কী হয়েছিল বেলডাঙার কার্তিক পুজোয়? যা উঠে এল এপিডিআর-এর তদন্তে
Murshidabad Beldanga: গণেশতলা পুজো মণ্ডপে আলোকসজ্জায় সামান্য কিছুক্ষণের জন্য মুসলিমদের উপাস্য আল্লাহর নাম করে অশ্লীল কথা ভেসে ওঠে।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বেলডাঙা। কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করে বেলডাঙায় কার্তিক লড়াই বহু বছরের প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। জেলার তো বটেই, জেলার বাইরের বহু অঞ্চলের মানুষ এই কার্তিক লড়াই দেখতে ভিড় জমান বেলডাঙায়। সেই প্রাচীন পুজোকে ঘিরে অশান্ত হয়ে ওঠে এই এলাকা। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় সাম্প্রদায়িক অশান্তির যে অভিযোগ উঠেছিল, তার নেপথ্যে আসল কারণটি কী? খতিয়ে দেখেছে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটি। ১৬ নভেম্বর ২০২৪ মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙায় কার্তিক পুজোর আলোকসজ্জাকে কেন্দ্র করে ঘটেছিল পুরো অশান্তিটি। কিন্তু কী এমন ঘটল যে জ্বলে উঠল মুর্শিদাবাদের এই অঞ্চল?
তথ্য বলছে, বেলডাঙায় নানা ধরনের প্রায় ২০০ কার্তিক ঠাকুরের এক বিরাট বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। এই বিরাট পুজোর আয়োজন ও শোভাযাত্রাকেই একসঙ্গে মিলিয়ে বলা হয় কার্তিক লড়াই। পুজো-পার্বণ যখন কোনও এলাকার বিশেষ পরিচয় হয়ে ওঠে সেখানে আর নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ কাজ করে না। কার্তিক পুজোতে বহুকাল ধরেই হিন্দু মুসলিম সহ সমস্ত ধর্মের মানুষই তাই নানাভাবে অংশগ্রহণ করে আসছেন। পুজোকে কেন্দ্র করে এলাকায় বিরাট মেলাও হয়, যে মেলাতে সব ধর্মের মানুষই অংশগ্রহণ করেন। তবে বছর কয়েক ধরে এই উৎসবকে ঘিরে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। অনেকেই অভিযোগ করছিলেন, কার্তিক পুজোর এই উৎসব আর যেন নিছক উৎসব না! তা কোনও এক বিশেষ ধর্মের উদযাপন করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। সব ধর্মের মানুষের যে ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল, তা ক্রমশ কমেই আসছিল। গত বছরও পুজোর সময় একটি মণ্ডপের আলোকসজ্জায় রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কিছু কটু কথা লেখা হয়। এলাকার বেশ কিছু মানুষের প্রতিবাদে তা বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ, পুলিশ এই ব্যাপারে কোনও তদন্ত করেনি। বছর গড়াতেই, এবারের পুজোয় সেই আলোকসজ্জাকে ঘিরেই তুলকালাম ঘটে গেল বেলডাঙায়।
আরও পড়ুন- হেমন্তের প্রত্যাবর্তন! বিজেপির মুখে ছাই উড়িয়ে কীভাবে জিতে গেলেন হেমন্ত সোরেন?
