প্রান্তিক মানুষকে উচ্ছেদ করেই কেন বাস্তবায়নের মুখে দেশের প্রথম নদী সংযোগ প্রকল্প?
Ken-Betwa project: দেশের উন্নয়নের বলি হিসেবে বারবার প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা বারেবারে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। কেন এমনটা ঘটে?
অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে স্বাধীন ভারতে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলি, বেশিরভাগ সময়ই দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্থানচ্যুত করেছে, যে মানুষগুলির জীবন জীবিকার অনেকটাই প্রকৃতি নির্ভর। ভারতে উন্নয়নের কারণে স্থানচ্যুতির সমস্যা নজর কাড়ার মতো, যার কোনও সুস্থ সমাধান আজও বেরিয়ে আসেনি। স্বাধীনতার পর নদীবাঁধ নির্মাণ, শহর সম্প্রসারণ, শিল্প স্থাপন, রাস্তা এবং রেলপথ তৈরি ইত্যাদিতে - কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। চাষের জমি হারিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আদিবাসী ও গ্রামীণ গরিব জনগোষ্ঠীর মানুষ। উচ্ছেদ হওয়া অনেকেরই সঠিক পুনর্বাসন হয়নি। এমনকী পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও পাননি। কেন-বেতওয়া নদী সংযোগ প্রকল্প সেরকমই আর একটি উন্নয়নমুখী প্রকল্প।
গত ২৫ ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহে, দেশের প্রথম ‘নদী সংযোগ' বা 'রিভার লিংকেজ’ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই প্রকল্পে যুক্ত করা হবে মধ্যপ্রদেশের ‘কেন’ এবং উত্তরপ্রদেশের ‘বেতওয়া’ নদীকে। ২৩০ কিমি দীর্ঘ খাল খনন করে কেন নদীর জলকে বেতওয়া নদীতে নিয়ে আসা হবে। ভারতের জাতীয় নদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় এটিই প্রথম নদী সংযোগ প্রকল্প। নদী সংযোগের উদ্দেশ্য যে নদীতে জলের প্রাচুর্য রয়েছে সেখান থেকে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে জলের সরবরাহ বাড়ানো। কেন ও বেতওয়া নদীকে জুড়ে দিলে মধ্যপ্রদেশের ১০টি এবং উত্তরপ্রদেশের ৪টি জেলার মানুষ সরাসরি উপকৃত হবেন। খরাপ্রবণ বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে কৃষির উন্নতি ঘটবে এবং পানীয় জলের সংকট দূর হবে। তাছাড়া জলবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই নদী সংযোগ প্রকল্প প্রায় ৬২ লাখ মানুষকে পানীয় জল সরবরাহ করার পাশাপাশি প্রতি বছর প্রায় ১০.৬২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের সুবিধা দেবে এবং ১০৩ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ ও ২৭ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপন্ন করবে। প্রকল্পের শিলান্যাস করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ অর্থনৈতিকভাবে দেশের শীর্ষে উঠে আসবে এবং সেই কাজে বুন্দেলখণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।"
কেন-বেতওয়া নদী সংযোগ প্রকল্পের রূপরেখা অনুযায়ী কেন নদীর উপর ৭৪ মিটার উঁচু ‘দাউধান ড্যাম’ নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪,৬০৫ কোটি টাকা। একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের কারণে প্রায় ৭২ শতাংশ পরিবার ভূমিহীন হতে চলেছে। ৭ শতাংশ মাঝারি চাষি, ক্ষুদ্র চাষিতে রূপান্তরিত হবেন এবং ২১ শতাংশ ক্ষুদ্র চাষি, প্রান্তিক চাষি হয়ে যাবেন। ভালো অংশের বড় চাষিরা জমি হারিয়ে ‘বড় কৃষকের’ মর্যাদা হারাতে চলেছেন এবং কৃষিই যাঁদের একমাত্র জীবিকা তাঁরা জমি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বেন। তাঁদের নিয়মিত পারিবারিক আয় ধাক্কা খাবে। প্রকল্পটি পান্না, ছাতারপুর এবং টিকামগড় জেলা থেকে প্রায় ৬৮০০ পরিবারের কম বেশি ২০ হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করবে। উত্তরপ্রদেশের হামিরপুর এবং জালাউন জেলার গ্রামগুলিতেও এর প্রভাব পড়বে, যাঁদের বেশিরভাগই প্রান্তিক মানুষ।
আরও পড়ুন- শুকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী! যে ভয়াবহ বিপদের মুখে আমাজন নদী
