বিশ্বে প্রথম সফলভাবে সোনালি চালের উৎপাদন! কতটা বদলে যাবে খাদ‍্যাভ‍্যাস

Golden Rice: ফিলিপাইন্সের সোনালি ধান প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করার আগে, বলা যাক গোল্ডেন রাইস বা সোনালি ধান কী?

বিশ্বে প্রথমবার সোনালি ধানের ফলন হল ফিলিপাইন্সের মাটিতে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে কৃষি-স্তরে সোনালি ধান চাষের সবুজ সংকেত পেয়েই গিয়েছিল দেশটি। সেই মতো চলতি বছর অগাস্ট মাসে ৪০ হেক্টর জমিতে প্রাথমিক ভাবে কৃষি-স্তরে চাষাবাদ শুরুও হয়েছিল। সেই ধান পরিপক্ক হলে কাটার কথা ছিল অক্টোবর মাসে। ঠিক সেই অনুযায়ীই ফিলিপাইন্সের এক সাধারণ কৃষকের জমি থেকে কাটাও হল সোনালি ধান। এই সাফল্যের পর লার্জ-স্কেল চাষের দিকেই এগোবে ফিলিপাইন্স সরকার।

ফিলিপাইন্সের সোনালি ধান প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করার আগে, বলা যাক গোল্ডেন রাইস বা সোনালি ধান কী? সাধারণ ধান-চাল ছেড়ে, হঠাৎ সোনালি ধানের দিকে ঝোঁকার প্রয়োজনই বা কেন পড়ল? সোনালি চাল আসলে বিটা-ক্যারোটিনে পরিপুষ্ট। বিটা-ক্যারোটিন শরীরে প্রবেশ করলে সেখান থেকে তৈরি হয় ভিটামিন-বি। বিটা-ক্যারোটিনের সোনালি বা কমলাভ রঙের দরুণ, চালগুলিকে সোনালি দেখতে লাগে। আমরা আদতেই বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন ফল-মূল বা সবজির সঙ্গে পরিচিত। যার মধ্যে অন্যতম গাজর, পাকা পেঁপে, আম, কুমড়ো, কমলালেবু, প্রভৃতি।

আরও পড়ুন: কালো চালের ভাত, পায়েস, বিরিয়ানি! পুষ্টিগুণ জানলে চমকে উঠবেন

ভিটামিন এ-এর অভাবে সারা বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়। আর ভিটামিন-এ-এর অভাবে বিশ্বে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, স্বল্প-আয় সম্পন্ন দেশগুলিতে যে শিশু মৃত্যুর হার বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্দিষ্ট এই ভিটামিনটির অভাব শৈশবে অন্ধত্বের শিকার হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। এর পাশাপাশি শিশুদের ঘনঘন ডায়রিয়াতে ভোগার একটি অন্যতম কারণও এই ভিটামিনের অভাব। রিপোর্ট যদিও ২০১১ সালের, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গ্যানাইজে়শনের গাইডলাইন জানাচ্ছে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন প্রাক-বিদ্যালয়গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত শিশু ভিটামিন এ-এর অভাবে ভুগছে।

Golden Rice

সোনালি চাল

গোল্ডেন রাইস চাষের নেপথ্যে মূল উদ্দেশ্য বিশ্বের শিশুদের সস্তায় এবং কোনও সম্পূরক না দিয়েই, তাদের ভিটামিন এ-এর অভাব দূর করা এবং নিত্যদিনের সাধারণ খাবারের মাধ্যমেই শরীরের দৈনন্দিন ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণ করা। নতুন উৎপাদিত গোল্ডেন রাইসে শিশুদের দৈনন্দিন ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণ হবে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি, জানা যাচ্ছে ন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে।

