কিছুতেই করাতে চাননি অস্ত্রোপচার, শেষ অপারেশনই কাল হলো কবিগুরুর জীবনে

৭ আগস্ট, ২২শে শ্রাবণ। ভোরবেলা সাতটায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এসে উপাসনা করলেন। রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে বিধুশেখর শাস্ত্রী মন্ত্র পাঠ করলেন। বেলা ন'টার পর থেকেই নিশ্বাস ক্ষীণ হলো।

 

ছেলেবেলা থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যখন বয়স অল্প, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ নিয়মিত শরীরচর্চার কসরত শেখাতেন বাড়ির ছোটদের। সেই দলে ছিলেন বালক রবিও। পরে নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগান বাড়িতে থাকার সময় নিয়মিত গঙ্গা এপার-ওপার করতেন যুবক রবীন্দ্রনাথ। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা রবীন্দ্রনাথের কোনওদিনই রোগব্যাধির বিশেষ সমস্যা ছিল না।

১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ মংপুতে নিজের স্নেহধন্য মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছেন। ‘বিধাতার দেওয়া অক্ষত শরীরে’ সেই প্রথম অসুস্থতার আঘাত এল। সংজ্ঞা হারিয়ে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লেন কবি। প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশের চেষ্টায় চিকিৎসার জন্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসা হলো কলকাতায়। জোড়াসাঁকোয় ডাক্তার এবং রবীন্দ্রনাথের সেবিকাদের নিরলস চেষ্টায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। সেইবার অসুস্থতার মাঝেই এল ভাইফোঁটা। রবীন্দ্রনাথের দিদি বলতে তখন একমাত্র বর্ণকুমারী দেবীই জীবিত। তিনি এলেন আশি বছরের ভাই রবীন্দ্রনাথকে ফোঁটা দিতে। রবীন্দ্রনাথের অন্যতম স্নেহধন্য রানি চন্দ লিখছেন,


দিদি ভাইকে বকলেন, বললেন, দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো। বুঝলে? গুরুদেব আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কখনো আর ছুটে ছুটে যাব না, বসে বসে যাব এবার থেকে। সকলের খিলখিল হাসিতে ঘর ভরে উঠল।

এরপরে বর্ণকুমারী দেবী যতবারই রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন, ছুটে ছুটে যাবে না, কৌতুকপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ ততবারই বলেছেন, না, বসে বসে যাব।

আরও পড়ুন: ‘আজ সকালে সে মারা গেছে’, কাছের মানুষের মৃত্যুশোক সারাজীবন তাড়া করেছে রবীন্দ্রনাথকে

সেইবার সুস্থ হয়েই শান্তিনিকেতনে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের জেদ দেখে ডাক্তাররাও অনুমতি দিলেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে আর 'উদীচি'-তে থাকা হলো না রবীন্দ্রনাথের। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রনাথ রইলেন 'উদয়ন'-এ। বহুদিন পর উদয়ন-এর জাপানি ঘরে থাকতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের পরিবেশে, কাছের মানুষদের নিরন্তর সেবায় রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। জাপানি ঘরের জানলার ধারে বসেই সুর দিলেন ‘ওই মহামানব আসে’ গানটিতে। পাশাপাশি চলছিল কবিতা লেখাও। রানী চন্দ লিখছেন,


গুরুদেব একদিন একটি লম্বা কাগজে ‘নারী’ কবিতাটি লিখে আমায় দিলেন নীচে নাম সই করে। বললেন তোকে উপলক্ষ্য করে বিশ্বের নারীদের লিখলাম। রোগী তোদের কাছে দেবতার মত। যে নারী কর্তব্যকে নিজের মধ্যে নেয় তাঁর উপরই পরে বিশ্বের সেবার ভার। সেখানে নারীরা ইউনিভার্সাল।

‘গল্পসল্প’র কিছু লেখা ও এই সময় রবীন্দ্রনাথ মুখে বলে যেতেন। অনুলিখন করে রাখতেন রানী চন্দ।

মাঝখানে খানিক সুস্থ হয়ে উঠলেও ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের অসুখ। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি- কোনও চিকিৎসাতেই যন্ত্রণা কমছে না। ডাক্তারদের মতে, একমাত্র শেষ আশা অপারেশন। কিন্তু অপারেশনে রবীন্দ্রনাথের ঘোর আপত্তি। অপারেশনের কথা উঠতেই একদিন রানী চন্দকে বলছেন, "শনি যদি একটা কিছু ছিদ্র খোঁজে, সে যদি আমার মধ্যে রন্ধ্র পেয়েই থাকে তাকে স্বীকার করে নাও। মিথ্যে তার সঙ্গে জুঝে লাভ কি। মানুষকে তো মরতে হবেই একদিন। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?"

