হেমন্তের প্রত্যাবর্তন! বিজেপির মুখে ছাই উড়িয়ে কীভাবে জিতে গেলেন হেমন্ত সোরেন?

Jharkhand Election Result 2024: মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছেন, সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ইস্যু দিয়ে তপশিলি উপজাতি ভোটারদের মতামতকে বদলানো যাবে না।

'ঘুসপেটিয়া' ইস্যু দিয়েই আদিবাসীদের মনে ঘৃণা উস্কে, বিরোধ উস্কে জঙ্গলরাজ্য ঝাড়খণ্ড দখল করতে চেয়েছিল বিজেপি। ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হতেই দেখা গেল, আদিবাসীদের মন বা ভোট কিছুই পায়নি গেরুয়া দল। মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে, সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ইস্যু দিয়ে তপশিলি উপজাতি ভোটারদের মতামতকে বদলানো যাবে না। রাজ্যের ২৮টি তপশিলি উপজাতি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ ২৭টিতে হেরেছে। ৮১ আসনের ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় জেএমএম, কংগ্রেস, আরজেডি, সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর জোট পেয়েছে ৫৬টি আসন। আর বিজেপি, আজসু, জেডিইউ আর এলজেপি(আর)-এর জোট পেয়েছে ২৪টি আসন।

হেমন্ত সোরেনের জেল, জেল থেকে ফিরে আসা এবং টানা দ্বিতীয় বারের মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী হতে চলাও ভারতের রাজনীতিতে এক উদাহরণ হয়ে থেকে যাবে। এর আগে ঝাড়খণ্ডের কোনও মুখ্যমন্ত্রীই ভোটে জিতে পরপর দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হননি। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। যে অনুপ্রবেশকে বিজেপি হাতিয়ার করেছিল নির্বাচনে, তাও নাকি হেমন্তের প্রশ্রয়েই বেড়েছে বলেইছিল অভিযোগ। এই বছরই ৩১ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডে জমি দুর্নীতি সংক্রান্ত বেআইনি আর্থিক লেনদেনের মামলায় শিবু সোরেনের পুত্র হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতার করেছিল ইডি। পাঁচ মাস কাটিয়েছেন জেলে। তাঁর অনুপস্থিতিতে চম্পাই সোরেনকে মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করে জেএমএম নেতৃত্ব। পাঁচ মাস পরে ঝাড়খণ্ড হাই কোর্টের নির্দেশে মুক্তি পেয়েই আবার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন হেমন্ত। এই সুযোগে চম্পাই সোরেনকে দলে টেনে নিয়ে প্রার্থী করে দেয় বিজেপি। অনেকেই ভেবেছিলেন ঝাড়খণ্ড এবার হেমন্তের হাতছাড়া হবেই। অথচ তিনি ফিরলেন, বিপুলভাবে ফিরলেন।

হেমন্ত সোরেনকে জেলে পাঠানোর ঘটনায় বিজেপির উপর আদিবাসীদের ক্ষোভ বেড়েছিল। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, লোকসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পোরা আসলে রাজনৈতিক চক্রান্ত। চম্পাইকে দলে নেওয়াতে 'বিশ্বাসঘাতকতা'-র তত্ত্বও প্রমাণ হয়ে যায় মানুষের কাছে। তারা আবারও জিতিয়ে দেন হেমন্তকে।

আরও পড়ুন- পরিবারেই লুকিয়ে বিপদ! হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনার মুখ্যমন্ত্রিত্বের পথের কাঁটা কে?

