মেরুদণ্ড টুকরো টুকরো করে দিয়েছে ইজরায়েলি বোমা! যেভাবে অথর্ব হচ্ছে গাজার শিশুরা
Gaza Children Paralyzed : মেলিসার কশেরুকার টি১২-এর একাধিক টুকরো হয়ে গিয়েছে। মেরুদণ্ডও একাধিক জায়গায় ভাঙা।
গাজায় ইজরায়েলের বোমাবর্ষণের তখন সবে দ্বিতীয় সপ্তাহ। এমনই এক রাতে, ভোর ৪ টে নাগাদ ইয়াসমিন জুদাহর মোবাইল বেজে ওঠে। বাজতেই থাকে অবিরত। ইয়াসমিন বোঝেন, বিপদ শিয়রেই। পুরো পরিবারই নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে এই যুদ্ধে। আতঙ্কিত ইয়াসমিন ওই ভোরেই কোনওরকমে রাস্তা দিয়ে দৌড়তে থাকেন। বাবা-মায়ের বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে দেখেন চারতলা সেই বাড়ি গুঁড়িয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ইয়াসমিন বোঝেন, পায়ের তলে মানুষের হাত, পা, দেহ। মৃত শরীর ডিঙিয়ে চলেছেন তিনি। ইয়াসমিন জুদাহদের পুরো পরিবারই তখন ছিল গভীর ঘুমে। ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র তাদের চারতলা বাড়িকে নিমেষে শেষ করে দেয়। ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে বের করা একের পর এক লাশের দিকে চেয়ে থাকেন ইয়াসমিন।
এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই বের করে আনা হয় ১৬ মাসের মেলিসাকে। ইয়াসমিনের বোনের একরত্তি মেয়ে মেলিসা। সপ্তাহ খানেক আগেই প্রথম হাঁটতে শিখেছিল এই শিশু। যখন ওই চারতলা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে তাঁকে বের করে আনা হচ্ছে, মেলিসা নিথর, অসাড়। সবাই ধরে নিয়েছিল সে মারা গেছে। ইজরায়েলি বিমান হামলায় একটি লোহার টুকরো মেলিসার মেরুদণ্ডে আটকে যায়। বুকের নীচ থেকে অবশ করে দেয় মেলিসাকে।
ইয়াসমিনের পরিবারে সকলেই মৃত, এক মেলিসা ছাড়া। সবাইকেই হত্যা করেছে ইজরায়েল। পাঁচ ভাইবোনের সবাই মৃত, মা মৃত, দুই পিসি মৃত। পিসিদের মেয়ে, ছেলে। এই জীবনে আর কাউকেই ফিরে পাবেন না ইয়াসমিন। নিজের পরিবারের ৩২ জন সদস্যকে হারিয়েছেন ইয়াসমিন, এই হামলাতে, যাদের অধিকাংশই মহিলা। মেলিসার বাবা, তার বাবা-মা, তার বোন এবং তাদের সন্তানদেরও হত্যা করেছে ইজরায়েল। যার ফলে জুদাহ পরিবারের মোট মৃতের সংখ্যা ৬৮। আর মেলিসার মতো একরত্তি প্রাণ যুদ্ধে না মরে বেঁচে থাকা এক অসাড় জীবন।
আরও পড়ুন- প্রতি ১০ মিনিটে ১টি শিশুর মৃত্যু! ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু গাজায়! আর কত?