‘ক্লিনিক্যাল এপিডিমিওলজি অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথ’-জার্নালে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণা তুলে ধরছে ভিটামিন-এ জনিত অপুষ্টির নিরিখে ভারতের অবস্থান। ভারতের এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে তিন থেকে চার বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভিটামিন এ জনিত অপুষ্টির শিকার। তার পরেই রয়েছে এক থেকে দেড় বছর বয়সী শিশুরা। যদি মানচিত্রের নিরিখে দেখা যায়, তাহলে সব থেকে বেশি ভিটামিন-এ জনিত অপুষ্টির শিকার ঝাড়খণ্ড, অসম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও মিজোরামের শিশুরা। যেখানে ভিটামিন এ-জনিত অপুষ্টির শিকার ৩৯ থেকে ৪২.৭ শতাংশ শিশু। ঠিক তারপরেই রয়েছে বিহার, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ। যেখানে ভিটামিন এ-জনিত অপুষ্টির হার প্রায় ২০ থেকে ২৭ শতাংশেরও বেশি।

খেলা ঘোরাচ্ছে বি-ক‍্যারোটিন

দেখা গেছে, উচ্চ-ডোজে়র ভিটামিন এ-এর সম্পূরক দিয়ে শিশুর মৃত্যু বারো থেকে চব্বিশ শতাংশ অবধি কমানো যায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ভিটামিন এ-এর সম্পূরক সব দেশের শিশুরা পায় না। উপরন্তু, কোভিড মহামারি শুরুর কারণে সম্পূরক সরবরাহ করার হার কমেছে ব্যাপকহারে, ইউনিসেফের ২০২০ সালের একটি রিপোর্ট থেকে যা স্পষ্ট। ভিটামিন এ-এর অভাবে নানা সমস্যায় ভুগছে, বিশ্বের এরকম শিশুদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই পায়নি ভিটামিন-এ সম্পূরক।

গোল্ডেন রাইস বা সোনালি ধানের ধারণা প্রফেসর ইঙ্গো পট্রিকাস এবং পিটার বেয়ারের মস্তিষ্ক-প্রসূত। এই বিষয়ে তাঁরা ১৯৮০-এর দশক থেকেই চিন্তা-ভাবনা করা শুরু করেছিলেন। পরে ২০০১ সালে ইন্টারন্যাশানাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা আইআরআরআই-এর গবেষকরাই সর্বপ্রথম সোনালি চাল নিয়ে গবেষণা করার অনুপতি পান।

ফিলিপাইন্সের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার-ফিলিপাইন রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (DA-PhillRice) এবং ইন্টারন্যাশানাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে গোল্ডেন রাইস বা সোনালি চাল উৎপাদন করা হলো অবশেষে। যার প্রাথমিক কারসাজি জিন এডিটিং। সাধারণ ধান গাছের জিনে, বিটা-ক্যারোটিন উৎপাদনকারী জিন প্রবেশ করিয়ে জিনে অদল-বদল করা হয়েছে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে জিন এডিটিং। ফিলিপাইন্সের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার-ফিলিপাইন রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা ড. জন ডে লিওন জানাচ্ছেন, “যাতে সব ফিলিপিনো সোনালি ধানের উন্নত মানের বীজ পান এবং অবশ্যই সুরক্ষিত ও পুষ্টিকর খাবার পান সে বিষয়টিকে আমরা আগ্রাধিকার দিয়েছি।”

ফিলিপাইন্সের পর সোনালি ধানের এই নতুন ভ্যারাইটি খাদ্য সুরক্ষার ছাড়পত্র পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজি়ল্যান্ড, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। বাংলাদেশেও অন্তিম রেগুলেটরি রিভিউ চলছে সোনালি ধানের। তবে ঢাকা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে জানা যাচ্ছে, অন্তিম রেগুলেটরি রিভিউ বিগত পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের কৃষকরা নিজেদের জমিতে সোনালি ধানের চাষ শুরু করতে পারছেন না।

‘দ্য হেলদিয়ার রাইস প্রোগ্রাম’-কে লক্ষ্য রেখে ইন্টারন্যাশানাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বর্তমানে বিটা-ক্যারোটিনের পাশাপাশি হাই আয়রন এবং জি়ঙ্ক রাইস তৈরি করছে। উদ্দেশ্য আয়রন এবং জিঙ্কের মতো অপরিহার্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাব দূর করা।

More Articles