উত্তরপ্রদেশের জয় বিজেপিকে '২৪ দিল্লি বিজয়ের দিকে এগিয়ে দিল?

উত্তরপ্রদেশ যার দিল্লি তাঁর এই কথা যেন ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমেই ধ্রুবক হয়ে উঠছে। অতীত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে এই বিষয় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ,চরন সিংহ থেকে ভারতীর রাজনীতির বর্ণময় চরিত্র ইন্দিরা গান্ধী সকলেই উত্তরপ্রদেশ থেকে লড়েই দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন। এই তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদী প্রত্যেকেই লোকসভা ভোটে লড়েছেন উত্তরপ্রদেশ থেকেই। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট কীভাবে নয়াদিল্লির রাজনীতির নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠেছে উত্তরপ্রদেশ।

২০২২ এর উত্তরপ্রদেশ বিজয় যেন ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিজেপিকে দিল্লির মসনদের দিকে খানিক এগিয়ে দিল। উত্তরপ্রদেশে জয় নিশ্চিত হতেই সংবাদমাধ্যমে এই কথা স্পষ্ট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। এই প্রসঙ্গে মোদীর স্পষ্ট বক্তব্য ‘২০১৯ সালে লোকসভা জিতে আসার পরে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছিলেন ২০১৭ এর উত্তরপ্রদেশ বিজয় আপনার লোকসভা জয়ের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছে। আশা করবো সেই বিশ্লেষকরা এই ক্ষেত্রে ও বলবেন ২০২২ এর উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপির জয় ২০২৪ এর লোকসভা ভোটে আবার বিজেপির জয়কেই নিশ্চিত করবে’।

এমনকি ভারতের সর্বাধিক বৃহৎ রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা পাওয়ার পরই দলীয় কার্যালয়ে ২০২৪ এর লোকসভা ভোটের রোডম্যাপ ও বাতলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কেবল উত্তরপ্রদেশ নয়, পাশাপাশি উত্তরাখণ্ড, মণিপুর, গোয়া মিলিয়ে মোট চারটি রাজ্যেই জয়ী হয়েছে বিজেপি যা নিঃসন্দেহে লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিকে বাড়তি অক্সিজেন দেবে। আবার উত্তরপ্রদেশে বিজেপির পরপর দুবার ক্ষমতা লাভ সহজেই বুঝিয়ে দেয় হাথরসের ধর্ষণ বা লখিমপুর বিতর্ক সবকিছুকে ভুলে মানুষ বিজেপিকেই বেছে নিয়েছে।

২০১৪ সালে কেন্দ্রে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক বরাবরই অটুট থেকেছে। উত্তরপ্রদেশের লোকসভা আসন দেশের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি এবং উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে জাতধর্মের ভূমিকা কোনও পোড়খাওয়া রাজনীতিকই অস্বীকার করবেন না। তাই উত্তরপ্রদেশে হিন্দু ভোটারদের মন ধরে রাখা বিজেপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০২২ এর উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট প্রমাণ করে উচ্চবর্ণ হিন্দু তো বটেই, নিম্নবর্ণ দলিত, জাতভ এমনকি মুসলিম ভোট ও প্রচুর মাত্রায় বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে। আবার বিজেপির এই ভোট প্রাপ্তি স্পষ্ট করে দেয় উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে বাকি দুটি দল সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজবাদী পার্টি বহুক্ষেত্রেই তাদের কমিটেড ভোটার ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এম্নকী বহুজন সমাজবাদী পার্টির বেশিরভাগ জাতভ সম্প্রদায়ের ভোটার ও এবার বিজেপিকেই ভোট দিয়েছে। এর থেকেই স্পষ্ট বিরোধীদের প্রতি উত্তরপ্রদেশের ভোটার বিশ্বাস করেনি। মুখ্যমন্ত্রী যোগীর প্রতি হাজার অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁদের আস্থা অটুট।

আবার উত্তরপ্রদেশের ভোটারদের সর্ববৃহৎ অংশ হল লাভারথি সম্প্রদায়। এরা ও নিজেদের জাতিগত বিশ্বাসের জায়গা থেকে বিজেপিকেই ক্ষমতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ভোট দিয়েছে। ২০২২ সালের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ৪১.২৯ শতাংশ ভোট। ২০১৭ এর নির্বাচনের থেকে খানিক হলেও বেড়েছে ভোট। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অতিরিক্ত ভোট কীভাবে বিজেপির খাতায় এল? কংগ্রেস এবং বহুজন সমাজবাদী পার্টির বহু ভোটই তলায় তলায় বিজেপির কাছে গিয়েছে। বিএসপির যে মূল ভোটব্যাঙ্ক জাতভ গোষ্ঠী তারাও এবার বিভিন্ন কারণে বিজেপিকেই ভোট দিয়েছে। কারণ এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই হিন্দুত্ববাদের যে কমন অ্যাজেন্ডা তা মিলে গিয়েছে। 

এর পাশাপাশি ২০২৪ এ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির এগিয়ে থাকার অন্যতম কারণ এতদিনের প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের ধীরে ধীরে রাজনৈতিক জমি হারিয়ে ফেলা। শেষ দুটো লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের যে পরিসংখ্যান তা বিজেপির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে পাল্লা দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই হতাশাজনক। তাছাড়া ও এই যে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার ফলাফল তাতে ও প্রমাণিত কংগ্রেস নিজেদের রাজনৈতিক জমি হারিয়ে ফেলেছে। পাঞ্জাবের কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্ধ যে সাধারণ ভোটার গ্রহণ করেনি তা তাঁদের শোচনীয় হারেই স্পষ্ট। অন্যদিকে কংগ্রেসের মধ্যে নিজেদের জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য যে শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন তাও বহুদিন থেকেই দিশা হারিয়েছে। আবার বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে তৈরি যে নতুন ফ্রন্ট বিজেপির বিরুদ্ধে লোকসভা নির্বাচনে লড়বে বলে ভাবা হচ্ছে তাঁরাও কতটা সফল হবেন তা নিয়ে ও সংশয় থেকে যায়। সব মিলিয়ে বলাই যায় উত্তরপ্রদেশের বিপুল জয়লাভ বিজেপিকে দিল্লির সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে একধাপ এগিয়ে দিল।

More Articles