'বুলডোজার' থেকে 'আদানিকে স্কুল বিক্রি'! যেভাবে বারবার এক্তিয়ার ভেঙেছেন 'বিচারপতি' অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

Abhijit Ganguly: কিছুদিন আগেই পাঞ্জাবির বিজ্ঞাপন করে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন অভিজিৎ। এমনকী বিচারপতির পদে থেকে একাধিক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দিতে দেখা গিয়েছিল অভিজিৎবাবুকে।

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিচারপতির ভূমিকায় যিনি ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন 'মসিহা'। দুর্নীতিতে মজে থাকা রাজ্যে কীভাবে যেন তিনিই হয়ে উঠেছিলেন আস্ত ন্যায়দণ্ড। সেই 'মসিহা' অবশ্য বিচারপতির ভূমিকা শেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতেই বেশি আস্থা দেখাতে চেয়েছেন এবার। মঙ্গলবারই বিচারপতি হিসেবে তাঁর শেষ দিন। এদিনই বিচারপতি হিসেবে ইস্তফা দিয়ে এসেছেন। তারপর সাংবাদিক বৈঠক করে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। আসন্ন লোকসভা ভোটে তমলুক কেন্দ্র থেকে প্রার্থীও হতে চলেছেন বলে শোনা যাচ্ছে কথাবার্তা।

নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় অ্যাদ্দিন জান-প্রাণ দিয়ে লড়েছেন অভিজিৎবাবু। অন্তত তেমনটাই ঠাওর হয়েছে। তবে সেই বিচারের ন্যায়দণ্ড নামিয়ে রেখে এবার রাজনীতির ময়দানে নামছেন তিনি। জানিয়েছেন, অবসরের নাকি আর বেশি দেরি নেই তাঁর। তাই স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ভোটে লড়তে চান। ইতিমধ্যেই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, বিচারপতি হিসেবে তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে। অনেকেই বলেছেন, গোড়া থেকেই গেরুয়া শিবিরের দিকেই নাকি খানিক ঝুঁকে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি রয়েছে বলেই দাবি নিন্দুকদের।

আরও পড়ুন: ‘তালপাতার সেপাই’! অভিষেকে এত কেন ক্ষুব্ধ ‘বিজেপি’র অভিজিৎ?

শিক্ষায় দুর্নীতি মামলায় একের পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের কথা শোনা গিয়েছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। তার প্রতাপের সামনে কার্যত কোণঠাসা হয়েছিল তৃণমূল সরকার। সেই অভিজিতের বিজেপি-যোগের কথা সামনে আসতেই সব হিসেব-নিকেশ গেছে গুলিয়ে। অনেকেই মনে করেছিলেন, বাম-ঘনিষ্ঠ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কোনওদিনও রাজনীতির রাস্তায় গেলে বামেদের পথই তার কাছে খোলা। কিন্তু সেই সমস্ত হিসেব নিকেশ গুলিয়ে গেরুয়া শিবিরের প্রতিই আস্থা দেখিয়েছেন অভিজিৎ।

বিচারপতি জীবনেও বহু বার এক্তিয়ারের বাইরে বেরিয়ে কথা বলতে দেখা গিয়েছে। কিছুদিন আগেই পাঞ্জাবির বিজ্ঞাপন করে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন অভিজিৎ। এমনকী বিচারপতির পদে থেকে একাধিক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দিতে দেখা গিয়েছিল অভিজিৎবাবুকে। প্রশ্ন উঠেছিল, আদৌ একজন বিচারপতি হিসেবে তেমনটা করা সাজে কিনা তার। এজলাসে বিচারপতির চেয়ারে বসেও কম আলটপকা মন্তব্য করেননি অভিজিৎ গাঙ্গুলি।

কখনও তৃণমূলের সেকন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনৈতিক বলে মানতেই অস্বীকার করেছেন তিনি। এমনকী এই নামটি তিনি শুনতে বা উচ্চারণ করতে পর্যন্ত নারাজ বলে দাবি করেছেন। যদিও বরাবরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূয়সী প্রশংসা করে এসেছেন তিনি। তাঁর মতে, মমতার মতো ‘সিজনড পলিটিশিয়ান’বা ‘দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ’ কমই রয়েছেন। মমতাকে ভালো বললেও অভিষেককে কোনওদিনই পছন্দ করতে পারেননি অভিজিৎ।