রবীন্দ্রনাথের আপত্তি সত্ত্বেও ঠিক হল শেষবার অপারেশনের চেষ্টা করে দেখা হবে। সেবার পয়লা বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'সভ্যতার সংকট'। উদয়নের লাল বারান্দায় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে 'সভ্যতার সংকট' পাঠ করলেন ক্ষিতিমোহন সেন। শেষ পর্যন্ত অপারেশনের জন্য ৯ই শ্রাবণ, ১৩৪৮ ইংরেজির ২৫শে জুলাই , ১৯৪১ সত্তর বছরের স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতন ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ শেষবারের জন্য এলেন কলকাতা। বাসের ভেতরে উঁচু আসনে স্ট্রেচারে করে রবীন্দ্রনাথকে এনে বসানো হলো। আশ্রমবাসী তাঁদের প্রিয় ‘গুরুদেবের’ আরোগ্য কামনায় গাইলেন ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো’। বাসের মধ্যে কোলের মধ্যে দু'হাত জড়ো করে নীরবে বসে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করলেন আশ্রম গুরু। চোখের জল লুকোনোর জন্য চোখে কালো চশমা।

২৫ তারিখ দুপুর বেলা ৩:১৫ নাগাদ রবীন্দ্রনাথ এসে পৌঁছলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। ক্লান্ত কবিকে রাখা হলো মহর্ষি ভবনের দোতলার পাথরের ঘরে। পরের দিন, ২৬ জুলাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এলেন ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে এলেন সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, অমিয় সেন। অবন ঠাকুরকে দেখে রবীন্দ্রনাথ জানালেন তাঁর বিশেষ ইচ্ছে অবনীন্দ্রনাথের ৭০ বছরের জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হোক। কুণ্ঠিত অবনীন্দ্রনাথ প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে রবিকা-র ধমক খেয়ে রাজি হলেন। সকালের দিকে ভালো থাকলেও রাতের দিকে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল রবীন্দ্রনাথের। ইনজেকশন দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করলেন ডাক্তাররা।

২৭ জুলাই সকালবেলা রানী চন্দকে মুখে মুখে বললেন ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতাটি। ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ লাইনগুলো লেখার পর রানী চন্দকে বলছেন, "প্রত্যেকবারই ভাবি ঝুলি খালি হয়ে গেল। এবারে চুপচাপ থাকি, পারি নে। এ পাগলামি নয়তো কি?" এরপরে আবার কবিতাটির বিভিন্ন জায়গায় নিজে হাতে কিছু কাটাকাটি করলেন। ক্লান্ত হয়ে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার পর শুনতে চাইলেন ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’ কবিতাটি। সেই মুহূর্তেই কেউই কবিতাটি গোটা শোনাতে পারেনি রবীন্দ্রনাথকে। শেষে বই এনে কবিতা পড়ে শোনানো হলো রবীন্দ্রনাথকে।

২৯ জুলাই সকাল থেকেই অপারেশন নিয়ে চিন্তিত রবীন্দ্রনাথ। রোজই ইঞ্জেকশন নিতে নিতে ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ ডাক্তার জ্যোতিপ্রকাশ সরকারকে জিজ্ঞেস করেই বসলেন, "বড় বড় খোঁচার ভূমিকা স্বরূপ এই ছোট ছোট খোঁচা আর কতদিন চালাবে?" ডাক্তার আশ্বস্ত করলেন আর বেশিদিন সহ্য করতে হবে না। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন রবীন্দ্রনাথ। ৩০ জুলাই অপারেশন হওয়ার কথা রবীন্দ্রনাথের। সকালবেলা লিখলেন, 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে’। লিখে নিয়েছিলেন রানী চন্দ। অপারেশনের সময় অসুস্থ থাকায় কলকাতায় আসতে পারেননি রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। তাঁর প্রিয় মামণির শরীরের অবস্থা জানতে চেয়ে চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠির শেষে কাঁপা কাঁপা হাতে সই করলেন ‘বাবামশায়’। এই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ হস্তাক্ষর।

এর খানিকক্ষণ পরেই অপারেশন শুরু হলো রবীন্দ্রনাথের। আধঘণ্টার অপারেশন। শেষ হওয়ার পর টানা ঘুমোলেন রবীন্দ্রনাথ। অপারেশনের সময়ে খুব লেগেছিল রবীন্দ্রনাথের। ডাক্তারি পরিভাষায় রবীন্দ্রনাথের অসুখের নাম ‘সুপ্রা পিউবিক সিস্টোনমি’। এরপরের দিনগুলো থেকে প্রায় কথা বন্ধ রবীন্দ্রনাথের। সারাদিনই আচ্ছন্ন ভাব। যখনই তন্দ্রা কাটছে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘ব্যাথা করছে, জ্বালা করছে’।

৫ আগস্ট অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে দেখতে এলেন বন্ধু ডাক্তার নীলরতন সরকার। পাশে বসে বাকি ডাক্তারদের থেকে শুনলেন রবীন্দ্রনাথের অবস্থা। রবীন্দ্রনাথের শীর্ণ হাতে হাত বুলিয়ে চুপ করে চলে গেলেন স্যর নীলরতন সরকার। ৫ আগস্ট রাত্রে স্যালাইন ও অক্সিজেন দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথকে। পরের দিন ৬ আগস্ট রাখি পূর্ণিমা। মাঝে মাঝে খুব হেঁচকি উঠছিল রবীন্দ্রনাথের। ময়ূরের পালক পুড়িয়ে অল্প খাওয়ানো হলো তাঁকে। রাখিপূর্ণিমার রাত। রবীন্দ্রনাথের শিয়র বরাবর রাখিপূর্ণিমার চাঁদ। ৬ আগস্ট রাত থেকেই রবীন্দ্রনাথের অবস্থা আরও খারাপের দিকে। পরের দিন ৭ আগস্ট, ২২শে শ্রাবণ। ভোরবেলা সাতটায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এসে উপাসনা করলেন। রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে বিধুশেখর শাস্ত্রী মন্ত্র পাঠ করলেন। বেলা ন'টার পর থেকেই নিশ্বাস ক্ষীণ হলো। ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮, বেলা ১২টা ১০ মিনিটে অস্তাচলে গেলেন বাংলার ‘রবি’।

More Articles