যে পরিমাণ দাঁড়ি বেড়ে উঠল, সেটা কম-বেশি এক ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের সমান।
এবার এত ছোট কোনও কণায় কিছু রদবদল ঘটছে কিনা তা খুব কম সময়ে জানান দেওয়া সোজা না। আর সেই জন্যই ইন্টারফেরোমেট্রির সাহায্য নিতে হয়। ইন্টারফেরোমেট্রি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যার সাহায্যে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো কীভাবে কোনও পদার্থের (এক্ষেত্রে ভাইরাস কিংবা ভাইরাসের অ্যান্টিজেন) সঙ্গে আদানপ্রদান করে এবং তার ফলে সেই আলোর তরঙ্গের চরিত্রে কী পরিবর্তন আসে তার হিসেব করা। এই পরীক্ষার সময় অ্যান্টিজেন অণুটিকে আবদ্ধ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন এ-২৯ মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি। কিন্তু অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির জটিল রাসায়নিক আদানপ্রদান ছাড়াও, ডিএনএ-ডিএনএ বা প্রোটিন-ডিএনএ-এর রসায়নিক আদানপ্রদানও পরীক্ষা করা যাবে ইন্টারফেরোমেট্রির সাহায্যে।
ইন্টারফেরোমেট্রির প্রয়োগ যে কেবল অ্যান্টিবডির সাহায্যে অণুজীবের উপস্থিতি শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হয়, তা ভাবলে ভুল হবে। সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং, ওশানোগ্রাফি, ভূমিকম্পের তরঙ্গের মাপজোক করা, এমনকী জ্যোতির্বিজ্ঞানেও এর ব্যবহার বহুলভাবে দেখা যায়।
অপটিক্যাল সেন্সর
ইন্টারফেরোমেট্রির জন্য প্রয়োজন একটি সেন্সর, যা তৈরি হয় সিলিকন-সিলিকন ডাইঅক্সাইড দিয়ে। সেই সেন্সরের উপরেই নমুনা (এক্ষেত্রে ভাইরাস পার্টিকল ও তার সঙ্গে লেগে থাকা অ্যান্টিবডি) রাখা থাকে। এর পর সেন্সরে রাখা স্যাম্পেলে একইসঙ্গে একাধিক নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ফেলা হয়। সেই আলোর তরঙ্গ নমুনার সংস্পর্শে এলে, সেই তরঙ্গে কী কী পরিবর্তন আসছে, তা উল্টোদিকে বসে থাকা একটি ক্যামেরা রেকর্ড করে। আর সেই পরিবর্তন থেকেই বোঝা যায় নমুনায় মাঙ্কিপক্স রয়েছে কিনা। ডঃ পার্থ রায়ের মতে,
“স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা বাড়িতে বসেই অল্প সময়ে কোনও রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবের উপস্থিতি ধরে ফেলবে নতুন এই প্রযুক্তি।"