দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি
Harish Mukherjee Road: দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোড অথবা হরিশ মুখার্জি পার্ক যার নামে সেই হরিশ মুখার্জি কে?
২০০১ সালে সরকারের তরফে ঘোষণা করা হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার নাম এইবার থেকে কলকাতা। কলকাতার নাম আবার কলকাতা হবে কীভাবে? আসলে কলকাতার নাম ইংরেজিতে হয়ে গিয়েছিল ক্যালকাটা। সৌজন্যে, প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন। এই ঘোষণা সাধারণ মানুষের মনে উদ্বেগ অথবা আনন্দ কোনওটাই বৃদ্ধি করতে পারেনি। বেশিরভাগ হিন্দীভাষীদের জন্য কলকাতা কলক্কাত্তাই থেকে গেল। বাঙালিরা তো এমনিতেই শহরটাকে কলকাতা বলেই ডাকে। তাদেরও সেইরকম খুব একটা মাথাব্যথা হলো না। নাম বদল অথবা নামের পুনঃনিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্ন না থাকলেও এই প্রশ্নটা থেকেই যায় যে কলকাতা শহরের নাম কলকাতা কেন হলো? যদিও বেশিরভাগ বাঙালির সেই ব্যাপারেও কোনও মাথা ব্যাথা নেই। কলকাতার নাম কলকাতা হলো কেন সেটা জেনে কী হবে? কলকাতার নামের উৎস জানলে কি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যাবে, সহজে সরকারি চাকরি মিলবে, নাকি বাজারে সবজির দাম কমবে? কোনওটাই হবে না, উল্টে বেশিরভাগ মানুষের মতে সময় নষ্ট হবে। তাহলে শহরের নামের উৎস জেনে লাভ কী?পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী এই শহর বহু মানুষের বাসস্থান এবং কর্মক্ষেত্র হওয়ার পাশাপাশি বাঙালি তথা ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের সাক্ষী। তাই শহরের পরিচয় শুধু সাধারণ জ্ঞান নয় বরং বাঙালির অতীতকে জানার এক পথ। এই অতীতকে খুঁজে বের করে তাকে জানা এবং সেই অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার কারণ যে জাতি নিজের অতীতকে জানে না এবং তার থেকে শিক্ষা নেয় না সেই জাতির সঠিক মাত্রায় উন্নতি সম্ভব নয়।
কলকাতার ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই সম্ভবত কলকাতার নামের উৎস সংক্রান্ত বিভিন্ন গল্প কলকাতার অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত গল্প হলো এক ইংরেজ এবং চাষির গল্প। গল্প অনুসারে, এক ইংরেজ কলকাতায় ভ্রমণকালীন নদী থেকে জমির দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই এলাকার নাম কী? চাষি ইংরেজের ভাষা বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন যে ইংরেজ তাঁর জমির পাশে কেটে রাখা ঘাসের দিকে আঙুল করে কিছু জিজ্ঞাসা করেছে। তাই উত্তর দিয়েছিলেন 'কাল কাটা' অর্থাৎ কাল ঘাস কেটেছেন। সেই থেকে কলকাতা নাকি তার নাম পেয়েছিল। শুনতে হাস্যকর তো বটেই, এই গল্প থেকেই বোঝা যায় যে বাঙালি কতটা ইতিহাস বিমুখ। ইংরেজরা বাংলায় আসার বহু আগেই বিভিন্ন নথিতে অথবা রচনায় কলকাতার নাম পাওয়া যায় যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইন-ই-আকবরি। এছাড়া কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চের কবরখানায় থাকা রেজা বিবির কবরে লেখা সময়কাল ইংরেজদের বাংলায় আগমনের অনেক আগের সময় নির্দেশ করে। নিজের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই এই খোস গল্প মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। ইংরেজদের আগমনের পূর্বে থাকা কোনও এলাকার নাম ইংরেজদের দেওয়া হতেই পারে না। যেটা বাস্তবে সম্ভব তা হলো, সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলকাতা নামের তিনটি বড় গ্রামকে একত্রিত করার পরে ইংরেজরা পুরো এলাকাটিকে কলকাতা বলে সম্বোধন করে।