১৯ নভেম্বর এপিডিআর-এর মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির একটি দল সেই কারণ অনুসন্ধানেই বেলডাঙায় যান। এলাকার কয়েকজন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন এই দলের সদস্যরা। তাঁরা জানান, গত ১৬ নভেম্বর বেলডাঙার হরিমতি স্কুলের কাছে ছুতোরপাড়ার গণেশতলা পুজো মণ্ডপে আলোকসজ্জাকে কেন্দ্র করে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা ছ'টা-সাড়ে ছ'টা নাগাদ ওই পুজো মণ্ডপের আলোকসজ্জায় সামান্য কিছুক্ষণের জন্য মুসলিমদের উপাস্য আল্লাহর নাম করে অশ্লীল কথা ভেসে ওঠে। সেই আলোকসজ্জার ভিডিও খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায় মোবাইলে মোবাইলে। কমিটির রিপোর্ট বলছে, ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই মণ্ডপকে ঘিরে দুই ধর্মেরই ব্যাপক মানুষ জড়ো হতে থাকেন। এলাকার মুসলিম জনসাধারণ আলোকসজ্জা ও পুজো তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেওয়ার দাবি করেন। বিষয়টি নিয়ে পুজো কমিটির সঙ্গে বচসা শুরু হয়। পুলিশকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয়। এলাকার মানুষ ও স্থানীয় দোকানদারদের বক্তব্য, পুলিশ ঘটনাস্থলে আসতে দেরি করে। ততক্ষণে বচসা গড়িয়ে যায় হাতাহাতিতে। পুলিশ এলে এলাকার দুই ধর্মের মানুষই তাঁদের ঢুকতে বাধা দেয়। এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের একপ্রকার খণ্ডযুদ্ধই শুরু হয়ে যায়।
কমিটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সাধারণ অল্পবয়সি যুবকরা ব্যাপক পরিমাণে এলাকায় জড়ো হন। মেলায় বসা রাস্তার পাশের কিছু দোকানে ভাঙচুর চলে, ইঁট ছোড়া হয়। লাঠি, বাঁশ নিয়ে শুরু হয় মারামারি কিন্তু খুব দ্রুতই বিষয়টি সামলে যায় বলেও জানা গিয়েছে। এলাকার উত্তেজনা কমে যায়। গণেশতলা পুজো মণ্ডপের দায়িত্বে থাকা ডেকোরেটরে কর্মরত বাসার শেখকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বাসার অবশ্য ওই অশ্লীল আলোকসজ্জার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। বাসার সহ এলাকার কিছু মানুষের দাবি, বাসারের কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়ে অন্য কেউ এই আলোকসজ্জায় কারিকুরি করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার অনেকেই এই অনুসন্ধান কমিটিকে বলেন, আপাত অশান্তি ও পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের দ্বন্দ্ব এখানেই থেমে যায়। রাত আটটা নাগাদ ওই এলাকার উত্তেজক পরিস্থিতি অনেকটাই কমে আসে। তাঁদের মতে, আলোকসজ্জার বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে, যাতে এলাকায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাঁরা চাইছেন, বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় শাস্তি হোক।
কমিটি জানাচ্ছে, এলাকার শিক্ষকরা বলছেন, গণেশতলা পুজো মণ্ডপ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে হরেকনগর চামচ ফ্যাক্টরির কাছে বেলডাঙা বাজার থেকে কাপাসডাঙ্গা নিবাসী দুইজন মুসলিম যুবক বাইক নিয়ে গ্রামে ফিরছিলেন। সেখানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন বাঁশ, লাঠি, ঝাঁপা, হেসো নিয়ে তাঁদের ওপর চড়াও হয়। কেউ একজন এমন ভাবে হেঁসো চালায় যে মফিজুল শেখ নামক একজন বাইক আরোহী চরম আহত হয় বলেও অভিযোগ। বেলডাঙা বাজার থেকে আরেকটা বাইকে আরও তিনজন যুবক আসছিলেন যাঁদের সকলেরই বাড়ি ছেতানির কাছে নতুনপাড়া প্রাইমারি স্কুল সংলগ্ন পাড়ায়। মমরেজ মোল্লা, মহম্মদ রাজু শেখ ও সবুর আলি নামের এই তিন যুবকের উপর হরেকনগরের কাছেই ১৫-২০ জন চড়াও হয় বলে অভিযোগ। লাঠি ও বাঁশের আঘাতে মমরেজ ও সবুরের মাথা ফাটে। রাজুকে মাটিতে ফেলে পায়ে ঝাঁপা দিয়ে কোপানো হয় বলেও অভিযোগ।
আরও পড়ুন- কেন অভয়া কাণ্ডের পরও তৃণমূল কংগ্রেস ধাক্কা খেল না?