আল-আকসা শহিদ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধানের মতে, মেলিসাকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর খুব প্রয়োজন। মেলিসার কশেরুকার টি১২-এর একাধিক টুকরো হয়ে গিয়েছে। মেরুদণ্ডও একাধিক জায়গায় ভাঙা। অর্থাৎ বুকের নীচ থেকে বাকি অংশ সে ব্যবহারই করতে পারবে না। ছোট্ট মেলিসা শারীরিকভাবে স্থিতিশীল। বুক থেকে শুরু করে নীচের বাকি অংশ অবশ হয়ে গেছে তাঁর। কিন্তু ফিজিওথেরাপি এবং ক্রমাগত ভরসা জুগিয়ে গেলে মেলিসা একটু ভালো থাকতে পারবে। কিন্তু মেলিসার শরীরে ওই লোহার টুকরোগুলি রয়ে যাওয়ায় সংক্রমণ এবং অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি বাড়তে থাকবে, যার ফলে একাধিক অঙ্গ বিকল হতে শুরু করতে পারে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এখন এমন বহু ঘটনা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাঁদের যা নিজেদের চিকিৎসার বইয়েও কখনও দেখেননি তারা। এ পর্যন্ত ১২ জন রোগীর চিকিৎসা করেছেন চিকিৎসক আয়মেন হাব, সকলেই ইজরায়েলি আক্রমণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। মেলিসার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সম্পর্কেও খুব যে আশাবাদী তারা, তা নয়। মেলিসা প্রাণে বেঁচে গেলে ভবিষ্যৎ যে যন্ত্রণাদায়ক হবে তা নিশ্চিত। বাকি জীবন হুইলচেয়ারেই কাটাতে হবে তাকে।
গাজা উপত্যকার হাসপাতালগুলিতে পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত জটিল হচ্ছে। চিকিৎসার সুবিধা ক্রমেই কমছে। জ্বালানি না থাকায় সৌর-চালিত জেনারেটরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকরা। পর্যাপ্ত ওষুধ নেই, প্রাণ বাঁচানোর পরিকাঠামো নেই, কর্মীদের অভাব তুমুল।
আরও পড়ুন- স্নান-খাওয়ার জলটুকুও নেই! দূষিত সমুদ্রের জলেই বাঁচছে গাজার শরণার্থী শিশুরা
আল-আকসা শহিদ গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের মতো বড় কেন্দ্রীয় হাসপাতাল নয়। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর আক্রমণে ভেঙে গিয়েছে যাবতীয় পরিকাঠামো। দেইর এল-বালাহ শহরের জন্যই তৈরি হয়েছিল এই হাসপাতাল, মাত্র ১৬ জন ডাক্তার রয়েছেন এখানে। একমাসের উপর ধরে ইজরায়েলের আক্রমণ চলায় রোগীদের সামলানোর মতো পরিষেবা পণ্যও নেই তাঁদের। ক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি রোগীদের চিকিত্সা করতে হয়েছে ছোট এই হাসপাতালটিকে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত্রি ৩ টে পর্যন্ত ৩০টি বড় এবং ১৫টি ছোট চিকিৎসা চলতেই থাকে।
মেলিসার মা নয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন। ইজরায়েল যখন বোমা ফেলছে গাজায়, ঠিক সেই নৃশংস আক্রমণের সময়ই প্রসবযন্ত্রণা ওঠে তাঁর। ধ্বংসস্তূপের নীচে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় মেলিসার মাকে। প্রাণহীন দুই যমজ সন্তানের মাথা আটকে ছিল গর্ভের পথে। ইজরায়েলি হামলায় ১১,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৮,০০০ শিশু ও নারী। প্যালেস্তাইনের সরকারি সূত্রের হিসেব বলছে, এ পর্যন্ত ৪,৬০৭ শিশুসহ ১১,১৮০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এই যুদ্ধে। প্রায় ১,৭০০ শিশু সহ ৩,০০০ এরও বেশি মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে রয়েছেন।
মেলিসা এখন দেইর এল-বালাহে পিসি ইয়াসমিনের সঙ্গে তাঁর বাড়িতেই আছে। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য মিশরের রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজা ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। ইয়াসমিন মেলিসাকে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবেন ঠিকই। কিন্তু যুদ্ধ মেলিসাকে সুস্থ হতে দেবে না কখনই, মেলিসার মতো অজস্র শিশু এভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে গাজায়।