তিনি না থাকলে জানাই হত না সমুদ্র তলদেশকে! প্রথম মহিলা ভূতত্ত্ববিদের লড়াই আজও অন্তরালে
Google Doodle Marie Tharp: হেনরিখ বেরানের সহযোগিতায়, থার্প এবং হিজেন পৃথিবীর সমগ্র মহাসাগরের তলদেশের মানচিত্র তৈরি করেন, যা ১৯৭৭ সালে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ থেকে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ওশান ফ্লোর’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
২১ নভেম্বর, ২০২২। গুগল খুললেই দেখা যাচ্ছিল এক কর্মরত মহিলার ছবি। ছবি দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, কে এই মহিলা? গুগল কেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাল? উত্তর লুকিয়ে এক গহিন ইতিহাসে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পেট্রোলিয়ামজাত শক্তির ভূমিকা অপরিহার্য। তাই, বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সরগরম হয়ে ওঠেছে পেট্রোপণ্যের উপর আধিপত্যকে কেন্দ্র করে। এ কথা সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও যেমন সত্যি, আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেও তা প্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জাপানে পেট্রোলিয়ামজাত তেল সরবরাহকারী দেশ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক ওই সময়কালেই জাপান তার সাম্রাজ্যবাদী স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চিন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সামরিক অভিযান শুরু করে। তৎকালীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো জুড়ে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের আধিপত্য ছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের পক্ষে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানি আক্রমণকে ভালো চোখে দেখেনি। তাই মার্কিন মুলুক জাপানে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরকে সান দিয়েগো থেকে পার্ল হারবারে সরিয়ে নেয়। এমন সিদ্ধান্তের কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৪১-এ জাপান পার্ল হারবার বন্দর আক্রমণ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। যুদ্ধের প্রয়োজনে আমেরিকা জুড়ে অনেক পুরুষ এবং যুবক তাঁদের কাজ-কর্ম, স্কুল- ইউনিভার্সিটি ছেড়ে সেনাবাহিনীতে নাম লেখান। কথায় বলে, কারও সর্বনাশ, কারও পৌষমাস। এই সুযোগে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিভিন্ন প্রকল্প ও গবেষণার কাজে মহিলাদের যোগ দেওয়ার সুযোগ বেড়ে যায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম ভূতত্ত্বের কাজে যোগ দেন এক তরুণী। তারপর সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, অপর একটি তেল কোম্পানিতে চাকরি, পাশাপাশি অঙ্কশাস্ত্রে আরও একটি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেন তিনি। কিন্তু সাধারণ চাকরির গেরোয় আটকে থাকতে চায়নি সেই তরুণীর অনুসন্ধিৎসু মন। বরং তাঁর স্বপ্ন তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অন্যদিকে। নিজের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় কিছুটা গোপন করেই অতি সাধারণ একটি চাকরি নেন ভূতত্ত্ব গবেষণার অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘ল্যামন্ট জিওলজিকাল অবজারভেটরি’তে। আর এখানেই তাঁর জীবন ও কাজের পট পরিবর্তন হতে শুরু করে। এই সাহসী তরুণীই হলেন আমেরিকান ভূতাত্ত্বিক এবং মহাসাগরীয় মানচিত্রকার ম্যারি থার্প (জুলাই ৩০, ১৯২০ - অগাস্ট ২৩, ২০০৬)।
আরও পড়ুন- ঠাঁই হল না বাংলায়, ইতিহাসের মরা গাঙ বেয়ে গুজরাতে পাড়ি দিল বঙ্গের হারিয়ে যাওয়া ‘ছোট্’!
‘ল্যামন্ট জিওলজিকাল অবজারভেটরি’তে থাকাকালীন তাঁর দেখা হয় পূর্ব পরিচিত ভূতত্ত্ববিদ ব্রুস হিজেনের সঙ্গে। ততক্ষণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ১৯৫০-এর আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে ভূপৃষ্ঠের গঠন সংক্রান্ত জ্ঞান থাকলেও, সমুদ্র তলদেশের ভূপ্রকৃতি অজানাই ছিল। সমুদ্র তলদেশের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হিজেন এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করলেন। হিজেনের গবেষণায় যোগ দিলেন প্রথম মহিলা ভূতাত্ত্বিক থার্প। কিন্তু, তৎকালীন সমাজের চূড়ান্ত লিঙ্গবৈষম্য তাঁর কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াল। সাগরের তলদেশ নিয়েই যখন গবেষণা তখন সেই কাজের জন্য নৌ-অভিযান প্রয়োজন। মহিলা হওয়ার কারণেই জাহাজে চেপে ঘুরে বেড়ানো তালিকা থেকে বাদ পড়ল তাঁর নাম। বাধা যতই আসুক না কেন, অদম্য জেদ আর স্বপ্নের কাছে সেসব কখনই টিকতে পারেনা। গবেষকদল সমুদ্র অভিযান করে যেসব তথ্য সংগ্রহ করলেন তার ওপর ভিত্তি করেই থার্প সমুদ্রগর্ভের মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করলেন। জলের মধ্যে শব্দ তরঙ্গের প্রতিফলন ভালো হয়। সেই ধর্মকে