এই ঘটনার পর আবারও পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়। কলকাতা থেকে লালগোলাগামী, ভাগীরথী এক্সপ্রেস-সহ কিছু ট্রেন বেলডাঙা রেলগেটের কাছে আটকে যায়। অনেক রাতে এলাকার উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়। পুলিশ এলাকা থেকে প্রায় ২২ জনকে গ্রেফতার করে। পুরো এলাকা দখল করে পুলিশ ও র্যাফ। এলাকায় সংশোধিত নতুন ফৌজদারি আইন দণ্ডসংহিতার ১৬৩ ধারা অনুযায়ী কার্ফিউ জারি করা হয়। ১৭ তারিখ থেকে সমস্ত ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়। জানা গেছে, তথ্যানুসন্ধান দলটি ছেতানির কাছে নতুনপাড়া প্রাইমারি স্কুল সংলগ্ন পাড়ায় তিনজন আহত যুবকের বাড়ি যায়, দেখা করে। এই তিনজন যুবকের মধ্যে রাজু শেখ ও সবুর আলি বেঙ্গালুরুতে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই এখন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বলে জানা যাচ্ছে। ১৬ তারিখ ওই হিংসার পর ১৭ তারিখ কার্তিক ঠাকুরের বিসর্জনের শোভাযাত্রা বন্ধ করা গেল না কেন, তাই নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটিকে বেলডাঙার এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জানিয়েছেন, সমস্ত ঘটনার পেছনেই অর্থনীতি জড়িয়ে। বেলডাঙার এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির পেছনেও আখেরে অর্থনীতিই কাজ করছে। বর্তমানে বেলডাঙায় সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সমস্ত ক্ষেত্রেই এলাকার মুসলিম পরিবারের একটা বড় অংশ এগিয়ে এসেছে বলে জানাচ্ছেন তিনি। বেলডাঙা হাটে ও বাজারে বেশ ভালো পরিমাণ অর্থের চলাচল হয় বলেও জানান তিনি। তাঁর অভিযোগ, বেশ কিছু বছর ধরে বেলডাঙাকে নানা জায়গায় 'মিনি পাকিস্তান' বলে উল্লেখ করা হয়। বিশেষত কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর বেলডাঙার এই নয়া নামকরণের চেষ্টা আরও বেড়েছে। বেলডাঙার এই অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্যই ইচ্ছাকৃত সাম্প্রদায়িক হিংসা ঘটানো হচ্ছে বলে দাবি তাঁর। অভিযোগ, এই পরিস্থিতি বেলডাঙায় আগে ছিল না। ছাপাখানার কাছে বেলডাঙা আশ্রমের মূল সংগঠক কার্তিক মহারাজ ও বাদল মহারাজ আসার পর থেকেই এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব ক্রমশ বাড়ছে বলে অভিযোগ।
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটি মনে করছে, ১৬ তারিখ গণেশতলার পুজো মণ্ডপে আলোকসজ্জা নিয়ে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল, তা সামাল দেওয়ার পরও রাত দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ হরেকনগরের কাছে চামচ ফ্যাক্টারি সংলগ্ন এলাকায় আবার চারজন যুবককে কারা মারল, যা নতুন করে ঝামেলার সূত্রপাত ঘটালো, তা অবিলম্বে তদন্ত করে দেখা দরকার। পুজো মণ্ডপের আলোকসজ্জায় কারা আল্লাহর নাম করে অশালীন কথা লিখল এবং কী পদ্ধতিতে লিখল তাও অবশ্যই তদন্ত করে সামনে আনা দরকার।
বেলডাঙার অপ্রীতিকর পরিস্থিতি পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠছে তাতে আসলে কারা জড়িয়ে? কেনই বা রাজ্যের বিজেপি নেতারা রাজ্যের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত করে বেলডাঙাকে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও এনআইএ দিয়ে ঘেরার দাবি করল? সত্যিই কি বেলডাঙার অর্থনীতি দখলের উদ্দেশ্যেই ইচ্ছাকৃতভাবে এখানে সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে?