তোপসে, ট্যাংরা, চিংড়ি অথবা বেলে, মাছ-ভাতের রসায়ন মিশে কলকাতার রাস্তাতেও

Old Kolkata Places Names: কলকাতার কিছু জায়গার নামের আড়ালে রয়েছে মাছের অনুষঙ্গ

কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি। বাঙালিকে চেনার এ এক চিরায়ত সহজ উপায়। আম-বাঙালির প্রাণের শহর কল্লোলিনী কলকাতা। তাকে ঘিরে কত কত ইতিহাস। সেই কবে গোবিন্দপুর, সুতানুটি আর কলিকাতা গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই শহর। কত শত জনপদ রয়েছে গোটা শহর জুড়ে। এক এক জনপদের নামের পিছনে লুকিয়ে আছে নির্দিষ্ট ইতিহাস। এমনকী খোদ এই কলকাতার এমন নামকরণের পিছনেও তো রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। তা নিয়ে অবশ্য বিতর্কও কম হয়নি। কলকাতার বেশ কিছু জায়গার নামের মধ্যে জুড়ে আছে ‘টোলা’, কিছু জায়গার নাম শেষ হয়েছে ‘দহ’ দিয়ে, আবার বেশ কিছু অঞ্চলের নামের শেষে রয়েছে ‘বাগান’। এই প্রতিটি জায়গারই রয়েছে পৃথক পৃথক সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ইতিহাস।

তা বলে খোদ হেঁশেল নিয়েও নামকরণ! তা খানিক অবাক করে ঠিকই! এই যে বাঙালির মাছ-ভাতের সংস্কৃতি, তার সঙ্গেও তো হুবহু মিলে যায় বেশ কিছু রাস্তার নাম। অবশ্য তার ঠিক কতটা জ্ঞাতে আর কতটা অজ্ঞাতে তা বলা মুশকিল! তবুও অতি পরিচিত কিছু মাছকে যখন পাত ছেড়ে লাফিয়ে ঠিকানার ফলকে উঠে যেতে দেখি, তা অবাক করে বই কি! আর এই অবাক করার জেরেই আমরা হানা দিই অতীতের পাতায়। খুঁজে আনি ধুলো পড়া সেই ইতিহাস।

আরও পড়ুন- ‘ইন্ডিয়ায় সহজে মাছ মেলে না’, তাই ওপার থেকে এল হাঁড়িভর্তি সরষে-ইলিশ

একে কলকাতা, তায় বাঙালি – ফলে নিত্যদিনের পাতে মাছ থাকবে না তা কি হয়! মাছ কেনা বা মাছের চর্চার ছাপ পড়েছে কলকাতার স্থান-নামেও। উত্তর, মধ্য, দক্ষিণ, কলকাতার তিনদিকেই রয়েছে তার অস্তিত্ব। তোপসিয়া, ট্যাংরা, চিংড়িঘাটা, কিংবা বেলেঘাটা, নামের মধ্যেই বসে আছে মাছ বাবাজি। এমনকী খোদ উত্তর কলকাতার মেছুয়া, তার নামেও তো আঁশ আঁশ গন্ধ! যদিও এ রাস্তায় পা দিলে পচা ফলের গন্ধতেই নাক ঢাকতে হয়! কিন্তু নাম মনে এলে মাছের অনুষঙ্গই মনে অভিঘাত তৈরি করে।

তোপসিয়া

তোপসিয়ার এই রূপ নামের আড়ালে যে বাঙালির প্রিয় তোপসে মাছের অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে, তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আদপে একেবারে প্রাথমিক পর্বে এমনটা ছিল না। ১৭৫৮ সালে মীরজাফরের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের ৫৫টি গ্রাম কিনে নেয় এবং মারাঠা ডিচের বাইরে থাকা এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেই সময় থেকে পরিচিত হতে শুরু করে ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম হিসেবে। তবে কালের বিবর্তনে নাম বদলে গিয়েছে। এক সময় এখানে প্রচুর জলাভূমি ছিল। ঐতিহাসিকদের বই থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলের মানুষদের শখ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবিকা ছিল মাছ ধরা। এই অঞ্চলের জলাভূমিতে প্রচুর পরিমাণে তোপসে মাছ পাওয়া যেত বলেও জানা যায়। সেই কারণেই হয়তো মাছের নামে অঞ্চলের নাম হয়ে যায় তোপসিয়া। পরে যত দিন যেতে থাকে, এখানকার সব জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠে অনেকগুলি চামড়ার কারখানা। পরে আবার কারখানাগুলি ভেঙে গড়ে উঠেছে বহুতল অফিস, অট্টালিকা। যদিও আজ তোপসিয়া থেকে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে তোপসে মাছ।

