কেন পুরুষের চেয়ে বেশি অঙ্গদান করেন মহিলারা? চমকে দেবে এই তথ্য
Women Organ Donors: বেশিরভাগ মহিলাই বাইরের কাজ যেহেতু করেন না, আর যেহেতু পুরুষদেরই চাকরি, ব্যবসা, বাইরের কাজ সামলাতে হয় তাই পুরুষরা অঙ্গদান করতে চান না।
চক্ষুদান, দেহদান এবং অঙ্গদানকে এখনও 'সাহসী' সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখা হয়। বলা হয় 'এগিয়ে থাকা ভাবনা'। আসলে যে কাজে সকলে সমানভাবে এগিয়ে আসেন না, যে কাজে আজও মানুষের উদাসীনতাই প্রধান, সেই কাজ কেউ করলে বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে বৈ কী! তবে আশার কথা, অঙ্গদান বাড়ছে, বিশ্বজুড়েই, ভারতেও। আর একটি চমক দেওয়ার মতো তথ্য হচ্ছে, অঙ্গদানে পিছিয়ে আছেন পুরুষরা, ঢের এগিয়ে মহিলারা। অর্থাৎ অনেক বেশি সংখ্যক মহিলা অঙ্গদান করছেন। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু কেন করছেন? কেন মহিলাদের অঙ্গদাতার সংখ্যা বাড়ছে? কারণটা চমকে দেওয়ার মতো।
বেঙ্গালুরুর একজন স্টার্ট-আপ কর্মী সীমা (নাম পরিবর্তিত)। বয়স চল্লিশের আশেপাশে। অঙ্গদান করেছেন শ্বশুরকে। বলছেন, "আর কোনও উপায়ও ছিল না।" শ্বশুরের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়তেই পুরো পরিবারের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন তিনি। সীমার শাশুড়ি বয়স এবং ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি দান করতে পারেননি। সীমার স্বামী জার্মানিতে কাজে গিয়েছিলেন। কয়েক মাস আগেই সন্তান জন্মেছে সীমার। অথচ সকলে তাঁরই উপর নির্ভর করেছিলেন কিডনি দানের জন্য। ওই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সীমা ভেবেছিলেন, কিডনি দিতে রাজি না হলে বাকিরা খুবই অসন্তুষ্ট হবেন! তাই সীমার কাছে "কোনও উপায়ও ছিল না"।
নভি মুম্বইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালের রোগী কিষাণ বলছেন, তিনি তাঁর ৪৪ বছর বয়সি স্ত্রী রশ্মির কাছে 'ঋণী' কারণ কিষাণ গত ছয় বছর ধরে লিভারের রোগে ভুগছেন এবং রশ্মি স্বেচ্ছায় স্বামীর জন্য নিজের লিভারের একটি অংশ দান করতে ইচ্ছুক। রশ্মি এবং কিষাণের মধ্যবিত্ত পরিবার চলে মুদির দোকান চালিয়ে। বাবা-মা আর স্ত্রীকে নিয়েই কিষাণের সংসার। ভাই নেই, বোন একজন ছিল ঠিকই কিন্তু সে বিবাহিত। ফলে 'অন্যের'। ফলে বোনকে তো বলা যায় না আর লিভার দিতে। রশ্মির সন্তানরাও ছোট তখন। ফলে রশ্মিই অঙ্গদান করতে রাজি হন।
আরও পড়ুন- লিঙ্গবৈষম্যের মুখে সপাট জবাব! দেশ ভুলেছে প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক হোমাই ভ্যারাওয়ালাকে
অঙ্গদানের ক্ষেত্রে মা, স্ত্রী, মেয়ে এবং পুত্রবধূরাই এগিয়ে আসছেন। ভারতে অঙ্গদান বিষয়ক কোন কেন্দ্রীভূত তথ্য এখনও নেই। তবে দেশের তিনটি ভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তাররাই জানাচ্ছেন, নারীরা তাঁদের পুরুষ আত্মীয়দের জন্য অঙ্গদান করছেন বেশি। পুরুষরা গ্রহীতা, মহিলারা দাতা এক্ষেত্রে। আর বছরের পর বছর ধরে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
