‘বুলবুল’, ‘হুদহুদ’, ‘ফণি’ পেরিয়ে এবার ‘ডানা’! কেন বারবার ঘূর্ণিঝড়ের হানা জগন্নাথধামে?

Frequent Cyclones in Odisha: বিগত পঁচিশ বছরে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় এসে ওড়িশায় তাণ্ডব দেখিয়েছে। ওড়িশা আর ঘূর্ণিঝড় কার্যত যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছে।

ডানা-আতঙ্কে কাঁপছে বাংলার পড়শি রাজ্য ওড়িশা। উৎসস্থল সেই বঙ্গোপসাগর। প্রথমে ঘূর্ণাবর্ত, তার পর নিম্নচাপ এবং ক্রমে তা শক্তি বাড়িয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। ওড়িশার দিকে ক্রমেই এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’। এই মুহূর্তে ওড়িশার পারাদ্বীপ উপকূল থেকে প্রায় ৫২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ থেকে ৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়া থেকে ৬১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে ‘ডানা’। আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকালের মধ্যে ওড়িশার ভিতরকণিকা ও ধামারার মধ্যবর্তী এলাকায় আছড়ে পড়তে পারে ঘূর্ণিঝড়টি। যার প্রভাব পড়বে ওড়িশার পাশাপাশি বাংলাতেও। বিগত পঁচিশ বছরে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় এসে ওড়িশায় তাণ্ডব দেখিয়েছে। ওড়িশা আর ঘূর্ণিঝড় কার্যত যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছে। আবারও একটি ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে বাংলার প্রতিবেশী রাজ্যের দিকে। ফলে আবারও ক্ষয়ক্ষতি আর প্রাণহানির আশঙ্কায় উদ্বেগ বাড়ছে ওড়িশার উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে।

গত দেড়শো বছরের ইতিহাস হিসেব করলে দেখা যায়, বারবার বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূল। প্রভাব পড়েছে, বঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকাতেও। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৯০ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৪০০টির বেশি ঘূর্ণাবর্ত হয়েছে ওড়িশা উপকূলে। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ে কখনও সুপার সাইক্লোন, কখনও ঘূর্ণিঝড়, কখনও বা প্রবল নিম্নচাপে প্রভাব পড়েছে উত্তর পূর্বের রাজ্য ওড়িশা ও বাংলায়। সাগরে ঘূর্ণাবর্ত, নিম্নচাপের প্রভাব পড়ে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতেও। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সবথেকে ভয়াল রূপও দেখেছে বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল। ২০০৪ সালে সুনামিতে এই রাজ্যগুলি তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু বারবার বঙ্গোসাগরে কেন তৈরি হয় নিম্নচাপ! কীসের প্রভাবে শক্তি বাড়িয়ে স্থলভাগে আছড়ে পড়ে এই ঘূর্ণিঝড়গুলি!

আরও পড়ুন: আয়লা, আমফান, ফণির পর ডানা! গত দু’দশকে কেন একের পর এক ঘূর্ণিঝড় বাংলায়?

সুপার সাইক্লোন- ১৯৯৯ 

১৯৯৯ সালে ওড়িশার বুকে আছড়ে পড়েছিল ‘সুপার সাইক্লোন’। ওড়িশার জগৎসিংহপুর জেলার পারাদ্বীপে আছড়ে পড়েছিল ১৯৯৯ সালের ২৯ অক্টোবর। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অকল্পনীয়। তবে অত ক্ষতির একমাত্র কারণ ছিল ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ। ২৬৭ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে সেই ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল ওড়িশায়। সমুদ্রের অদূরে হওয়ায় পদমপুর গ্রাম তছনছ হয়ে গিয়েছিল এই ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাতে। বহু প্রাণহানি হয়েছিল এই গ্রামে। সমুদ্রে ভেসে যান বহু গ্রামবাসী। শুধু জগৎসিংহপুরে ‘সুপার সাইক্লোন’-এর প্রভাবে মৃত্যু হয়েছিল ৮,১১৯ জনের। তার পরেই তালিকায় শীর্ষে ছিল কটক (৪৭১) এবং কেন্দ্রাপাড়া (৪৬৯)।

ফাইলিন- ২০১৩

১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের পর থেকে ওড়িশা এ পর্যন্ত ১২টি ঘূর্ণিঝড় দেখেছে। ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘ফাইলিন’ আঘাত হানে ওড়িশায়। সেই ঝড়ে ঘরবাড়ি, চাষবাস, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। বিশেষ করে গঞ্জাম, পুরী এবং খুর্দা জেলায় ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল ‘ফাইলিন’। গঞ্জাম জেলার গোপালপুরের কাছে ২৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে আছড়ে পড়েছিল সেই ঘূর্ণিঝ়ড়।

হুদহুদ- ২০১৪

এরপর ২০১৪ সালে ওড়িশায় তাণ্ডব চালিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ‘হুদহুদ’। সে বছরের ১২ অক্টোবর বিশাখাপত্তনমের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়টি। ওড়িশার গজপতি, কোরাপুট, নবরংপুর এবং মালকানগিরিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল হুদহুদের প্রকোপে। সেই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার।

দায়ে- ২০১৮

২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ওড়িশায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘দায়ে’। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ওড়িশার গোপালপুরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে মালকানগিরি জেলায়ও। ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার সময় এর বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।

তিতলি- ২০১৮

২০১৮ সালের অক্টোবরে অন্ধ্রপ্রদেশের পালাসায় আছড়ে পড়েছিস ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’। যার প্রভাব পড়েছিল ওড়িশার গোপালপুরে। গঞ্জাম ও গজপতি জেলাতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১১০ কিলোমিটার।