আরও পড়ুন- হাতিবাগানে কার হাতি ছিল, উল্টোডাঙা কেন উল্টো? কলকাতার এইসব অঞ্চলের নাম যেভাবে এসেছে
আরও পড়ুন- তোপসে, ট্যাংরা, চিংড়ি অথবা বেলে, মাছ-ভাতের রসায়ন মিশে কলকাতার রাস্তাতেও
বহু ক্ষেত্রে বইতে কোনও প্রশ্নের উত্তর পড়লেও পরীক্ষার পরে মানুষ নিজের জীবনের ক্ষেত্রে সেই প্রশ্নের উত্তর ভুলে যায়। দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোড অথবা হরিশ মুখার্জি পার্ক যার নামে সেই হরিশ মুখার্জি কে? শহরের নামের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস অথবা পরিচয় জুড়ে থাকতে পারে কিন্তু হরিশ মুখার্জির সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র কী? কে এই মানুষটি? হিন্দু প্যাট্রিয়ট নামে একটি খবরের কাগজ বের করতেন তিনি, আবার নিজেই সেই কাগজে লিখতেনও। লেখার বিষয় কি ছিল? নীল চাষিদের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখতেন হরিশ। ইংরেজরা তো সবার উপরেই অত্যাচার করত। এই ভদ্রলোক হঠাৎ নীল চাষিদের নিয়েই বা লিখতে গেলেন কেন? চাষিদের দিয়ে ধান, আখের বদলে জোর করে নীল চাষ করানো, চাষিরা চাষ করতে না চাইলে তাদের ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, বাড়ি ভাঙচুর করা, বাড়ির লোককে বন্দি করা এবং বহু ক্ষেত্রে প্রাণে মেরে ফেলা এবং কোনও সহৃদয় ইংরেজ অফিসার চাষিদের পক্ষে কথা বললে তার বদলি করে দেওয়া বিষয়ে কেনই বা লিখবেন না একজন সাংবাদিক?
নীল চাষিদের উপর অত্যাচার নিয়ে দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নামে নাটক লিখেছিলেন, এই তথ্য মোটামুটি সকলেরই জানা সিলেবাসের সৌজন্যে। যেটা জানা নয় তা হলো, নীলদর্পণ প্রকাশের সময় নীল কমিশন চলছিল যেখানে হরিশ মুখার্জি সাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা এই সাংবাদিক নিজের ক্ষমতায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন আর এই নীল চাষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়ে প্রচুর টাকা অভাবী মানুষদের মধ্যে দানও করেছিলেন। আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি, ফলে সঞ্চয় ছিল না। পরিবারের জন্য অর্থ রেখে না যেতে পারলেও নীল চাষিদের অবস্থার ব্যাপারে তার চিন্তা ছিল বেশিই। ৩৭ বছর বয়সে বেদনাদায়ক মৃত্যুর আগে অবধি তিনি নীল চাষিদের উপর নেমে আসা ইংরেজ চাবুকের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। খুব স্বল্প পরিসরে হলেও ইংরেজ বিরোধিতা করে চাষিদের বিচার পাইয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তবে হয়তো শেষ অবধি লড়াই চালিয়ে না যেতে পারার দুঃখও ছিল কোথাও। এই মানুষটির কথা সিলেবাসে নেই, নেই চর্চাতেও। এই শহরে থাকা এবং আগত বহু মানুষ শুধু একটা রাস্তার নামে চেনেন এই বিখ্যাত মানুষকে। অস্তিত্ব বলতে আর আছেই বা কী, রাজধানীর একটা রাস্তা এবং একটা পার্ক ছাড়া।
তথ্য ঋণ : ডিসকভারিং কলকাতা, সেই সময় (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )