মৃগী-অভাব-মৃত্যু! জীবনের শেষ বিপন্নতাগুলি যেভাবে ডায়েরিতে লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

Manik Bandopadhyay: শেষজীবনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মার্ক্সবাদী তত্ত্বাদর্শ থেকে সরে গিয়ে দৈবীশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন— এই বহুল প্রচারিত মত আদতে গুজব-বিশেষ।

ভণিতাহীন, বিপজ্জনক, স্নায়বিক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধিস্থানীয় সাহিত্যকর্মের মতো তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি ও চিঠিপত্রকে, অন্তত প্রথম পাঠের অভিঘাত ও অভিজ্ঞতায়, এই তিনটি বিশেষণে চিহ্নিত করা যেতে পারে। অসংখ্য কিংবদন্তি, অপরীক্ষিত মিথ মাথায় নিয়ে পড়তে বসে পাঠশেষে প্রচুর ভ্রান্তিনিরসন, কিছু ধারণার পুনর্গঠন এবং অমীমাংসিত ধোঁয়াশা-অস্পষ্টতা মিলেমিশে যে লেখক ও মানুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁকে সর্বার্থে উপকথার নায়ক বলে মনে হয়। তিনি যতটা প্রতিভাসম্ভূত ততটা পরিশ্রমী নন—এই আনুপাতিক ভাগাহারের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ডায়েরির পাতা ওল্টানোমাত্র নস্যাৎ হয়। জবাব মেলে তাঁর আপাত নৈর্ব্যক্তিকতার যাথার্থ্য নিয়েও। অন্যদিকে শেষজীবনে অতিলৌকিক শক্তির কাছে বিক্ষত নায়কের মতো আত্মসমর্পণের আগ্রহ সংক্রান্ত রহস্য রহস্যই রয়ে যায়।

