মঙ্গল পাণ্ডে নন, ভারতের প্রথম শহিদ বিন্দি তিওয়ারি! যে বিদ্রোহীকে মুছে দেওয়া হলো ইতিহাস থেকে

ইতিহাস ভারতের সম্ভাব্য প্রথম শহিদ বলে থাকে বিন্দি তিওয়ারিকে। আশ্চর্যের ব্যাপার যে, বারাকপুরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন এই সেপাই, ৩৩ বছর পরে সেখানেই বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন মঙ্গল পাণ্ডে।

ইতিহাসের ফেরে সাধারণ মানুষ নায়ক হয়ে ওঠেন। আবার বহু নায়ক হারিয়ে যান মানুষের স্মৃতি থেকে। এই ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। ভারতের প্রথম শহিদ কে? এককালে 'মঙ্গল পাণ্ডে' বলে উঠত সবাই এই প্রশ্নের উত্তরে। কিন্তু বর্তমানে নানা বিতর্ক গড়ে উঠেছে বিষয়টা নিয়ে। নানা নতুন তথ্য আবিষ্কার হয়েছে। আজ ইতিহাস ভারতের সম্ভাব্য প্রথম শহিদ বলে থাকে বিন্দি তিওয়ারিকে। আশ্চর্যের ব্যাপার যে, বারাকপুরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন এই সেপাই, ৩৩ বছর পরে সেখানেই বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন মঙ্গল পাণ্ডে। অথচ বিন্দিকে ভুলে গিয়েছে ভারত। বিন্দিকে মুছে দেওয়া হয়েছে যৌথ স্মৃতি-ইতিহাস থেকে।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে এখন আর স্বীকার করা হয় না। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ দেখিয়েছে, তার আগেও বহু ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম হয়ে গিয়েছে। সেগুলো মোটেই ফেলনা ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে প্রচণ্ড অত্যাচারিত জাতিগুলি ডাকাতি করে বেড়াত। এই ছিল তাদের প্রতিরোধ। ধীরে ধীরে তা কৃষক আন্দোলনের সংগঠিত রূপ নেয়। কৃষক আন্দোলন এবং ডাকাতি আবার পাশাপাশি চলে দীর্ঘকাল। বহুস্তরীয় এই সমাজব্যবস্থায় কোনটা ডাকাতি, আর কোনটাই বা বিদ্রোহ— এই দুই নির্ণয় করতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যেত ব্রিটিশদের। যার ফলে অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে, বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ইংরেজ শাসক ভেবেছে সামান্য ডাকাতি। বলাই বাহুল্য, তার ফল খুব একটা ভালো হয়নি।

যে সময়ের কথা, রামমোহন তখনও বেঁচে। বিদ্যাসাগর মাত্র চার বছর বয়সের শিশু। অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। তৎকালীন গভর্নল জেনারেল লর্ড আর্মহার্স্টের ওপর দায়িত্ব, উনিই সবটা দেখছেন। আজ যে অংশটিকে আমরা 'নর্থ ইস্ট' বলি, অর্থাৎ অবিভক্ত বঙ্গের উত্তর-পশ্চিমের অঞ্চলগুলি দখলের লড়াই চলছে। বার্মিজ সেনা ১৮২২ সালে, মানে বছরদুয়েক আগেই ঢুকে পড়েছে মণিপুর আর আসামে। ফলে সেই অঞ্চলে পুনরায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-কে সরাসরি যুদ্ধে নামতে হয়েছে। বার্মিজ আগ্রাসন থামাতে বেঙ্গল আর্মিকে সোজা বার্মায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল ইংরেজরা। কিন্তু সেপাইরা দোনামনা করে। একে তো কালাপানি, পেরোলেই জাত যাবে, তার ওপর তাদের বিশ্বাস, বর্মার মানুষ তন্ত্রমন্ত্র জানে। বাণ মারবে না অভিশাপ দেবে না কি পিশাচ লেলিয়ে দেবে— কে জানে। এই নিয়ে সেপাইদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠছিল। মথুরায় থাকাকালীন একটু ক্ষোভটোভ প্রকাশও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার একেবারেই পাত্তা দেয়নি। অবশেষে ৪৭, ২৬ এবং ৬২ নং রেজিমেন্ট মিলিয়ে মোট ১৪০০ বঙ্গীয় সেপাইকে একরকম জোর করেই চাটগাঁ থেকে জাহাজে রেঙ্গুন পাঠানোর বন্দোবস্ত হল। এদের মধ্যে বিন্দি তিওয়ারি নামে এক সেপাই ছিল। নাম থেকে অনেকে আন্দাজ করেন, তিনি ছিলেন 'পুর্বিয়া', অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল ছিল তার জন্মস্থান। তা না-ও হতে পারে। বিন্দির জন্মবৃত্তান্ত বা ইতিহাস নিয়ে আসলে কোনও ডকুমেন্টশনই পাওয়া যায় না। ফলে জানার উপায় নেই। তবে বিন্দি তিওয়ারি বেঙ্গল আর্মিতে চাকরি করত— এটুকু জানা যায়।