ট্যাংরা

কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলে চিনা সম্প্রদায়ের বাড়বাড়ন্ত। এক টুকরো চিন রয়েছে এখানে। কলকাতার চায়না টাউনও বলা হয় এই অঞ্চলকে। তার নামের পিছনেও লুকিয়ে আছে ট্যাংরা মাছের অনুষঙ্গ। তোপসিয়ার নিকটবর্তী এই অঞ্চলও সেই সময় ডিহি পঞ্চান্নগ্রামের অংশ ছিল। ইতিহাস বলছে ১৯১০ সাল নাগাদ চিনা জুতো প্রস্তুতকারীরা এই জলাভূমি পরিবেষ্টিত অঞ্চলে এসে বসতি গড়ে তোলেন। পরে তাদের উদ্যোগে চামড়ার কারখানা গড়ে ওঠে। এখানকার জলাভূমিতেও তোপসিয়ার মতো প্রচুর ট্যাংরা মাছ পাওয়া যেত বলে এই অঞ্চলের নামই হয়ে যায় ‘ট্যাংরা’। অনেক তাত্ত্বিক-গবেষক আবার বলে থাকেন চিনাদের এক বিশেষ দেবতা ‘টাং-রা’র নাম থেকেই নাকি এমন নামের উৎপত্তি। বিতর্ক থাকলেও মাছের নামের সঙ্গে মিলটাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না!

আরও পড়ুন- সাবর্ণদের ৪১৩ বছরের দুর্গাপুজো! পোড়া ল্যাটা মাছের ভোগে আজও অমলিন দুর্গার আরাধনা

বেলেঘাটা

আরেকটু দূরে গেলেই পড়বে পূর্ব কলকাতার বর্ধিষ্ণু জনপদ বেলেঘাটা। বেলেঘাটার নাম কীভাবে এল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও দ্বন্দ্ব চলছে। যদিও এ দ্বন্দ্ব তো অকৃত্রিম। কিন্তু কিছু জায়গায় উল্লেখ মেলে, এই অঞ্চলের নাম হয়েছে বেলে মাছের নাম থেকেই। এমনিতে সকলেরই জানা, নরম বেলে মাছ অগভীর জলে বালি-মাটির উপর শুয়ে থাকে। আর এই অঞ্চলে একসময় বালির ঘাট ছিল। তাই সে ঘাটে জলের মধ্যে অজস্র বেলে মাছের দেখা মেলা যে বিশেষ অবিশ্বাস্য নয়, তা মেনে নেন অনেকেই।

চিংড়িঘাটা

ঐতিহাসিক পি.টি. নায়ারের ‘পুরনো কলকাতার চালচিত্র’ গ্রন্থে চিংড়িঘাটা সম্পর্কে সেই একই গতে বাঁধা কথা বলা হয়েছে। সেই একই জলাভূমি, একই মাছ – শুধু মাছের নামটুকু আলাদা, এই যা! আর তার সঙ্গে বদলে গেছে জায়গার নামটাও। চিংড়িঘাটায় চিংড়ি, তোপসিয়ায় তোপসে কিংবা ট্যাংরায় ভালো দিশি ট্যাংরা আজ আর পাওয়া যায় না। কিন্তু কল্পনায় স্বপ্ন বুনতে ওস্তাদ বাঙালি, শুধু সেই স্বপ্নের ধারে শান কমেছে। ঐতিহাসিক অঞ্চলের নামমাহাত্ম্য নিয়ে আজ আর কেউই ভাবিত নন বিশেষ।

More Articles