সাঁওতাল পরগনা, কোলহান, দক্ষিণ ছোটনাগপুর এবং পালামু অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ২৮টি আসনে বিজেপি নিজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। একমাত্র সেরাইকেল্লাতে জিতেছে বিজেপি, যেখানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চম্পাই সোরেন জিতেছেন। কিছুকাল আগেই ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ত্যাগ করে বিজেপিতে গেছিলেন তিনি। ২০,০০০-এরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালে বিজেপি তপশিলি উপজাতি আসন খুন্তি এবং তোরপা আসনে জিতেছিল। এবার জেএমএম জিতেছে সেই দুই আসনেও।

রাজ্যের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত, সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলের অনেকগুলি আসনই পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে পড়ে। ইন্ডিয়া জোট এই অঞ্চলে প্রায় ৫২% ভোট পেয়েছে। এই নির্বাচনে সমস্ত অঞ্চল জুড়ে ইন্ডিয়ার ভোট ২০১৯-এর তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে৷ বিজেপি রাজমহল, সরথ এবং গোড্ডার মতো সাধারণ আসনেও এবার হেরেছে।

রাজমহলে ২০০৯ সাল থেকে বিজেপির ক্ষমতাসীন অনন্ত কুমার ওঝাই জয়ী হয়ে আসছেন। সেই আসনে এবার জেএমএমের মহম্মদ তাজউদ্দিন ৪৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। সরথ আসনেও জেএমএমের কাছে এবং গোড্ডায় রাষ্ট্রীয় জনতা দলের কাছে হেরে গিয়েছে বিজেপি। তপশিলি উপজাতি সংরক্ষিত আসন দেওঘরেও বিজেপিকে হারিয়েছে আরজেডি। এই আসনে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে জিতেছিল বিজেপি। সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে, জেএমএম-কংগ্রেস-আরজেডি জোট ১৮ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৭টি জিতেছে। অন্যদিকে জারমুন্ডি আসন জিতেছে বিজেপি। এই আসনে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে কংগ্রেস বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছিল।

সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ' নিয়ে ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনে বিজেপি ব্যাপক প্রচার চালায়। বিজেপি প্রচার করে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরাই আদিবাসী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের আদি বাসিন্দাদের জন্য সঙ্কট তৈরি করবে। কারণ এই 'বাংলদেশি অনুপ্রবেশকারী'-রা নাকি শুধু এই অঞ্চলের 'জনসংখ্যাগত পরিবর্তন'-ই করছে না, উপজাতি মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ, ভূমিদখল এবং আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ক্ষয় ঘটাচ্ছে। "আদিবাসীদের রোটি, বেটি, মাটি রক্ষা", "এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়"-এর মতো স্লোগান দিয়েই ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে মুসলিম এবং আদিবাসীদের সম্পর্ক ভাঙার কাজ করছিল বিজেপি।

জেএমএম এই অনুপ্রবেশ ইস্যুটিকে তিনটি খাতে প্রতিহত করেছে। প্রথমত, অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার জন্য বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করেছে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। দ্বিতীয়ত, বিজেপি তারকা প্রচারকদের 'বহিরাগত' বলে চিহ্নিত করেছিল জেএমএম যারা তাদের নিজেদের রাজ্যেই আদিবাসীদের উপর অত্যাচার প্রতিরোধ করতে পারেনি। তৃতীয়ত, বিজেপি সাংসদদের ঝাড়খণ্ড থেকে আলাদা করে সাঁওতাল পরগনা তৈরির পরামর্শটিকে সামনে এনে জেএমএম প্রমাণ করেছে যে বিজেপিই আসলে এই রাজ্যকে ভাঙতে চেয়েছে।

বিজেপির 'অনুপ্রবেশ' ইস্যুতে দেওয়া বিজ্ঞাপনে সোশ্যাল মিডিয়া উপচে গিয়েছিল। সংঘ পরিবারের অধীনে বনবাসী কল্যাণ আশ্রমগুলিও এনআরসি-র প্রচার করেছিল। জেএমএমের প্রচারে উঠে এসেছিল জনগণের কথা, অভাব-অভিযোগের কথা। জেলা পর্যায়ে স্থানীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছিল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা।

