ব্যর্থ প্রেমই কি নির্মম করে তুলেছিল? হিটলারের প্রেমের এই আখ্যান এখনও রহস্যে মোড়া
Love Life of Hitler: আইজ্যাক পরিবারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে একজন জারজের সন্তান! ছোঃ! সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে স্টিফানির বাবা? সুতরাং, বন্ধ হল প্রেমপত্র বিনিময়। প্রথম প্রেমের সেখানেই ইতি।
১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। ঘড়ির কাঁটা বলছে সময়টা মধ্যরাত। বার্লিন শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু ঘুম নেই এক নবদম্পতির চোখে। দু’জনের প্রেম দীর্ঘ পনেরোটি বসন্ত পেরিয়ে এসে সেদিন পূর্ণতা লাভ করেছে। এই অনন্ত অপেক্ষার অবসানের দিনেও খুশির লেশমাত্র নেই তাঁদের চোখে-মুখে। যে ছেলেটি কিশোরবেলায় দানিউব নদীর তীরে বসে তার ক্যানভাসে ঝড় তুলত, যার তুলির মূর্চ্ছনায় প্রাণ পেত পড়ন্ত বিকেলের ভেনিস থেকে রূপবতী অষ্টাদশী কন্যার মুখ– সেই ছেলেটি আজ সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে গভীর উৎকণ্ঠায় নিঃশব্দ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। রাতের বয়স ক্রমশ বাড়ছে। একসময় খবর এল, রেড আর্মি বার্লিন শহরের দখল নিচ্ছে। অতঃপর, আত্মহত্যা!
এর বেশ কিছু বছর আগের কথা বলা যাক। পরিবর্তন ঘটছে সমাজ, অর্থনীতি এবং বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে। কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর বুকে শুরু হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। দানিউব নদীর ধারে যে ছেলেটির তুলি হাজারো সৃষ্টিশীলতার উৎস হয়ে উঠেছিল, বিশ্বযুদ্ধের আঁচ এসে লাগল তার গায়েও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক সাধারণ সৈন্য হিসেবে যোগ দিলেন অ্যাডলফ হিটলার। হিটলারের বাবা ছিলেন একজন জারজ সন্তান। ফলে অপমান আর উপেক্ষা দৈনন্দিন সঙ্গী ছিল হিটলারের। যে যুবক স্বপ্ন দেখত আকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে যোগ দেওয়ার, যে সৃষ্টিশীল কিশোরের তুলি হাজারও নতুনের সৃষ্টি করত, সেই বছর আঠারোর যুবক প্রত্যক্ষ করল চূড়ান্ত অমানবিকতা আর নৃশংসতা। তুলির বদলে অ্যাডলফ হিটলার হাতে তুলে নিলেন বন্দুক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতে সম্পূর্ণভাবে প্রলেপ পড়তে না পড়তেই বিশ্বের সমস্ত শান্তিকামী মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে পৃথিবীর বুকে হাজির হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাত ধরেই আবির্ভাব ঘটল বিশ্বত্রাস সৃষ্টিকারী এক নেতার। নাম তাঁর অ্যাডলফ হিটলার। কিছুদিনের মধ্যেই ইহুদিদের কাছে স্বৈরাচারের অপর নাম হয়ে উঠলেন হিটলার। তাঁর নেতৃত্বাধীন নাৎসি দল পঞ্চাশ লক্ষের বেশি ইহুদিকে হত্যা করেছিল– যা পৃথিবীর ইতিহাসে ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এই পর্যন্ত ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু দানিউব নদী তীরের সেই স্বপ্নময় কিশোরটির কী হল? ইতিহাসের পাতা উল্টে ফিরে কি যাওয়া যায় অমানবিক ও নৃশংস হিটলারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রেমিক হিটলারের কাছে?
