গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জিয়নকাঠি! যেভাবে পরিবেশের সর্বনাশ করছে কার্বন ডাই অক্সাইড

Global Warming: সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিত্য নতুন কলকারখানা বাড়তে থাকল, আর পাল্লা দিয়ে বাড়ল গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন, বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইড।

গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের প্রায় সব প্রথম শ্রেণির দৈনিক দখল করে রয়েছে দিল্লি। না, কোনও রাজনৈতিক খবরের জন্যে নয়, বরং ভয়াবহ রকম পরিবেশ দূষণের জন্যে। অনেক দিন ধরেই ভালো নেই দেশের রাজধানী। দিল্লির আকাশ বাতাস বিষিয়ে গিয়েছে, ধোঁয়াশায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। পরিবেশ দূষণ সৃষ্টিকারী গ্যাসের মাত্রা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাতাসের গুণগত মান (একিউআই) সূচক ‘অতি ভয়ানক’ পর্যায়ে নেমে এসেছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌছেছে যে,দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য দিল্লির রাস্তায় জল ছেটানো হচ্ছে, এমনকী দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী গোপাল রাই দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃত্রিম বৃষ্টির জন্যেও আর্জি জানাচ্ছেন।

বায়ু দূষণের জন্যে প্রধানত দায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2), সালফার ডাই অক্সাইডের(SO2)মতো গ্যাস, যাদের প্রধান উৎস জীবাশ্ম জ্বালানি, কলকারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোয়া। এদের ভিতরে CO2 অন্যতম প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাস। ‘গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্ট’ নামে একটি সংস্থা আছে, যাদের কাজ হল সারা দুনিয়ার গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাপ করা। সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, ২০২৪ সালে ভারতে শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত CO2-এর পরিমাণ বেড়েছে ৪.৬%, যেটি বিশ্বের প্রধান দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ। পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইডের(CO2)নির্গমনের হার এইভাবে বাড়তে থাকলে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে, যার ফলস্বরূপ আগত ছয় বছরে পরিবেশের গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে প্রায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস!

আরও পড়ুন: ভারতে এক বছরে ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু দূষণে! যেসব ভয়াবহ সত্য প্রকাশ রিপোর্টে

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যে সব গ্যাস তাপ ধরে রাখে বা সহজ করে বললে তাপ আটকে রাখতে পারে, তারাই গ্রিনহাউস গ্যাস। CO2 ছাড়াও মিথেন(CH4), জলীয় বাষ্প, নাইট্রাস অক্সাইড(N2O) এবং ওজোন (O3) এই গ্রিনহাউস এফেক্টের জন্য দায়ী। সূর্য ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ নির্গত করে, যেটি বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে ভূপৃষ্ঠে এসে পৌছায় ও ভূত্বক উত্তপ্ত করে। এই সূর্যালোকের কিছু অংশ আবার অবলোকিত (INFRARED) বিকিরণ হিসাবে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয়, যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত বেশি।

কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2)ও মিথেনের (CH4) মত গ্রিনহাউস গ্যাস গুলি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ বা শর্ট-ওয়েভ রেডিয়েশন শোষণ করতে পারে না, কিন্ত আবার অবলোকিত বিকিরণকে বন্দি করে রাখে, কারণ CO2 ও CH4 তিন বা ততোধিক পরমাণু নিয়ে গঠিত, ফলে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের মতো দ্বি-পারমাণবিক পরমাণুর থেকে তারা বেশী প্রসারিত হতে পারে। সেজন্যে তারা বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ শোষণ করার ক্ষমতা রাখে। স্থুলভাবে বললে, গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি পৃথিবীর কাছে চাদর বা কম্বলের ভূমিকা পালন করে। মহাবিশ্বের ঠান্ডার হাত থেকে তারা পৃথিবীকে ঢেকে রাখে। এই ঘটনার নাম গ্রিনহাউস এফেক্ট। প্রকৃতিতে বিদ্যমান CO2, CH4 ও জলীয় বাষ্পের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি যদিও আমাদের নীলগ্রহের জন্য একটি আশীর্বাদ, কারণ এদের প্রভাব ছাড়া পৃথিবীতে জল বা জীবন— কোনও কিছুরই অস্তিত্ব থাকত না।