১৯২৮ সালে সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ। ১৯৫৬ সালে চিরপ্রস্থান। হিসেবমতো আঠাশ বছরের লেখকজীবন। সেখানে শেষ বারো বছর (১৯৪৫-১৯৫৬) ডায়েরি লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সাকুল্যে বারোখানা ডায়েরি-বইয়ে ধৃত তাঁর জীবনের অন্ত্যপর্ব। কবি, প্রাবন্ধিক যুগান্তর চক্রবর্তীর অতুলনীয় সম্পাদনায় গ্রহণ-বর্জনের পর তা প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ২০১১ সালে এসে আমরা পাই ‘অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়েরি ও চিঠিপত্র'-র পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ। সংক্ষেপে হলেও ভূমিকা-প্রবন্ধে সম্পাদক জানান ডায়েরি সংগ্রহের নেপথ্যকথা। রঙচটা, তোবড়ানো, মরচে-মলিন একাধিক টিনের তোরঙ্গ থেকে দিনলিপি উদ্ধারের পর যুগান্তরবাবুর কাছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতি নিকটজনে'-র ‘সন্তপ্ত স্বীকারোক্তি’ ছিল— এরকম অনেক কাগজ-ই তাঁরা ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। বাতিল জঞ্জাল ভেবে তা দিয়ে ধরানো হয়েছে উনুন। এ পর্যন্ত পড়ে মন শোকে, বিস্ময়ে দ্রব হওয়ার পরমুহূর্তে আমাদের স্মরণে আসতে বাধ্য—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো পাণ্ডুলিপিই আজ সম্পূর্ণ অবশিষ্ট নেই! যদি থাকত, তাহলে ‘দিবারাত্রির কাব্য’-র দু'টি ভিন্ন পাঠ, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র সমাপ্তি সংক্রান্ত একাধিক পরীক্ষা সমেত ‘পরিশ্রমী লেখক’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি জরুরি পরিচয় হয়তো নির্মিত হতো। পরিতাপের বিষয় এও, যে লেখক-জীবনের আদি পর্বে মানিক কোনো ডায়েরি লেখেননি। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ লেখার সময় প্রথম মৃগীরোগে আক্রান্ত হন। অথচ সেকথা অনেক পরে লেখা চিঠিতে (১৯৫৫) তিনি স্বীকার করেছেন। আঠাশ বছরের এক প্রতিভাবান তরুণ বাড়ির অমতে বিজ্ঞানশাস্ত্র ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যসাধনায় নিয়োজিত হওয়ার পর আচমকা চিকিৎসাতীত ব্যাধির কবলে পড়ে কোন দুঃস্বপ্ন, কোন অন্ধকার সময়ের মধ্য দিয়ে গেছিলেন, তার পাথুরে প্রমাণ কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ‘দিবারাত্রির কাব্য’-তে হেরম্বের নিজের স্ত্রীকে কড়িকাঠের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার স্মৃতি, তার নিঃসীম একাকিত্ব, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-য় চিকিৎসক শশীর জীবনের সামগ্রিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সবকিছু খুইয়ে ফেলার যন্ত্রণা পাঠকের হাতে পরোক্ষ আত্মজৈবনিক কিছু সূত্র তুলে দেয় মাত্র।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সুপরিকল্পিত সাহিত্যিক ডায়েরি লেখেননি। এক অর্থে এ আমাদের বড়ো প্রাপ্তি। বিভূতিভূষণের ‘ঊর্মিমুখর’, ‘উৎকর্ণ’-র সঙ্গে মানিকের ডায়েরির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। দরবারি প্রকাশ নয়, নিরাভরণ আত্মপ্রকাশই তাঁর দিনলিপির মূল সুর। এই রোজকার লেখা কোনওদিন ছেপে বেরোবে—এমন দূরতম কল্পনাও লেখকের মনে ছিল না। তাই অক্লেশে নিজেকে উন্মুক্ত করেছেন তিনি। কখনও গল্পের প্লট, কখনও বাজারখরচের হিসেব রোজনামচার ফাঁকেফোঁকরে আত্মগোপন করে থেকেছে। বাক্যও হয়তো সম্পূর্ণ করেননি; নিজের বোঝার সুবিধের জন্য কোথাও বা আদ্যক্ষর দিয়ে ঘটনা ও অনুষঙ্গের ইঙ্গিতমাত্র রেখেছেন। কয়েক ছত্র কবিতা লিখতে বসে হঠাৎ-ই দিনপঞ্জির আঁচড় কেটেছেন। আবার খাস ডায়েরি-বইয়ের পাতায় স্থান করে নিয়েছে এপিলেপ্সি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত নোটস, দেশি-বিদেশি চিকিৎসাবিধি, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের উক্তি, দার্শনিক বচন এমনকি ঘোড়দৌড় সংক্রান্ত সাংকেতিক অংকও! নিরবচ্ছিন্ন নয় এই দিনলিপি। বরং, শুরুতে ক্বচিৎ-কদাচিতই তিনি এন্ট্রি রেখেছেন। ধারাবাহিক হতে না পারা নিয়ে অনুতাপ করেছেন। ১৯৫৫ সালের কোনও রোজনামচা হয়তো ১৯৪৬ সালের ডায়েরিতে লিখে ফেলেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিনলিপি তাই কোনো সাজানো স্তবক নয়। ভাগ্যিস নয়! দ্বিধাদীর্ণ এক মানুষের আলেখ্য হয়তো রোজনামচার অবিন্যস্ততার কারণেই আজ আরও জীবন্ত হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়।

আরও পড়ুন- রোগে অনটনে জেরবার! চাকরি চেয়ে যে অবাক করা চিঠি লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়…

>১৯৪৫-এর প্রথম ডায়েরিটিকে এককথায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনার আঁতুড়ঘর বলা যেতে পারে। ‘ছিনিয়ে খাইনি কেন’, ‘বেড়া’, ‘ছাঁটাই রহস্য'-র মতো গল্পের প্লট রূপরেখা আকারে লিখে রাখছেন মানিক। ‘Composers of Bengal’ শিরোনামে শ্রীধর কথক, গোপাল উড়ে, রূপচাঁদ পক্ষীদের মতো উনিশ শতকের বাঙালি সংগীতকারদের জীবনী সংক্রান্ত নোটসও ঠাঁই পাচ্ছে। ধরন থেকে অনুমেয়, ছোট মাপের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের জন্য লেখক নিজেকে প্রস্তুত করছেন। এই ডায়েরি পাণ্ডুলিপি নয়। তাই চিন্তা, পরিকল্পনা সবই চূর্ণাকারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। যেমন: জনপ্রিয় গল্প ‘ছিনিয়ে খাইনি কেন’-র প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন—‘দুর্ভিক্ষপীড়িতেরা লুটে খায় নি কেন?—তারা অহিংস একথা ভুল—না খেয়ে দুর্ব্বল ভোঁতা হয়ে পড়েছিল—যে তেজ লুট করার প্রেরণা দেয় তা ছিল না—’ ব্যাস! এটুকুই। শুধুমাত্র গল্পের স্পিরিট বিষয়ে লেখক হিসেবে নিজেকে নিঃসংশয় রাখা।