মেয়েটির নাম ছিল স্টিফানি আইজ্যাক। ভেনিসের এক ধনী পরিবারের কন্যা। স্টিফানির বাবা ছিলেন ভেনিসের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। একদিন শেষ বিকেলের সূর্যকে সঙ্গী করে দানিউব নদীর তীরে তার নিত্যদিনের বৈকালিক ভ্রমণে ব্যস্ত স্টিফানি এবং তার বাবা। সেখানে তখন উপস্থিত এক অজ্ঞাতনামা চিত্রশিল্পী। শেষ বিকেলের নিভে আসা সূর্য আর পাখির কলতান সমগ্র প্রকৃতিতে এক অপরূপ মোহমায়া সৃষ্টি করেছে। স্টিফানির চোখ পড়ল রোগা দোহারা চেহারার সেই কিশোরের দিকে। ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুট । এক মনে চেয়ে আছে স্রোতস্বিনী দানিউবের দিকে। এই শিল্পী আসলে তাঁর বাবার কৃপাপ্রার্থী। নিজের ছবি নিয়ে একটা এগজিবিশন করতে চায় কিন্তু টাকা পয়সার অভাব। সেখানেই স্টিফানিকে প্রথম দেখেন হিটলার। স্টিফানি ছিলেন সেই সময় ভিয়েনার অন্যতম ডাকসাইটে সুন্দরী। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন পরবর্তীকালের বিশ্বযুদ্ধের অবিসংবাদিত এই খলনায়ক। কিন্তু পূর্ণতা পেয়েছিল কি হিটলারের এই প্রথম প্রেম?
আরও পড়ুন: মিথ্যে অপবাদের জেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল এই প্রতিভাবান কবিকে
না। অ্যাডলফ হিটলার শেষ পর্যন্ত জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাননি স্টিফানি আইজ্যাককে। কিছুদিনের মধ্যেই এই সম্পর্কের ব্যাপারে জেনে যায় স্টিফানির পরিবার। আইজ্যাক পরিবারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে একজন জারজের সন্তান! ছোঃ! সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে স্টিফানির বাবা? সুতরাং, বন্ধ হল প্রেমপত্র বিনিময়। প্রথম প্রেমের সেখানেই ইতি। যদিও অনেক পণ্ডিতের মতে, স্টিফানি আইজ্যাক কোনওদিনই ভালবাসেননি হিটলারকে। এই প্রেম ছিল একতরফা। কিন্তু প্রথম প্রেমকে কোনওদিনই ভুলতে পারেননি হিটলার। এমনকী, অনেক ইতিহাসবিদ হিটলারের ‘হলোকাস্ট’-এর নেপথ্যে প্রথম প্রেমের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত এই নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়।
এরপর আসা যাক ইভা ব্রাউনের প্রসঙ্গে। ইভা ব্রাউনের যখন সতেরো বছর বয়স, তখন তাঁর পরিচয় হয় হিটলারের সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই পরিচয় গড়ায় প্রেম পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন হিটলার। অন্যদিকে নাৎসি বাহিনী তখন পর্যদুস্ত, বার্লিনের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিয়ের পর একটা রাতও সম্পূর্ণ অতিক্রান্ত হয়নি। পনেরো বছর আগে ইভা যে মানুষটার শিল্পীমন আর স্বপ্নালু চোখদুটোর প্রেমে পড়েছিলেন– এই হিটলারের সঙ্গে সেই মানুষটার আসমান-জমিন ফারাক। সেদিনের সেই সপ্তদশী ইভা হিটলারকে দেখে যে সোনালী স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন, সেই স্বপ্নজাল তখন নিষ্ঠুর বাস্তবতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সেদিনের সেই তরুণ প্রেমিক চোখদুটো মৃত্যুভয়ে সাদা হয়ে আসছে ক্রমে। ইভা হিটলারের যে শিল্পীমনটাকে সযত্নে লালন করতে চেয়েছিলেন, বিশ্বজয়ের উদগ্র বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে হিটলার নিজেই সেই মনকে টুঁটি টিপে মেরে ফেলেছেন। বিশ্বজয়ের স্বপ্নও ব্যর্থ হয়েছে। একের পর এক পরাজয়, একের পর এক মৃত্যু– কিন্তু ইভা ছেড়ে যাননি হিটলারকে।
একসময় খবর এল, রেড আর্মি বার্লিনে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। হিটলার আর ইভা আগে থেকেই তাঁদের কর্তব্যে স্থির। আত্মহত্যা করলেন এই নবদম্পতি। বিয়ের পরে সাকুল্যে চব্বিশ ঘণ্টা সময়ও স্বামীর সঙ্গে কাটাতে পারেননি হতভাগ্য ইভা। হিটলারের রাজনৈতিক জীবনের ওঠাপড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমস্ত কিছু নিয়ে চর্চার মধ্যেই বারংবার আড়ালে চলে যায় হিটলারের হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রেম অথবা শুধু ভালবেসে মৃত্যুকে হাসিমুখে মেনে নেওয়া ইভা ব্রাউনের গল্প।