স্ক্রোল ডট ইন-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ওসমানিয়া জেনারেল হাসপাতাল (হায়দরাবাদ), মণিপাল হাসপাতাল (কর্নাটক) এবং অ্যাপোলো হাসপাতালের (নভি মুম্বই) নেফ্রোলজিস্টরা বলছেন, প্রায় “৭০%-৮০% অঙ্গদাতাই মহিলা এবং ৭০% অঙ্গপ্রাপক হচ্ছেন পুরুষ।"
২০১৮ সালে লেখিকা সোহিনী চট্টোপাধ্যায় একটি আরটিআই করেছিলেন। সেই আরটিআইটিই এখনও পর্যন্ত অঙ্গদানের একমাত্র উপলব্ধ তথ্য। ওই আরটিআই অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, তিনটি কেন্দ্রে কিডনি দাতাদের মধ্যে ৭৪% ছিলেন মহিলা। পাঁচটি কেন্দ্রে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য অঙ্গদাতা মহিলাদের সংখ্যা ৬০.৫%। ন্যাশনাল অর্গান অ্যান্ড টিস্যু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজেশনের তথ্য বলছে, ভারতে ১৯৯৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচজন অঙ্গদাতার মধ্যে চারজনই মহিলা এবং পাঁচজন অঙ্গগ্রহীতার মধ্যে চারজনই পুরুষ।
সেই যে সীমা বলেছিলেন, "কোনও উপায়ও ছিল না", এই বক্তব্যের পিছনে কাজ করছে এক অযৌক্তিক অপরাধবোধ। যে কারণেই হয়তো অঙ্গদানে মহিলাদের ভূমিকা বেশি। চেন্নাইয়ের বছর ৩৫ বয়সের শিক্ষিকা লীলার (নাম পরিবর্তিত) ছেলের ৯ বছর বয়সে রেনাল ফেইলিওর ধরা পড়ে। জানতে পেরেই এক অদ্ভুত 'অপরাধবোধ' হয় তাঁর। লীলা মনে করতে থাকেন, কেন তিনি ছেলেকে আরও বেশি জল খেতে বলেননি, কেন ছেলের আরেকটু যত্ন নেননি। তাহলে এখন প্রায়শ্চিত্ত করবেন কীভাবে? নিজের অঙ্গ ছেলেকে দান করাই একমাত্র পথ। আসলে 'কুমাতা' হওয়ার সামাজিক চাপে মহিলাদের মধ্যে চাগাড় দেয় এই 'অপরাধবোধ'। মা হওয়ার মধ্যে যে ত্যাগ, সর্বংসহা সত্তাকে সমাজ গেঁথে দেয়, তার সামান্য এদিক ওদিক হলেই আঙুল ওঠে মহিলার দিকে, মায়ের দিকে। তাই ভয় স্বাভাবিক! বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, মায়েরা, বিশেষ করে যাদের ছোট বাচ্চা আছে, তারা প্রায়ই বিশ্বাস করেন যে তাদের সন্তানের শরীর অসুস্থ হয়েছে মানে নিশ্চয়ই তাঁরা যত্ন নিতে কিছু ভুল করেছেন। মায়েরা মনে করেন, আরেকটু খেয়াল রাখলে রোগের লক্ষণ ধরা পড়ত আগে বা আরও ভালো যত্ন করা দরকার ছিল। চিকিৎসকরা বলছেন, সন্তানকে অঙ্গদান করতে চান কিনা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেনও না মায়েরা।
লীলার মতোই সন্তানের যত্নে গাফিলতির 'অপরাধে' ভুগছিলেন বসুন্ধরা রাঘবন (নাম পরিবর্তিত)। তিনি বলছেন, ছেলে শৈশবে হামেশাই বিছানা ভিজয়ে ফেলত। হয়তো তখন আরেকটু উদ্যোগী হয়ে কারও কারও সঙ্গে কথা বললেই সমস্যা ধরা পড়ত। তাহলে হয়তো কিডনি প্রতিস্থাপনের দরকারই পড়ত না। বসুন্ধরা স্বীকার করেছেন, "হ্যাঁ, মায়েরা সবসময়ই বেশি অপরাধবোধে ভোগেন।"