পরের বছর, ১৯৪৬ সালের ডায়েরি, স্বভাবধর্মে দিনলিপির চেহারা পেয়েছে। গল্পের প্লটের রেখাচিত্র এখানেও আঁকা হয়েছে। কিন্তু মানুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই প্রথম আমরা খোলামেলা মেজাজে খুঁজে পাচ্ছি। সাংবাদিকসুলভ গদ্যে তিনি ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার গতিশীল ভাষ্য রচনা করছেন। ১৬ অগাস্ট সকালবেলার এন্ট্রি এরকম:

‘ভোরে উঠে শুনলাম রাত্রে রান্নাঘর থেকে সব কিছু চুরি হয়ে গেছে—গুড়, তেল, তরিতরকারি, কলাইকরা বাটি—সব কিছু। আজ হরতাল—direct action day, দাঙ্গার সংবাদ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।… ক্রমাগত গুজব রটছে—চারিদিকে দারুণ উত্তেজনা। কালীঘাট অঞ্চলে শিখদের সঙ্গে মুসলিমদের ভীষণ সংঘর্ষ হয়েছে শুনলাম। ফাঁড়ির ওদিকে নাকি গোল বেধেছে। মসজিদের সামনে ভিড় দেখে এলাম। পাড়ার ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে defence party গড়ছে। কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে—ছোঁয়াচ লেগে—নার্ভাস হয়ে পড়লাম।… অক্ষয়বাবুর ছেলে হৈচৈ চেঁচামেচি ক'রে—শাঁখ আর হুইস্‌ল বাজাবার ব্যবস্থা ক'রে—পাড়াকে সরগরম করে রেখেছে—১৫/২০ মি: অন্তর অকারণে alarm পড়ছে।’

১৬-১৯ অগাস্ট মোট চারদিনের বর্ণনায় নির্মোহ গদ্যকার মানিকের ছাপ স্পষ্ট। পাশাপাশি প্রগতিশীল, দায়বদ্ধ ও দরদি লেখকসত্তাও নির্মোক ভেঙে বেরিয়ে আসে—

বিকালে এ অঞ্চলে শান্তি-সভা হবে শুনলাম। খুশী হয়ে নিজে বার হলাম—যতটা পারি সাহায্য করতে। যাকে দেখছি তাকে বলছি—মিটমাটের জন্য সভায় যেতে।… ফাঁড়ি পেরিয়ে পুলের নীচে যেতে এল বিরোধিতা—হিন্দুদের কাছ থেকে। কিসের মিটমাট—মুসলমানরা এই করেছে, ওই করেছে! ‘ব্যাটা কমিউনিস্ট’ বলে আমায় মারে আর কি! প্রায় দেড়শো লোক মিলে ধরেছিল।’

এহেন সামাজিক দায়বদ্ধতার সমান্তরালে কন্যার টনসিল অপারেশন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত পিতার মানসিক উচাটনও ডায়েরির পাতায় ব্যক্ত হয়েছে৷ ঘরে-বাইরে যখন সংকট তখন শরীরও শোধ তোলে। বচ্ছরভর মৃগীর উপক্রম লেগে থাকে। ডায়েরির পুস্তানিতে ‘F 1946’ হেডিংয়ে পর পর এপিলেপ্সির আক্রমণের দিনক্ষণ লেখা। ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, কখনও খুব ভোরে কখনও দুপুরে প্রায় অজান্তেই, ফিটগ্রস্ত হন। এসবের মধ্যে কাজ থেমে থাকে না। ‘প্রত্যহ’, ‘সীমান্ত’, ‘গল্পভারতী’, ‘দীপায়ন’, ‘সাহিত্যপত্র'-র মতো ছোট-বড় পত্রিকায় মানিক গল্প পাঠাতে থাকেন। না লিখলে হাঁড়ি চড়বে না। ‘কলম-পেষা মজুর’ তিনি। তাই ৬ ডিসেম্বর ডায়েরিতে বলেন—

‘প্রত্যহের রবিবাসরীয়ের জন্য ৩৫ টাকায় গল্প দিতে অক্ষমতা জানালাম। ৫০ টাকা সর্বনিম্ন মজুরি।’

আমাদের স্মরণে আসবে আট বছর আগে, ১৯৩৮ সালে, জনৈক এক সম্পাদককে লেখা চিঠির কথা। যেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্লেষের সুরে বলছেন—