উচ্ছেদ ও নজরকাড়া প্রকল্প
১৯৫০ সালের পর থেকে ভারতে বেশ কিছু বড় বড় নদীবাঁধ তৈরি হয়েছে, যা ওই অঞ্চলগুলির জনবসতিকে উচ্ছেদ করেছে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুজরাতে নর্মদা নদীর উপর সর্দার সরোবর ড্যাম, ওড়িশার মহানদীতে হিরাকুঁদ বাঁধ, উত্তরাখণ্ডের তেহরি নদীবাঁধ, অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা নদীতে নাগার্জুনসাগর বাঁধ, মধ্যপ্রদেশের নর্মদা নদীতে ইন্দিরা সাগর বাঁধ – এগুলি নির্মাণ করতে গিয়ে কোথাও ৫০ হাজার তো কোথাও ২ লাখ পর্যন্ত মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন। এছাড়াও দেশে আরও প্রায় ৫ হাজার ছোট-বড় নদীবাঁধ নির্মাণ হয়েছে। সেই নির্মাণে উচ্ছেদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে একাধিক গবেষণা ও প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৫০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে আনুমানিক ৬ কোটির বেশি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন। ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং ছত্তিশগড়ে কয়লাখনির জন্য অনেক আদিবাসী এবং গ্রামীণ মানুষ তাঁদের জমি হারিয়েছেন। স্বাধীন ভারতে উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ কিংবা বনাঞ্চল ধ্বংস করতে কখনও আইনকে কাজে লাগানো হয়েছে, কখনও আবার বল প্রয়োগ করা হয়েছে। রাষ্ট্র-কর্পোরেট আঁতাতের ফলে বৃহৎ কোম্পানির হাতে বিপুল পরিমাণ জমি তুলে দিতে গিয়ে সরকার লাখো লাখো মানুষকে তাঁদের নিজের জমি বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে।
কী কারণে প্রান্তিক মানুষদের উচ্ছেদ
দেশের উন্নয়নের বলি হিসেবে বারবার প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা বারেবারে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। কেন এমনটা ঘটে?
• দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষের দখলে থাকা জমিগুলি সম্পর্কে সরকার এবং কর্পোরেশনগুলির একটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তারা মনে করে জমিগুলি 'অব্যবহৃত' বা 'মূল্যহীন' । ফলে, অধিগ্রহণের জন্য সেগুলিকে আগে বিবেচনা করা হয়।
• রাজনীতিবিদ থেকে আমলা যারা ক্ষমতায় থাকেন, নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরা প্রায়শই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেয়ে ধনী বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন।
• সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের অভাবে বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই একতরফা হয়ে যায়।
• উন্নয়ন প্রকল্পগুলি খনিজ পদার্থ, জল কিংবা কাঠের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের উপর জোর দেয়। এই সম্পদ-সমৃদ্ধ এলাকাগুলি তুলনায় অনুন্নত। এখানে মূলত দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য পিছড়েবর্গের বাস। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের উন্নয়ন খনি বনাঞ্চলে বসবাসকারী প্রন্তিক মানুষদের স্থানচ্যুতি ঘটায়।
• দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে নির্মাণ বা খননের কাজ চালালে সেখানে উচ্ছেদ হওয়া জনগণকে সস্তায় কাজে লাগানো যায়। ফলে সস্তায় শ্রমিকের সরবরাহ পাওয়া এই উচ্ছেদের অন্যতম কারণ।
• বাঁধ, রাস্তা এবং সেতু ইত্যাদি পরিকাঠামো নির্মাণও গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করে বেশি।
উচ্ছেদ হওয়া জনগণের বেশিরভাগটাই আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া। ফলে সমাজে বিদ্যমান সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রান্তিক মানুষগুলিকে প্রতিদিন আরও প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাস্তুচ্যুতি তাঁদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
আরও পড়ুন- মুম্বইয়ের জমকে ব্রাত্য আরে অরণ্য, আদিবাসীদের দিন বদলের স্বপ্ন দেখান ক্যাসান্দ্রা
নদীবাঁধ- উচ্ছেদ - পুনর্বাসন – ক্ষতিপূরণ