পরিবেশে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির উপস্থিতি বড় বিষয় নয়, বায়ুমণ্ডলে তাদের মাত্রাতিরিক্ত ঘনত্বই চিন্তার মূল কারণ। শিল্প বিপ্লবের হাজার বছর পূর্বে এই গ্যাসগুলোর ঘনত্ব প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিত্য নতুন কলকারখানা বাড়তে থাকল, আর পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন, বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইড। ফলে ক্রমাগত তাপ বন্দি হতে থাকল বায়ুমণ্ডলে।

বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙছে ফি বছরই। প্রবীণ নাগরিকেরা স্বীকার করবেন যে এখন জলবায়ুর পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। যে পরিমাণ শক্তি পৃথিবীতে এসে পৌঁছচ্ছে, আর যে পরিমাণ শক্তি পৃথিবী থেকে নির্গত হচ্ছে, এই দুইয়ের পার্থক্য পরিমাপ করা হয় রেডিয়েটিভ ফোর্সিং বা ক্লাইমেট ফোর্সিং এর দ্বারা। ২০১৩ সালে জাতিসঙ্ঘের এক কমিটি বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাসের ক্ষেত্রে এর তুলনামূলক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ১৭৫০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে CO2-এর এই রেডিয়েটিভ ফোর্সিং সর্বোচ্চ, অর্থাৎ এই নীল গ্রহের উষ্ণতা বাড়ার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।

আরও পড়ুন:মেঘ পাতলা করা, সূর্যরশ্মি আটকে দেওয়ার নামে যে বিপুল ক্ষতি করছেন জিও-ইঞ্জিনিয়াররা

মিথেন বা অন্যান্য হাইড্রোফ্লুরো কার্বনগুলি কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকে বেশি ক্ষমতাশালী হলেও গ্লোবাল ওয়ার্মিং বৃদ্ধির ক্ষেত্রে CO2-এর জুড়ি মেলা ভার, কারণ বায়ুমণ্ডলে CO2-এর প্রাচুর্য মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেশি। এর জন্যে দায়ী আমাদের অনিয়িন্ত্রিত বিলাসব্যাসন। সম্প্রতি নাসার এক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, বিগত কয়েক বছরে পরিবেশে CO2-এর পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর থেকে CO2 বেশিদিন পরিবেশে মিশে থাকে। গ্রিন হাউজ গ্যাসগুলির মধ্যে একটি জলীয় বাষ্পও। আর তার পরিমাণই বাতাসে সর্বাধিক পরিমাণে থাকে, কিন্ত বাকি গ্যাসগুলির তুলনায় এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই কম, কারণ এরা অতি অল্প সময়েই (১০ দিন) পরিবেশে মিলিয়ে যায়। পরিবেশবিদদের থেকে পাওয়া একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, মিথেনের প্রভাব পরিবেশে মিলিয়ে যেতে অন্তত এক যুগ লাগে, নাইট্রাস অক্সাইডের প্রভাব মিলিয়ে যেতে যেতে এক শতক লাগে, সেখানে এক শতক পরেও পরিবেশে নির্গত CO2-এর শতকরা প্রায় ৪০ ভাগই বিদ্যমান থাকে। গবেষণায় এ-ও দেখা গিয়েছে, হাজার বছর পরে ও শতকরা ৪০ ভাগ অবশিষ্ট থাকে। এমনকী পুরোপুরি এর কুপ্রভাব মিলিয়ে যেতে নাকি লেগে যেতে পারে দশ হাজার বছর! ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নই বলুন আর দিন কে দিন খারাপ হতে থাকা দিল্লির পরিবেশ, সমস্ত কিছুর নেপথ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড নামক মস্ত ভিলেনের অবদান কিন্তু একেবারে উড়িয়েও দেওয়ার মতো নয় একেবারেই

More Articles