হামাস-ইজরায়েল আলোচনা বিফলে! রমজানেও শান্তি ফিরবে গাজায়?

Gaza ceasefire: ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে তিনদিনের বৈঠক শেষ। কিন্তু কোনও রফাসূত্র এখনও মেলেনি। ইজরায়েল সরকার বলছে, তারা হামাসের পক্ষের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আবার হামাসের দিক থেকেও শোনা যাচ্ছে একই কথা।

রমজান আসতে আর বেশি দেরি নেই। পবিত্র মাসেও কি সামান্যতম স্বস্তিও পাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা? না, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না এখনই। বরং ক্রমশ সমস্ত যুদ্ধশান্তির সম্ভাবনাকে দূরে যেতে দেখছে মানুষ। ইতিমধ্যেই মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে গাজায়। তার মধ্যে হানা দিয়েছে ভয়ঙ্কর দুর্ভীক্ষ। মজুত খাবার ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। খাদ্যসাহায্যের ট্রাক আসার খবর কানে আসতেই ছুটছেন বাসিন্দারা। একটু আটা, একটু শস্য যদি মেলে পরিবারের জন্য। এর মধ্যেও নিত্য ইজরায়েলের আক্রমণ লেগেই রয়েছে। কখনও খাবারের লাইনে ছুটে আসছে গুলি, তো কখনও গভীর রাতে সব ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ইজরায়েলি রকেট।

আগামী ১০ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এই সময়টায় শর্তসাপেক্ষ যুদ্ধবিরতির কথা জানিয়েছিল ইজরায়েল। তবে তার জন্য হামাসের সামনে বেশ কয়েকটি শর্ত রেখেছিল নেতানিয়াহু সেনা। তার মধ্যে একটি অবশ্যই বন্দিমুক্তি। গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে ঢুকে ভয়ানক ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ইজরায়েল থেকে বহু বাসিন্দাকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয় গাজায়। তার মধ্যে বেশ কিছু বন্দিকে ইতিমধ্যেই মুক্তি দিয়েছে হামাস। যার বিনিময়ে কিছুদিনের জন্য ইজরায়েলের কাছ থেকে চারদিনের যুদ্ধবিরতি ছিনিয়ে এনেছিল হামাস। কিন্তু আদৌ তা কতটা ফলপ্রসু ছিল, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

গোটা গাজা শহরটাকে কার্যত গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইজরায়েল। সেখানে নিরাপদে মাথা গোঁজার জায়গা বলে আর কিছু নেই। যেদিকে তাকানো যায় ধ্বংসস্তূপ। ইজরায়েলি বোমা গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে ধর্মস্থান, স্কুল থেকে শুরু করে শরণার্থী শিবির, বাদ যায়নি কিছুই। গোটা গাজাই এখন একটা গণকবর। প্রতিদিন কয়েকশো মৃতদেহ সেখানে সমাধিস্থ করা হচ্ছে। চিকিৎসার ন্যূনতম পরিকাঠামোটুকু বেঁচে নেই গাজায়। বেশিরভাগ হাসপাতালকেই উড়িয়ে দিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। ক্রমে আন্তর্জাতিক সব কটি সহায়তা সংস্থা থেকেও সাহায্য আসা বন্ধ হচ্ছে। নিরাপত্তার খাতিরেই গাজায় পৌঁছতে পারছে না অনেকে। তার মধ্যে দুর্ভীক্ষের ছোবল। হাসপাতাল জুড়ে অসংখ্য শিশু মরছে অপুষ্টিতে। যুদ্ধে তো শিশু একদিন মরেইছে গাজায়। এবার অপুষ্টিতে মরার পালা তাদের। জল নেই, খাবার নেই, ইন্টারনেট পরিষেবা নেই। বেঁচে থাকার ন্যূনতম ব্যবস্থা থেকেই এখন বঞ্চিত সমগ্র গাজা।

আরও পড়ুন: খাবারের লাইনে নির্বিচারে গুলি ইজরায়েলি সেনার! গণহত্যার যে বীভৎসতা দেখল গাজা

এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধশান্তির প্রস্তাব। কিন্তু তার জন্য হামাসকে মানতে হবে ইজরায়েলের একাধিক দাবি। গাজায় যুদ্ধপরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এবার শান্তির পক্ষে সওয়াল করছে আমেরিকাও। সেই আমেরিকা, যারা এতদিন পর্যন্ত প্রতি পদে পদে ইজরায়েলকে সমর্থন করে গিয়েছে। মদত জুগিয়ে গিয়েছে, যাতে কোনও মতেই পিছু না হঠেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিরিশ হাজার গাজাবাসীর মৃত্যুর পর সুর বদলেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। রমজান মাসে যুদ্ধবিরতির পক্ষেই এবার সওয়াল তাদের। এমনিতেই আন্তর্জাতিক আদালতে কোণঠাসা ইজরায়েল। একাধিক দেশ একত্রিত ভাবে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে সেখানে। তবে তাতেও বিকার নেই ইজরায়েলের। একপ্রকার গাজা ধ্বংস না করে যেন থামবে না নেতানিয়াহু সরকার।