আরও পড়ুন: ব্রিটিশদের ভারতছাড়া করতে বাধ্য করেছিল সেই বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতার বিষ পালটে দিল ইতিহাস

অসন্তোষ তো ছিলই। উপরি ছিল ক্রমাগত ওপরমহলের অবজ্ঞা। চাটগাঁ যাওয়ার পথে বারাকপুরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল সবাই। জানা গেল, সেপাইদের নিজের মালপত্তর, বিছানা, গুলি, বন্দুক, মায় বাসনকোসন নিজেদেরই বইতে হবে। বারাকপুর থেকে চাটগাঁ খুব কম দূরত্ব নয়। মালপত্র টানার জন্য না আছে গরুর গাড়ি, না আছে খচ্চর। এদিকে অফিসারদের রাজকীয় সব সুযোগসুবিধে। সেপাইরা এ-পর্যন্ত প্রায় ৮০০ মাইল (১২৮৭ কিমি) পায়ে হেঁটে এসেছে। সাহেবদের তাড়ার চোটে বিশ্রাম প্রায় কিছুই জোটেনি। উপরন্তু এই চোটপাটে তাদের মেজাজ গেল বিগড়ে। তারা দাবি করলে যুদ্ধের জন্য ভালো অস্ত্রশস্ত্র চাই, মালপত্র টানার সুব্যবস্থা চাই আর ওই নরকে যুদ্ধের জন্য ডবল ভাতা দিতে হবে— নইলে তারা লড়বে না। সরকার শুনবে কেন! সব দাবি উড়িয়ে দিয়ে তারা সেপাইদের বলল, মাল বইতে না পারলে ফেলে দাও। যতটুকু বইতে পারবে, নিয়ে চলো। অসুবিধে তাতে বাড়বে বই কমবে না। তখন হাজারচারেক টাকা রেজিমেন্ট প্রতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু সেপাইদের সংখ্যার তুলনায় তা অত্যন্ত নগণ্য। এই অবস্থায় মাল বওয়ার জন্য কুলি ভাড়া করলে সেপাইদের নিজের পকেট থেকে পয়সা যাবে। অন্যের যুদ্ধের জন্য তা তারা করবে কেন! তার ওপর কালাপানির ধাক্কা। ব্যাপারটা তালেগোলে আরও পাকিয়ে গেল।