কিন্তু বসুন্ধরার অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না। তখন ১৯৯৬ সাল। মুম্বইতে তাঁর ১৫ বছরের ছেলে বারবার মাথাব্যথা করছে বলে অভিযোগ করছিল। মা ভেবেছিলেন এসব স্কুল না যাওয়ার ছল। এরপরেই ছেলের রেনাল ফেইলিওর ধরা পড়ে। পরীক্ষা করে দেখা যায়, বসুন্ধরা কিডনি দান করতে পারবেন কোনও সমস্যা নেই। অঙ্গদানের অনুমতি দেওয়ার মাত্র দু'দিন পরই ধরা পড়ে, বসুন্ধরা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। বসুন্ধরার বড় ছেলে এই অবস্থায় অঙ্গদান করতে অনেক বাধা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মায়ের বদলে তিনি ভাইকে কিডনি দেবেন। বসুন্ধরা রাজি হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের মধ্যে অন্তত একজন পড়াশোনা শেষ করে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ুক। ১৯৯৮ সালে, বসুন্ধরা তাঁর ছেলেকে নিজের একটি কিডনি দান করেছিলেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, মায়েদের তাঁদের সন্তানদের অঙ্গদান করার সম্ভাবনা বেশি হওয়ার একটি বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। নভি মুম্বইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালের পরামর্শদাতা এবং মাল্টি-অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট লিড প্রফেসর ড্যারিয়াস মির্জার ব্যাখ্যা, অঙ্গের আকার, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা এক্ষেত্রে বিচার্য। সাধারণত, মহিলাদের উচ্চতা কম, আকারে ছোটখাট। যার ফলে বাবার অঙ্গের আকারের চেয়ে সন্তানকে দান করার জন্য মায়ের অঙ্গের আকারে ও ওজনে ভালো মিল দেখা যায়। তবে, সন্তানের ওজন যদি প্রায় ২৫-৩০ কেজি হয়, তবে মায়ের অঙ্গেরও উপযুক্ত মিল হতে পারে না।
তবে এর চেয়েও মারাত্মক একটি সামাজিক বিষয় রয়েছে মহিলাদের অঙ্গদাতা হওয়ার ক্ষেত্রে। ভারতে এখনও অধিকাংশ মহিলাই চাকরি বা উপার্জন করেন না। ঘরে বাইরেও তেমন বেরোন না। হায়দরাবাদের ওসমানিয়া জেনারেল হাসপাতালের নেফ্রোলজির প্রধান ডাঃ মনীষা সহায় বলছেন, বেশিরভাগ মহিলাই বাইরের কাজ যেহেতু করেন না, আর যেহেতু পুরুষদেরই চাকরি, ব্যবসা, বাইরের কাজ সামলাতে হয় তাই পুরুষরা অঙ্গদান করতে চান না। মহিলারাই এগিয়ে আসেন যাতে তিনি 'অকেজো' হয়ে গেলেও বাড়িতে কোনও প্রভাব না পড়ে। পুরুষের উপার্জন যাতে না কমে। এই পিতৃতন্ত্র মহিলাদের অঙ্গদানের মাধ্যমে ত্যাগের গরিমা পাইয়ে দেয় ঠিকই, তাতে মর্যাদা বাড়ে না মেয়েদের।
আরও পড়ুন- অ্যানিমেল : বন্দুক ও পুরুষাঙ্গের জান্তব আস্ফালন
পুনের ৩৮ বছর বয়সি শ্রেয়া পাওয়ার (নাম পরিবর্তিত) একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে নিজের বছর ৪৫-এর স্বামীকে একটি কিডনি দান করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বলেছিলেন, "পরিবারের জন্য এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।" শ্রেয়াও সীমার মতোই বলেছেন, কোনও বিকল্প ছিল না আর। দুই দেওরের কেউ অঙ্গ দিতে চাননি। শ্রেয়া কিডনি না দিলে স্বামী সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে পারতেন না। স্বামী তো কাজে ফিরলেন কিন্তু