সেই গাজা ধ্বংসের লক্ষে প্রায় আশি শতাংশই সফল ইজরায়েল। ইতিমধ্যেই রমজান মাসে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে একাধিক আলোচনা হয়েছে দু'পক্ষের মধ্যেই। এই সমঝোতায় মধ্যস্থতা করছে আমেরিকা, মিশর এবং কাতার। ইতিমধ্যেই সেই আলোচনায় কেটে গিয়েছে বেশ কিছু দিন। ইজরায়েল জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি ও গাজাকে আরও সহায়তার বিনিময়ে ইজরায়েলি বন্দিদের মুক্তি ও গাজায় ৬ সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি জারি করতে রাজি তারা।

ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে তিনদিনের বৈঠক শেষ। কিন্তু কোনও রফাসূত্র এখনও মেলেনি। ইজরায়েল সরকার বলছে, তারা হামাসের পক্ষের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আবার হামাসের দিক থেকেও শোনা যাচ্ছে একই কথা। কায়রোতে সর্বশেষ বৈঠকটি শেষ হয়েছে একটি অনিশ্চয়তার সঙ্গেই। যতদূর জানা গিয়েছে, হামাস তাদের হাতে থাকা সমস্ত ইজরায়েলি বন্দিকে ছাড়তে নারাজ। আদতে ইজরায়েলের উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না তারা। হামাসরা সব শর্ত মানার পরেও যদি হামলা না বন্ধ করে, যদি ইজরায়েলের জেলে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দিতে রাজি না হয়। যার মধ্যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরাও রয়েছেন। হামাসের এক সিনিয়র নেতা ওসামা হামদান জানিয়েছেন, তাদের তরফে ছয় সপ্তাহের বিরতির পরিবর্তে স্থায়ী যুদ্ধশান্তি চায় তারা। পাশাপাশি গাজা এবং ফিলিস্তিনি এলাকা থেকে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়ারও দাবি জানিয়েছে হামাস। তাদের মতে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্যালেস্টাইনের মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে শুধুমাত্র পাকাপাকি যুদ্ধশান্তি।

ইজরায়েল কীভাবে যুদ্ধশান্তির কথা বলেও যুদ্ধ চালিয়ে যায় তলে তলে, তার সঙ্গে পরিচিত প্যালেস্টাইন এবং হামাল, দু'জনেই। সম্ভবত সে কারণেই প্রত্যায় পাচ্ছে না তারা। গাজা থেকে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীকে সরাতে না পারলে শান্তি ফেরার জায়গা নেই সেখানে। এমনিতেও ইজরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকাগুলিতে ইজরায়েলি দখলকারীদের সীমাহীন অত্যাচার লেগেই থাকে। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া ইজরায়েলি সেনা। যদিও হামাসের সমস্ত দাবি সপাটে উড়িয়ে দিয়েছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।

ইজরায়েলের সঙ্গে এক আশ্চর্য চুক্তিতে বাঁধা প্যালেস্টাইন। যে চুক্তিবলে কোনও সেনাবাহিনী নেই প্যালেস্টাইনের। এমনকী সে দেশে কোনওরকম সশস্ত্র সংগঠন মাথাচাড়া দিলেই তাকে খতম করার ক্ষমতা রয়েছে ইজরায়েলের কাছে। এইসব চুক্তি, বিধিনিষেধের আওতায় দীর্ঘদিন ধরে প্যালেস্টাইনের উপর শোষণ চালিয়ে যায় ইজরায়েল। আর সে কারণেই বোধহয় ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বারবার সেখানে গড়ে ওঠে একাধিক সংগঠন। যারা সওয়াল করে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষেই। হামাসদের শুরুর গল্পটাও ছিল খানিকটা সেরকমই। অক্টোবর মাসে হামাসের ইজরায়েল হামলার পর থেকেই হামাসকে খতম করতে উঠেপড়ে লেগেছে ইজরায়েল। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সমস্ত বন্দিকে ফেরানো না পর্যন্ত এবং হামাস সংগঠন গুঁড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ থামাবে না তারা।

আরও পড়ুন:সাত দিন ধরে টানা যোগাযোগহীন গাজা, ব্ল্যাকআউটই কি গণহত্যার নয়া ‘অস্ত্র’ ইজরায়েলের?

শেষদিনের আলোচনায় কোনও প্রতিনিধি পর্যন্ত পাঠায়নি ইজরায়েল। তবে যতদূর জানা গিয়েছে, তার আগের বৈঠকে হামাসের কাছ থেকে জীবিত বন্দিদের একটি তালিকা চেয়েছে ইজরায়েল। এরই মধ্যে মার্কিন বিদেশমন্ত্রী কৌশল করে হামাসকে ইজরায়েলের শর্তাধিন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু শেষপর্যন্ত সমাধান মেলেনি। ইতিমধ্যেই গাজার বেশিরভাগ অংশকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইজরায়েল। যেটুকু যা বেঁচে রয়েছে, তার উপর চলছে লাগাতার হামলা। অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, রমজান মাসে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাটুকুও ক্রমশ নিভে যেতে দেখছেন গাজা মানুষ। যুদ্ধ, দুর্ভীক্ষ, হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহের ভিড়ে আর কতদিন এভাবে টিকে থাকার মারণ-যুদ্ধ চালাবে গাজাবাসী, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

More Articles