সম্মানমূল্যের জন্য আমি গল্প লিখি না, গল্প লিখিয়া কিছু সম্মানমূল্য প্রত্যাশা করি।… আজকাল একটা অপরাধ করিতে আরম্ভ করিয়াছি—গল্পের জন্য কিছু বেশী পারিশ্রমিক দাবী করি। অপরাধ তবু মার্জ্জনীয়, অভদ্রতার মার্জ্জনা নাই। তবু একটা ঘোরতর অভদ্রতা করি—প্রায় দোকানদারের মতই প্রার্থনা জানাই পারিশ্রমিকটা হাতে হাতে নগদ দিতে হইবে।’

যথোপযুক্ত পরিশ্রমের পর হকের মজুরি ‘ছিনিয়ে’ আনায় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে কোনওদিন এতটুকু দ্বিধা ছিল না। ১৯৪৮-এর ডায়েরি অনিয়মিত ও সংক্ষিপ্ত। জানুয়ারি, এপ্রিল ও মে মাসের হাতেগোনা কিছু এন্ট্রি। কখনও বোম্বাই কখনও আন্দুল। বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন মানিক। পুতুলনাচের ইতিকথার ছায়াচিত্রের চুক্তি সই করছেন। সাংসারিক ঝঞ্ঝাট মিটছে না বটে। তবু সৃষ্টিশীল সময় বেশ উপভোগ করছেন। ডায়েরির বাচনে তা স্পষ্ট। ভালো-মন্দ মিলিয়ে পরের বছরটিও (১৯৪৯) কেটে যায়। টালিগঞ্জের দিগম্বরীতলায় পৈতৃক বাড়ি বিক্রির সূত্রে সংসারে ডামাডোল আসে। যে কারণে ‘বাড়ী সমস্যা!’ লিখে তাঁর একাধিক এন্ট্রির শুরু। একদিকে উদভ্রান্তের মতো ভাড়াবাড়ি খুঁজে চলেছেন। অন্যদিকে ট্রামের ভাড়াবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের প্রতিবাদ ও পুলিশি বর্বরতায় চারজন ছাত্রের মৃত্যুতে উদ্বেল মন। ২০ জানুয়ারির দিনলিপিতে নাশকতা-সন্ত্রস্ত কলকাতার জীবন্ত ছবিটি এরকম—

‘আজ পুলিশের সাহায্যে মিলিটারী আমদানী। কলেজ স্ট্রিট দিয়ে যেতে শুধু পথে নয়—সিনেট হাউসে প্রেসিডেন্সী কলেজের ভেতরে সৈন্যের ঘাঁটি দেখে মনে হয় অদ্ভুত দৃশ্যই বটে! কলেজের ছাতে বন্দুক তাক করে সৈন্য!’

উল্লেখ্য, বেশ কিছু টিপ্পনী ও মন্তব্যের সূত্রে সাংসারিক সীমাবদ্ধতায় বিক্ষিপ্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রথম আমাদের নজরে আসেন। ‘দাদা চিরদিন অকৃতজ্ঞ অর্থপিশাচ’, ‘বাড়িওয়ালা সম্পর্কে প্রথম ধারণাই পরিপুষ্ট হচ্ছে—আদর্শ আত্মকেন্দ্রিক নিম্নমধ্যবিত্ত বিষয়ী এবং স্ত্রৈণ’, ‘বিজয়লালের বন্ধু বাংলা কংগ্রেসের চর কালো বেঁটে ধূর্ত্ত ভাবপ্রবণ অবিবাহিত আদর্শবাদী তার্কিক সস্তা কৌশলী’—মন্তব্যগুলি ক্ষুদ্র মানুষী চৌহদ্দিতে ঘুরপাক খেলেও বিশ্লেষণপ্রিয় কথাকারের তির্যক চাহনিকেও কি অস্বীকার করা যায়? শক্তিমান লেখকের দুর্মর অহংও উঁকিঝুঁকি মারে কোথাও কোথাও—

‘ট্যাক্সিতে গিয়েছিলাম—ট্যাক্সিতে ফিরলাম। কলেজগুলির প্রচুর পয়সা—শিক্ষার ব্যবসা। তবু, ছাত্রদের চাপে আমাকে নিয়ে গিয়ে আমার বক্তৃতা ছাত্রদের শোনাতে হল—তারাশঙ্করকে নয়!’