ভারতে বড় নদীবাঁধ তৈরির কারণে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ প্রায়শই অপর্যাপ্ত ছিল। নর্মদায় সর্দার সরোবর প্রকল্পে অনেককেই প্রতিশ্রুত জমি দেওয়া হয়নি। পুনর্বাসন স্থানের কৃষিজমি অনুপযুক্ত ছিল। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবিকা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক বন্ধন ধ্বংস করা হয়েছে। পুনর্বাসন ও সঠিক ক্ষতিপূরণের দাবিতে শুরু হয়েছিল নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন। তেহরি ড্যামে উচ্ছেদকৃত পরিবারগুলিকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের সুযোগই দেওয়া হয়নি। হিমালয় অঞ্চলের ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছিল না। হিরাকুদ বাঁধে ক্ষতিপূরণের জন্য জমি বা অর্থ বরাদ্দ তুলনায় সামান্য ছিল। পুনর্বাসনের জন্য বিকল্প জমি দেওয়া হলেও তা চাষযোগ্য ছিল না। ক্ষতিপূরণের জন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী, রাজ্য সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়েছে। নাগার্জুনসাগর বাঁধেও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যথাযথ ছিল না। জীবিকার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। পুনর্বাসন এলাকাগুলোতে পানীয় জলের সংকট চোখে পড়েছে।
কেন-বেতওয়া নদী সংযোগ প্রকল্পেও বাস্তুচ্যুত মানুষদের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। যার মূল্যায়ন করা হয়েছে জমি অধিগ্রহণ আইনের 'রাইট টু ফেয়ার কম্পেনসেশন এন্ড ট্রান্সপারেন্সি' অ্যাক্ট এবং 'রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৩' অনুযায়ী। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পর্যাপ্ত না হওয়ায় এবং পুনর্বাসনের ন্যূনতম সুবিধা না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবিতে লড়াই করছে তারা। ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব উচ্ছেদকারীদের অসন্তোষ বাড়িয়েছে। বিকল্প আবাসন এবং জীবিকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করেই সরকার পুনর্বাসন দেওয়ার চেষ্টা করেছে যা সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে।
আরও পড়ুন- গ্লোবাল ওয়ার্মিং আসলে একটি বিশুদ্ধ মিথ্যা? চমকে দেবে বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা
২০০৪ সালে বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষার রিপোর্টে দেখা গেছে, ভারত সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পগুলির মধ্যে ৭৫ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে উচ্ছেদ হওয়া মানুষ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন পাননি। ২০০৮-এর এনসিআরডব্লিউ রিপোর্টে দেখা গেল, পুনর্বাসনের জন্য বাজেটের বড় অংশ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়নি।
এ পর্যন্ত সবটাই মানুষের স্থানচ্যুতি। কেন-বেতওয়া নদী সংযোগ প্রকল্পে 'দাউধান বাঁধ' নির্মাণ হবে পান্না টাইগার রিজার্ভের ভিতরে। যেখানে বাঘ, শকুন এবং ঘড়িয়ালের মতো বিপন্ন প্রজাতির বাস। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে পান্না টাইগার রিজার্ভের ৪,১৪১ হেক্টর জমি জলের তলায় চলে যাবে। যার মধ্যে বাঘের সংরক্ষিত আবাসস্থলের প্রায় ৫৮ বর্গকিলোমিটার কোর এলাকাও রয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে বাঘের আবাসস্থলের আরও ১০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন এই প্রকল্প শুধুমাত্র স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করবে তাই না, বরং বন্যপ্রাণীদের করিডোরও বিচ্ছিন্ন করবে।
এ থেকে পরিষ্কার, দেশের প্রথম নদী সংযোগ প্রকল্প শুধু মানুষকে বাস্তুচ্যুত করবে তাই নয়, বন্যপ্রাণীদেরও বন ছাড়া করে ছাড়বে। আলোচনায় এটুকু স্পষ্ট যে, প্রান্তিক মানুষকে উচ্ছেদ করে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করেই বাস্তবায়িত হতে চলেছে দেশের প্রথম নদী সংযোগ প্রকল্প।