ফণী- ২০১৯

২০১৯ সালের ৩ মে ওড়িশার পুরীর কাছে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণীর। ২০৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে আছড়ে পড়েছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। সেই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

বুলবুল- ২০১৯

তারপর ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরদ্বীপে আছড়়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। যার প্রভাবে ওড়িশার বালেশ্বর জগৎসিংহপুর, কেন্দ্রাপাড়া এবং ভদ্রকের বিভিন্ন অংশে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ১৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড়টি।

আমফান- ২০২০

পরের বছর ফের। ২০২০ সালের ২০ মে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা এবং হাতিয়ার মধ্যে আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’। এর প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে তো পড়েইছিল। পাশাপাশি ওড়িশার বালেশ্বর, ভদ্রক, জগৎসিংহপুর এবং কেন্দ্রাপাড়ার মতো উপকূলীয় জেলাগুলিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। হাজার হাজার গাছ উপড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়়ার সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার।

ইয়াস- ২০২১

২০২১ সালের ২৬ মে ওড়িশার ভিতরকণিকা জাতীয় উদ্যানের কাছে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। ১৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে তাণ্ডব চালায় এই ঘূর্ণিঝড়। ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক।

 

গুলাব- ২০২১

ওই বছরই ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতিবেশী অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলায় আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’। যার প্রভাবে মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হল ওড়িশা। সেই ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়ার সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রায় ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।

অশনি- ২০২২

২০২২ সালে মে মাসে গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম এবং নরসাপুরমের মাঝে আছড়ে পড়েছিল ‘অশনি’। এর প্রভাবও পড়েছিল ওডিশাতে। ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ ছিল ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।

এবার সাম্প্রতিক আতঙ্কের নাম 'ডানা'। যার প্রভাবে ইতিমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে ওড়িশা ও বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। কিন্তু কেন বারবার ঘূর্ণিঝড়েদের নিশানায় ওড়িশা? কেন বারবার জগন্নাথ ধাম ঘেঁষেই আছড়ে পড়ে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়?

আবহাওয়া ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগর উপকূল বিশ্বের অন্যতম ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। আবহাওয়াবিদদের পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বঙ্গোপসাগর উপকূলে ২৯৩টি নিম্নচাপ হয়েছে। উপকূলে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৭টি সাইক্লোন হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়গুলিতে উপকূলবর্তী এলাকার অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব পড়ে। কিন্তু কেন বারবার বঙ্গোপসাগরেই এই ঘূর্ণিঝড় হয়! ভুবনেশ্বর আইআইটি-র অধ্যাপক সন্দীপ পট্টনায়েক জানিয়েছেন, উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন হওয়ায় বারবার বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয় ঘূর্ণাবর্ত। কখনও তা শক্তি হারিয়ে নিম্নচাপ তৈরি হয়। কখনও আবার শক্তি বাড়িয়ে তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে ধ্বংসলীলা চালায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হওয়া মধ্য-অক্ষাংশের ঘূর্ণাবর্ত বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তা শক্তি বাড়িয়ে ফেলে। তার ফলেই এই উপকূলবর্তী এলাকায় বঙ্গোপসাগরে ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়।

তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। অধ্যাপক সন্দীপ পট্টনায়েক জানিয়েছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধিও ঘূর্ণিঝড় তৈরির একটা বড় কারণ। বছরে এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্তপ্ত থাকে। পূর্ব উপকূলে তাই সবথেকে বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। গবেষণা বলছে, ১৮৯০ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে এই বঙ্গোপসাগর উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের হার ছিল ৭ শতাংশের কাছাকাছি। ১৯৩০-১৯৬৯ সালে তা কমে হয় ৫ শতাংশ। ২০১০-২০২০ সালে পূর্ব উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের হার বেড়ে হয়েছে ২০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ওড়িশা উপকূলে বারবার ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা কমতে পারে। কিন্তু ওড়িশা সংলগ্ন উপকূল সীমান্তে ঘূর্ণাবর্তের প্রবণতা বাড়ছে।

আরও পড়ুন: শক্তি বাড়িয়ে আরও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’! ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় কাঁপছে বাংলা-ওড়িশা

শুধু বঙ্গোপসাগর নয়, আরব সাগরেও ঘূর্ণাবর্ত ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রির বেশি থাকতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা আগের তুলনায় এখন বেশি থাকছে। তাতে যে নিম্নচাপগুলো সাইক্লোনে পরিণত হচ্ছে, সেগুলির তীব্রতা বা ক্ষতি করার ক্ষমতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। উপকূলীয় এলাকার বয়স্ক মানুষদের কাছে এই ঘূর্ণিঝড় কিন্তু স্বাভাবিক। ৩০-৪০ বছর আগেও এই ঘূর্ণিঝড় স্বাভাবিকভাবেই হতো, তবে তার তীব্রতা কম ছিল।" ১৯৭৬ সালেও আরব সাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। তবে তার তীব্রতা বেশি ছিল না। সেক্ষেত্রে আরব সাগরেও বা কেন নতুন করে ঘূর্ণাবর্ত  তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করছেন বিজ্ঞানীরা।

তবে এর নেপথ্যে এল নিনোর পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যাকেও বিঁধছেন বিজ্ঞানীমহল। যেভাবে গত কয়েক বছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পৃথিবীর গরম, তা এই ঘূর্ণিঝড় তৈরির নেপথ্যে অন্যতম কারণ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞমহল। এখন থেকে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতন না হলেও, আগামী বছরগুলিতে এই সমস্যা আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।

More Articles