১ নভেম্বর, ১৮২৪, বিন্দি তিওয়ারি উপরিমহলের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করল। তার সঙ্গে একে একে জুটে গেল আরও এগারোজন সেপাই। এদিকে ২৬ নং রেজিমেন্টের সবার আগে রওনা কথা। তারপরে ক্রমান্বয়ে ৪৭ ও ৬২ নং রেজিমেন্ট যাবে। শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা বাতিল হলো। ৪৭ নং রেজিমেন্টকে মার্চ করে এগোতে বলা হলো ১ নভেম্বর। বাকিরা হপ্তাখানেক পরে রওনা দেবে। এই শুনে ৪৭ নং রেজিমেন্টের সেপাইরা হাজির হল বিনা ন্যাপস্যাকে। উপরমহলের বারংবার নির্দেশ সত্ত্বেও মাল বইতে অস্বীকার করল তারা। ফের দাবি জানানো হলো, মাল বওয়ার জন্য কিছু গরুর গাড়ির ব্যবস্থা হোক, আর ভাতা দ্বিগুণ করা হোক, নইলে তারা নড়বে না। কমান্ডিং অফিসার জেনারেল ডেলজেল কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলেন না সেপাইদের। কমান্ডার ইন চিফ এডওয়ার্ড পেগেট তখন কলকাতায়। অবশেষে তাঁরই শরণাপন্ন হলেন ডেলজেল। জানালেন, ২৬ নং রেজিমেন্টের ২০ জন এবং ৬২ নং রেজিমেন্টের ১৬০ জন সেপাই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। কিছু একটা করতেই হবে। তিওয়ারির নেতৃত্বে বিদ্রোহী সেপাইরা প্যারেড গ্রাউন্ডেই রইলেন সারারাত। পেগেটের কাছেও একটা পিটিশন পাঠানো হল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে শুনে পেগেট দৌড়ে এলেন বারাকপুরে। সেপাইরা বলল, হয় আমাদের প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করুন, নাহলে আমাদের রেহাই দিন, আমরা বাড়ি যাই। পেগেট বললেন, সেপাইরা অস্ত্রত্যাগ না করলে কোনও দাবিই শোনা হবে না। অসত্রত্যাগের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিনি প্রস্তুত। কিন্তু দীর্ঘ বঞ্চনায় যে ভরসা মুছে গিয়েছে তিলে তিলে, সামান্য মুখের কথায় তাকে ফেরানো কি সম্ভব? বন্দুক ত্যাগ করতে অস্বীকার করে সেপাইরা।

ব্যস! পেগেট একে সরাসরি কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে গণ্য করেন। ইউরোপীয় সেনাদের দু'টি রেজিমেন্ট তলব করা হয়। দমদম থেকে আনানো হয় ঘোড়সওয়ার বাহিনী। পরের দিন আচম্বিতে সেপাইদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে সেনারা। অস্ত্র নামিয়ে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ আসে। মাত্র দশ মিনিট সময় দেয় তাদের ব্রিটিশ সরকার। আকস্মিক হামলায় সেপাইরা হকচকিয়ে গিয়েছিল। কী করবে কী করবে না, ভাবতে ভাবতেই পেগেটের নির্দেশে দু'খানা কামান গর্জে ওঠে। পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে ঘোড়সওয়ার বাহিনী। ভয় পেয়ে পালাতে চেষ্টা করে সেপাইরা। কিন্তু কোনদিকে পথ? চক্রব্যূহের সবক'টি দিক ইংরেজ সেনা ঘিরে রেখে আক্রমণ চালাচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে কেউ কেউ হুগলি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েকজন স্থানীয় ঘরদোরগুলিতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তেড়ে গিয়ে বেয়নেট গেঁথে তাদের খুন করে ব্রিটিশ সেনা। প্রাণ যায় বহু নিরপরাধ সাধারণ মানুষের, যারা ঘটনাচক্রে হয়তো আশেপাশেই ছিল। রচিত হয় ইতিহাসের এক ঘৃণ্য অধ্যায়।

পরে জানা গিয়েছিল, সেপাইদের কারও বন্দুকেই গুলি ছিল না। হিংসাত্মক আক্রমণের যে জুজু পেগেট দেখেছিল, তার কোনও উদ্দেশ্যই ছিল না সিপাহিদের। অথচ তারপরেও তিওয়ারি-সহ এগারো জনের মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেল। তিওয়ারির হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে অশ্বত্থ গাছে ফাঁসি দেওয়া হলো। দেহটা ওখানেই ঝুলিয়ে রাখল ব্রিটিশ সরকার। একটু একটু করে সে দেহ পচল, শকুনে ছিঁড়ে খেল। এই ভয়াবহ পরিণতি শুধুমাত্র দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। পরে সেখানে একটি মন্দির গড়ে ওঠে। 'বাবা বিন্দা'-র ঘটনা লেখা রইল একটি স্মারকে। শোনা যায়, সেই মন্দিরে মাঝে মাঝেই আসতেন মঙ্গল পাণ্ডে। বসে থাকতেন অনেকক্ষণ। ভারতের বিখ্যাত সিপাহি বিদ্রোহের প্রেরণা সম্ভবত বিন্দিই। বিন্দি তিওয়ারি ভারতের প্রথম শহিদ।

More Articles