জোব চার্নক তামাক খেয়েছিলেন গাছতলায় বসে, কলকাতার এই বাজারের নাম সাক্ষী ইতিহাসের

কলকাতার বিভিন্ন এলাকার মতোই কলকাতার বাজারগুলির নামের পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা গল্প।

 

বাজারের বয়স প্রায় দেড়শো বছর হলেও মানুষের কাছে সে নিউ মার্কেট নামেই পরিচিত কেন? উচ্চারণের ভুলে জগু হয়ে যাওয়া যদু আসলে কে? কংক্রিটের জঙ্গলে ঢাকা এলাকার নাম কি সুন্দরবনের এক ধরনের ম্যানগ্রোভের নাম থেকে অনুপ্রাণিত? বহু কি হিন্দি ভাষার পুত্রবধূ নাকি বাংলা ভাষার অনেক? কলকাতার চারটি বিখ্যাত বাজার এলাকার নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে সাধারণ মানুষের অজানা গল্প।

কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে শুধু ব্রিটিশদের জন্য কোনও বাজার ছিল না। তথাকথিত হোয়াইট টাউন, অর্থাৎ যেখানে শুধু ব্রিটিশরা থাকবে তার মধ্যে ডালহৌসি এলাকায় একটি বাজার এবং নিকটবর্তী এলাকায় টেরিটিবাজার থাকলেও তার আশপাশের এলাকায় ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের বহু মানুষ বসবাস করতেন। সেই কারণে বহু ব্রিটিশ সেখানে যেতে পছন্দ করতেন না। কথিত আছে যে, বর্তমান লিন্ডসে স্ট্রিট এলাকায় ফ্রেনউইকস বাজার নামে একটি ছোট বাজার থাকলেও সেই বাজারে অনেককিছুই পাওয়া যেত না। ব্রিটিশদের অনুরোধে ১৮৭১ সালে এক নতুন বাজার তৈরির প্রস্তাব পাশ হয়। স্যার স্টুয়ার্ট সন্ডার্স হগ সেই সময় কলকাতা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৮৭৪ সালে ধর্মতলা এলাকায় তৈরি হলো এক প্রকাণ্ড বাজার। ব্রিটিশরা খুশি হয়ে সেই নতুন তৈরি হওয়া বাজারের নাম দিল নিউ মার্কেট। ১৯০৩ সালে স্যর স্টুয়ার্টের নামে এই বাজারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় স্যার এস.এস. হগ মার্কেট। নাম পরিবর্তন হলেও আজ অবধি মানুষের কাছে এই বাজার নিউ মার্কেট নামেই বেশি পরিচিত। নিউ মার্কেটের বাজার তৈরির সময় ইংল্যান্ডের হাডার্সফিল্ড থেকে একটা বিশালাকার ঘড়ি আনা হয়েছিল, যা আজও নিউ মার্কেটের উঁচু ঘড়ি মিনারে দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে নিউ মার্কেটে প্রায় ২০০০-এর বেশি বিভিন্ন জিনিসপত্রের দোকান রয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেকদিন এখানকার বাজারে জনসমাগম হয়।

জগুবাবুর বাজার নামটার সঙ্গে বহু মানুষ পরিচিত হলেও আসলে মানুষটার নাম যদু ছিল, তা খুব কম মানুষই জানেন। রানি রাসমনির দ্বিতীয় কন্যা কুমারী দাসীর ছেলের নাম ছিল বাবু যদুনাথ চৌধুরী। রানি রাসমনি এই বাজার এলাকায় এক বিশাল বাগানবাড়ি কিনে সেই বাড়ি এই নাতিকে দান করেছিলেন। যদুনাথ এই বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন বিক্রেতাদের তাঁদের জিনিসপত্র বিক্রি করতে দিয়েছিলেন। সেই কারণে বাবু যদুনাথ চৌধুরীর নাম থেকে এই বাজারের নাম হয়ে যায় যদুবাবুর বাজার। পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের উচ্চারণের ভুলে এই শতাব্দীপ্রাচীন বাজারের নাম হয়ে যায় জগুবাবুর বাজার।

আরও পড়ুন: পথের মাঝে বাড়ি, দু’ভাগ হয়ে গেল বাসরাস্তা! কলকাতার এই অঞ্চলে ইতিহাস কথা বলে

দক্ষিণ কলকাতার বাজার এলাকার কথা বললে গড়িয়াহাট এলাকার নাম আসতে বাধ্য। গড়িয়াহাটের বিশাল এক এলাকাজুড়ে রাস্তার দু'পাশে অসংখ্য দোকান রয়েছে। যদিও গড়িয়াহাটের নামের মধ্যে হাটের উপস্থিতি তার বাজারের পরিচিতি প্রদান করে কিন্তু গড়িয়া অংশটা একটা হেঁয়ালির মতোই থেকে যায়। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত থাকলেও সবথেকে গ্রহণযোগ্য মতবাদটা বর্তমানে শুনলে অনেকেই অবাক হয়ে যায়। সম্ভবত, গুড়িয়া অথবা গোড়িয়া গাছের নাম থেকে গড়িয়া নামটি এসেছে। এই ধরনের গাছ বর্তমানে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত প্রাচীন কলকাতার এই এলাকায় গুড়িয়া গাছের জঙ্গলের কাছে বসা একটা হাটের নাম থেকেই গড়িয়াহাট নিজের নাম পেয়েছে।

মধ্য কলকাতার বউবাজারের নাম আসলে ছিল বহু বাজার। এই বহু শব্দের উৎস নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, জনৈক বিশ্বনাথ মতিলাল তার পুত্রবধূকে এই বাজার উপহার দিয়েছিলেন। হিন্দি ভাষায় পুত্রবধূকে বহু বলা হয়। তাই এই বাজারের নাম হয় বহু বাজার। যদিও কথিত আছে যে, বিশ্বনাথ মতিলাল নুনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বিশ্বনাথের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারেননি। বহু বাজারের নামের অপর উৎস বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কথিত আছে যে, এই এলাকায় এক প্রকাণ্ড এলাকাজুড়ে বিভিন্ন জিনিসের বাজার বসত। খাদ্যসামগ্রী থেকে বিভিন্ন জামাকাপড় এবং প্রসাধন সামগ্রী এইসব বাজারে বিক্রি হতো। এই বিভিন্ন রকমের জিনিসের বাজারের কারণে এলাকার নাম হয়ে যায় বহু বাজার।

কলকাতার পুরনো বাজার সম্পর্কে কথা উঠলেই বৈঠকখানা রোড এলাকার বাজারের নাম আসতে বাধ্য। ১৭৫৮ সালের এক মানচিত্রে এই বাজারের নাম দেখতে পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, ব্যবসায়ীরা যাত্রাপথে অথবা দিনের শেষে এই এলাকার এক বিরাট বটগাছের নিচে বসে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতেন এবং গল্প করতেন। এই বট গাছতলার আড্ডা থেকেই এলাকার নাম হয়ে যায় বৈঠকখানা। বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায় যে, জোব চার্নক নিজেও কলকাতায় আসার পর এই গাছতলায় বসে তামাক খেয়েছিলেন।

কলকাতার বিভিন্ন এলাকার মতোই কলকাতার বাজারগুলির নামের পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা গল্প। হয়তো এই বাজারগুলো আধুনিক শপিং মলের আগ্রাসন দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। সারাদিনে বাজারে অসংখ্য কোলাহলের মধ্যে তাদের সেই না-বলতে পারা গল্প হয়তো চাপা পড়ে যায়।

More Articles