শ্রেয়াকে চাকরি ছাড়তে হলো কারণ এই অপারেশন পরবর্তী বিশ্রামের ছুটি এবং স্বামীর যত্ন নেওয়ার জন্য চাকরিটি গেল শ্রেয়ার। যদিও শ্রেয়া মনে করেন, ভালোই হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে তাঁদের পরিবারের জন্য এই সিদ্ধান্ত ঠিকই ছিল কারণ, স্বামী সুস্থ হয়ে আরও বেশি অর্থ উপার্জন করবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্থিক নির্ভরতা একটি বড় কারণ, যে কারণে সন্তানের বাবারা অঙ্গদান করতে চান না। অঙ্গদান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য, পুরুষদের নানা পরীক্ষাও করতে হয়, অঙ্গদানের পর সেরে ওঠার জন্য সময়ও লাগবে। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা বলেন, অঙ্গদাতাকে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। সম্পূর্ণ সারতে কমপক্ষে ছয় থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। তবে বেশিরভাগ মানুষই অস্ত্রোপচারের তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে আবার কাজ শুরু করতে পারেন। পুরুষের তো রয়েছে বিশ্বলোক, কর্মভার। ঘরের মহিলা আপাত 'বেকার'। ফলে ঘরে 'বসে' থাকার সময় মেয়েদের আছে। ছেলেদের উপার্জন করতে হবে। তাই অঙ্গ দেওয়ার মতো 'গরিমা' পুরুষদের দরকার নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি অঙ্গ প্রতিস্থাপন ঘটে। সেখানে মহিলা কিডনি দাতাদের হার ৬২% এবং মহিলা লিভার দাতাদের হার ৫৩%। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন জানাচ্ছে, ভারত এই ধরনের ট্রান্সপ্লান্ট হাব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পরেই রয়েছে। ভারতীয় মহিলাদের বর্তমান কর্মসংস্থানের হার ২৩.৯৭%। চাকরি এখনও মেয়েদের জন্য 'আবশ্যিক' নয়। প্রতি ১০ মিনিটে, অঙ্গ প্রতিস্থাপন দরকার এমন তালিকায় অন্তত একজন করে ব্যক্তি যুক্ত হচ্ছেন। ৩ লাখেরও বেশি মানুষ ইতিমধ্যেই অপেক্ষমান তালিকায়। সেই অপেক্ষার তালিকায় থাকা অবস্থাতেই প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ জন মানুষ মারা যান, অঙ্গ না পেয়ে।
মহিলারা না হয় অঙ্গ দিলেন। এবার কোনও মহিলার যদি কিডনির প্রয়োজন হয়? মহিলারা এত গুরুত্বই পান না পরিবারে, আজও। মেয়ের বা স্ত্রীয়ের বা কোনও মহিলার অঙ্গদানের জন্য পরিবার মরিয়া হয়ে উঠছে এমন নজির হাতেগোনা। ১৯৯৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে (যেকোনও) অঙ্গ প্রতিস্থাপন হওয়া মোট ৩৬,৬৪০ জন রোগীর মধ্যে ২৯,৬৯৫ জনই ছিলেন পুরুষ, বলছে ন্যাশনাল অর্গ্যান অ্যান্ড টিস্যু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজেশনের তথ্য। সুতরাং, কোনও অঙ্গদাতা না থাকলে, মানে অন্তত এই দেশের ক্ষেত্রে 'ত্যাগ' করার মতো পুরুষ বা অন্য মহিলা না থাকলে মেয়েদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন হওয়া কঠিনই। রোগ, অঙ্গদান, দেহদানের মতো ইস্যুতেও কী অদ্ভুতভাবে জাঁকিয়ে বসে আছে পিতৃতন্ত্র! এই রোগের কোনও প্রতিস্থাপন নেই।