কাজে লাগিয়েই সোনার (সাউন্ড নেভিগেশন এবং রেঞ্জিং) ব্যবস্থার মাধ্যমে জলের গভীরতা মাপা হল। তারপর, সেই তথ্যগুলি নির্দিষ্ট একটি পদ্ধতিতে সাজিয়ে মধ্য আটলান্টিক সাগরের উত্তর অংশের মানচিত্র প্রস্তুত করলেন। এই নতুন মানচিত্র এবং তার তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি আটলান্টিক সাগরের ওই অংশে একটি V-আকৃতির গঠন শনাক্ত করলেন। এই গঠন সারিবদ্ধভাবে মহাসাগরের তলায় থাকা শৈলশিরার অক্ষ বরাবর চলে গেছে। এই ঘটনা দেখে, তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, সমুদ্র তলদেশের ওই অংশেই এক বিশেষ ধরনের ফাটল উপত্যকা (রিফট্ ভ্যালি) রয়েছে। শুধু তাই নয়, ঠিক ওই অঞ্চলেই সমুদ্রের নীচে থাকা ভূগর্ভের স্তরগুলি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ স্তরগুলির একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা, ওই স্তরগুলির একটি নির্দিষ্ট চলনকে নির্দেশ করছে।
কিন্তু, ব্রুস হিজেন এই মতামতে বিশ্বাস করলেন না। মহাসাগর এবং মহাদেশের নীচে থাকা ভূপৃষ্ঠের স্তরগুলি যে একে অপরের থেকে সরে যেতে পারে এবং তেমনটাই ক্রমাগত ঘটে চলেছে- এই তত্ত্ব নিয়ে ভূতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক ছিল। হিজেন সহ অন্যান্য অনেক ভূতাত্ত্বিক মনে করতেন ভূপৃষ্ঠের নিচের স্তরগুলির চলন হয় না বরং পৃথিবী অল্প অল্প করে বেড়ে চলেছে তাই তারা একে অপরের থেকে সরে যাচ্ছে। থার্পের চিন্তাভাবনা তাই বিশেষ গুরুত্ব পেল না। তার গবেষণার ফলাফল মান্যতা না পাওয়ার আরও একটি কারণ হল- মেয়েদের ক্ষমতা, চিন্তা ও দূরদৃষ্টি সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরাচরিত অবজ্ঞা।
কিছুদিনের মধ্যেই ব্রুস হিজেন সমুদ্র তলদেশের ভূমিকম্প সম্পর্কিত গবেষণার কাজে হাওয়ার্ড ফস্টার নামে আরেক ভূবিজ্ঞানীকে নিয়োগ করলেন। ফস্টার মধ্য আটলান্টিক সাগরের নিচে থাকা ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলগুলির একটি মানচিত্র তৈরি করলেন। যখন ফস্টার ও থার্পের তৈরি মানচিত্রকে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করা হল, দেখা গেল থার্প আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে থাকা শৈলশিরার মধ্যবর্তী যে ফাটল উপত্যকা চিহ্নিত করেছিলেন ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলগুলির অবস্থান তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এই সামঞ্জস্য দেখেই হিজেন, থার্পের অনুমান মেনে নেন। এই গবেষণা ভূগর্ভের স্তরগুলির চলন সংক্রান্ত তত্ত্ব অর্থাৎ প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার পথ দেখায়, যা পরবর্তীকালে আধুনিক ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন- ব্রিটিশকে বোকা বানিয়ে ছদ্মবেশে বিদেশ পাড়ি! বিজ্ঞানে-বিপ্লবে বিস্মৃতপ্রায় শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ
১৯৫৭ সালে থার্প এবং হিজেন উত্তর আটলান্টিকের প্রথম গঠনতাত্ত্বিক মানচিত্র প্রকাশ করেন। তারপরও, থার্পের নাম প্লেট টেকটোনিক্স সম্পর্কিত গবেষণা পত্রে সেই অর্থে জায়গা পায়নি। তিনি গবেষণা সহায়ক হিসেবে বহু বছর ধরে সমুদ্র ভূতত্ত্ব নিয়ে চর্চা চালিয়ে যান। উত্তর আটলান্টিক ছাড়াও দক্ষিণ আটলান্টিক, ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর, গালফ্ অব ইডেনেও একই ধরনের ফাটল উপত্যকা চিহ্নিত করেন তিনি। তা থেকেই সারা পৃথিবীজুড়ে যে মহাসাগরীয় ফাটল অঞ্চল রয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা সুস্পষ্ট হয়। পরবর্তীকালে, অস্ট্রিয়ান ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্পী হেনরিখ বেরানের সহযোগিতায়, থার্প এবং হিজেন পৃথিবীর সমগ্র মহাসাগরের তলদেশের মানচিত্র তৈরি করেন, যা ১৯৭৭ সালে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ থেকে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ওশান ফ্লোর’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এই অভূতপূর্ব কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রথম মহিলা ভূতত্ত্ববিদের নাম সুদীর্ঘ সময় আড়ালে থেকে গেলেও, শেষ পর্যন্ত যোগ্য সম্মান পান তিনি । ১৯৯৫ সালে থার্প তাঁর তৈরি মানচিত্র ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’কে দান করেন। ১৯৯৭ সালে, ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ ম্যারি থার্পকে বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানচিত্রকার হিসাবে অভিহিত করেছে। আমেরিকান মহাকাশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রচারক নীল ডিগ্র্যাস টাইসনের (Neil deGrasse Tyson) মত অনুযায়ী, মেরি থার্প শুধুমাত্র একজন উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী নন, তাঁকে আমাদের স্মরণ করা উচিত এমন একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যিনি লিঙ্গবৈষম্যের বাধা পেরিয়ে তাঁর কর্মক্ষেত্র অবদান রেখে গেছেন।