শুধু অভিষেক প্রসঙ্গেই নয়, একাধিক বার তাঁর বক্তব্যে বিজেপি সরকার ও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির কথা এসেছে। গত বছর জুলাই মাসে স্কুলের জীর্ণ দশা নিয়ে ভরা আদালতে ইস্টার্ন কোলফিল্ডকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ইস্টার্ন কোলফিল্ডের উদ্দেশে ক্ষুব্ধ বিচারপতির প্রশ্ন করেছিলেন, 'দেশে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করা হচ্ছে আর শিক্ষকদের এই অবস্থা? কোনও সভ্য নাগরিক এটা সহ্য করতে পারে?'। এখানেই শেষ নয়, ওই শুনানিতে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ে বলে বসেন, 'স্কুল না চালাতে পারলে আদানিকে বেচে দিন।' মোদি ও তার বিজেপির আদানি-ঘনিষ্ঠতা কারওর অজানিত নয়। এ নিয়ে নানা চর্চাও রয়েছে নানা মহলে। ইতিমধ্যেই একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান আদানির হাতে তুলে দিয়েছেন মোদি সরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সরব সব মহল। এই পরিস্থিতিতে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এ হেন বক্তব্য় সেই বেসরকারিকরণেরই সমর্থন বলেই মনে করেছিলেন অনেকে।

বিচারপতি হিসেবে বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছিল অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে। কলকাতা পুরসভাকে বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলে বসেন, “দরকার পড়লে যোগী আদিত্যনাথের থেকে কিছু বুলডোজার ভাড়া করুন।” যোগী-রাজ্যে বুলডোজার নীতি নিয়ে সমালোচনা চারদিকে। বিচারপতি হিসেবে সেই বিষয়টিকে সমর্থন করা কতটা যথাযথ, সেসময়ই প্রশ্ন উঠেছিল তা নিয়ে।

বিচারপতির আসনে থাকাকালীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে একাধিক বার আক্রমণ করেছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। একবার তো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সিবিআইয়ের কাজে ক্ষুব্ধ এ তিতিবিরক্ত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করার কথাও এজলাসে বসে বলে ফেলেছিলেন। যে ইডি-সিবিআইয়ের কার্যপদ্ধতি নিয়ে এতদিন প্রশ্ন তুলতেন প্রাক্তন বিচারপতি, আজ সেই সব ইতিহাস পিছনে ঠেলে আজ নিজেই বিজেপিতে।

গেরুয়া-প্রীতি কি দেখাননি তিনি বিচারপতির আসনে থেকেও। বারবার রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে ক্লিনচিট দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই চেষ্টার অবশ্য় ত্রুটি দেখা গেল না মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকেও। নাম না করেই নারদা কাণ্ড গোটাটাই অভিষেকের 'ষড়যন্ত্র' বলে দাগিয়ে দিলেন তিনি। শুভেন্দু যে কোনওকালেই কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন বা তিনি যে কস্মিনকালেও টাকা নেননি, বিচারপতির এক্তিয়ার থেকে বেরিয়ে তা-ও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে কোনও রকম তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই।

আরও পড়ুন: ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও কেন সিপিএম বা কংগ্রেসে নয়? যা জানালেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

আদালতের কাছে এক এবং একমাত্র বিবেচ্য তথ্যপ্রমাণ। বিচারপতির আসনে বসে নিজের এক্তিয়ার ভেঙে বহু সময়েই তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কথা বলে বসেছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, এমন দাবি করেছেন অনেকেই। বরাবরই যে কোনও মামলাতেই খোলাখুলি ভাবে নিজের পর্যবেক্ষণ সকলের সামনে রাখতে পছন্দ করেছেন। এবার অবশ্য সেই বিচারপতির ছড়ি তাঁর হাতে আর নেই। ফলে নিরপেক্ষ মন্তব্যের দায়ও যে আর তাঁর নেই, তা কার্যত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকেই। তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সন্দেশখালি, বিভিন্ন বিষয়েই খোলামেলা মন্তব্য রেখে নিজের জায়গাটা এদিন পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

More Articles