চম্পাই সোরেন এবং লোবিন হেমব্রমের মতো নেতারা প্রকাশ্যে বলেছিলেন তাদের বিজেপিতে যাওয়ার প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে, সাঁওতাল পরগনায় অনুপ্রবেশ যা আদতে আদিবাসীদের জীবনযাপনের কাছে হুমকি হয়ে উঠছে। লোবিন হেমব্রম বোরিও আসনে জেএমএম-এর ধনঞ্জয় সোরেনের কাছে ১৯,০০০ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। তবে চম্পাই সোরেনের বিজেপিতে চলে যাওয়ার প্রভাব ভোটে তেমন পড়েনি।

আরও পড়ুন-এক হ্যায় তো সেফ হ্যায় মন্ত্রেই ম্যাজিক? কীভাবে মহারাষ্ট্র দখল করল বিজেপি?

সাঁওতাল পরগনার জামতারা অঞ্চলে, কংগ্রেসের ইরফান আনসারি এবং জেএমএম প্রতিষ্ঠাতা শিবু সোরেনের পুত্রবধূ সীতা মুর্মু সোরেন, যিনি বিজেপির টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভোটে লড়ছিলেন, তাঁদের মধ্যে লড়াইয়ে বিজেপি এই 'অনুপ্রবেশ' ইস্যুকেই সামনে রাখে। এই আসনেও সীতাআ মুর্মু সোরেন ৪৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান।

কোলহান অঞ্চলে, বিজেপি জামশেদপুর পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রে ২০১৯ সালে নির্দল প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়েছিল। সেই আসন বিজেপি ফিরে পেয়েছে। ঘাটশিলায়, চম্পাই সোরেনের ছেলে বাবুলাল সোরেন, জেএমএমের কাছে ২২,০০০ ভোটে হেরেছেন এবং পটকা আসনে, যেখানে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডার স্ত্রী মীরা মুন্ডা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, সেখানেও জেএমএমের সঞ্জীব সর্দার জয়ী হয়েছেন, প্রায় ২৮,০০০ ভোটের ব্যবধানে।

জনতা দল (ইউনাইটেড) সেরাইকেল্লা এবং জামশেদপুর পূর্ব ছাড়াও জামশেদপুর পশ্চিম আসন জিতে বিজেপিকে সাহায্য করেছে। জেএমএম এই অঞ্চলে মোট ১০টি আসন জিতেছে। কংগ্রেস জগনাথপুর আসনটি দখলে রেখেছে। দক্ষিণ ছোটনাগপুর অঞ্চলে, যেখানে 'অনুপ্রবেশ' মোকাবিলায় এনআরসি-র প্রতিশ্রুতি দিয়ে আদিবাসী গ্রামে বিজেপির হয়ে সংঘ পরিবারের অধীনে বনবাসী কল্যাণ আশ্রমগুলির নেটওয়ার্ক লুকিয়ে প্রচার চালাচ্ছিল সেখানে বিজেপি ১১টি তপশিলি উপজাতি-সংরক্ষিত আসনের একটিও জিততে পারেনি।

রাজ্য গঠনের পর থেকেই খুন্তি আসনটি ছিল বিজেপির ঘাঁটি। জেএমএমের রাম সূর্য মুন্ডা ৪২,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজেপির ক্ষমতাসীন নীলকান্ত সিং মুন্ডাকে (পাঁচবারের বিধায়ক) পরাজিত করেছেন। বিজেপি ২০১৯ সালে জেতা তোরপা আসনেও হেরেছে। শুধু রাঁচি এবং হাতিয়া আসনে, বিজেপির ক্ষমতাসীন সি.পি. সিং এবং নবীন জয়সওয়াল তাঁদের অবস্থান ধরে রেখেছেন। কংগ্রেস ১,০০০-এরও কম ভোটের ব্যবধানে বিজেপির কাছ থেকে কাঁকে (তপশিলি জাতি) আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছে। সিলি আসনে এনডিএ-সঙ্গী অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়নকে হারিয়ে দিয়েছে জেএমএম।

More Articles