১৯৫০ থেকে ডায়েরির চরিত্র বদলাতে থাকে। বরানগরের ভাড়াবাড়িতে ক্যানভাসের পার্টিশন দিয়ে পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকার ব্যবস্থা করা, স্ত্রীর মৃত সন্তান প্রসব, আর্থিক দুর্দশা, ‘পরিচয়’ পত্রিকায় লেখার অপরাধে প্রগতি লেখক আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ—সব মিলিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে বাধ্য হন, ‘জীবনটা সাহিত্যসৃষ্টির প্রতিকূল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’অনটন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যাতে তাঁকে লিখতে হয়—

‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুসী নয়। বলল যে বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করছি বাড়ী ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব! অনেক খরচ বাঁচবে।’

স্ত্রীর এই অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ার কারণ অনুসন্ধানে মানিকের বিশ্লেষণ—

মানুষ সন্তানকে ভয় করছে? দশমাস গর্ভ ধারণ করে মৃত সন্তান প্রসব করে মা ভাবছে, বাঁচা গেল? অভিশপ্ত সমাজ এমনি অস্বাভাবিক করেছে জীবন।’

১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে সাংসারিক ব্যায় সংকোচনের উদ্দেশ্যে ‘ত্রৈমাসিক প্ল্যান’-এর ছক কষেন মানিক। সিগারেট ও মদের খরচ কমানো, ঋণ মিটিয়ে অন্তত ৫০০ টাকা সঞ্চয়, স্বাস্থ্যের উন্নতিকে প্রধান কাজ হিসেবে দেগে দেন। সেই সঙ্গে অন্তিম সতর্কবার্তা— ‘কঠোর চেষ্টার দ্বারা এই তিনমাসে বর্তমান অবস্থা অনেকটা বদলাইয়া না দিলে সর্ব্বনাশ ঠেকানো যাইবে না।’ টাল সামলাতে প্রকাশকের দফতরে নতুন চুক্তি, পাওনা-বকেয়া উদ্ধার নিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েন। গল্পের প্লটের চিহ্ন ধীরে ধীরে মুছে যায়। জায়গা নেয় রোগজ্বালা, সংসারে স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি, সন্তানদের অসুস্থতার প্রসঙ্গ। সবকিছু সামাল দিতে অর্থের সন্ধানে পদাতিক মানিক হন্যে হয়ে হেঁটে চলেন শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা—

সারাদিন ঘুরেছি—দুপুর ১টা থেকে রাত রাত ৮টা। ২ মাইল হাঁটা হয়েছে।… আজও বেরিয়ে অনেক কাজ সেরে এলাম—প্রকাশকদের কাছে—... কী শ্রান্তিই বোধ করছি।’১৯৫৩)

এতকিছুর পরেও হকের মজুরি মেলে কই?'‘

লাজুকলতার শেষ ফর্মা কভার সই করলাম, টাকা কই?’, ‘গল্পভারতীর অগ্নিশুদ্ধির প্রুফ দেখে দিলাম—মজুরি পাঠায় নি’, ‘বেঙ্গলে শচীনের কাছে ১০০ টাকা চেয়ে পত্র দিলাম’—পর পর এন্ট্রিগুলি হতাশায়, বেদনায়, আর্তনাদে আতুর।

হয়তো এরই ফলশ্রুতিতে পরের বছর, ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারির পাতায় প্রথমবারের জন্য আমরা ‘মা’-এর উচ্চারণ শুনি। সরকারি উদ্যোগে ডিভিসি পরিদর্শন বাতিল হওয়ার প্রসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন—‘মা বোধহয় ভালই করলেন।’ কে এই মা? কোনও সুস্পষ্ট উত্তর লেখক দেননি। মা কালীর অনুমান জনপ্রিয় হলেও সত্য নয়। কারণ ২৮ এপ্রিলের এন্ট্রিতে লেখক স্পষ্ট বলছেন—

‘কোনো প্রতীক অবলম্বন না করলে প্রণামের সময় বিক্ষিপ্ত হয় কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে প্রতীক প্রতীক—মা কে বা কেমন জানি না।’

পরের বছর (১৯৫৫) যখন তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে হাসপাতালে শুয়ে তখনও একই কথার প্রতিধ্বনি—‘মায়ের রূপ গুণ কিছুই জানি না, কি নিয়মে দয়া করেন তাও জানি না, শুধু এটুকুই জানি যে মায়ের নিয়মের এদিক ওদিক নেই…’

আরও পড়ুন- প্রেম আসলে নিষ্ঠুর, আদিম! মানিক, বনফুল, তারাশঙ্করের না-ভালোবাসার তিন আখ্যান

এ প্রসঙ্গে এটুকুই বলার, শেষজীবনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মার্ক্সবাদী তত্ত্বাদর্শ থেকে সরে গিয়ে দৈবীশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন— এই বহুল প্রচারিত মত আদতে গুজব-বিশেষ। ফ্রয়েড পর্ব, মার্ক্স পর্ব, আধ্যাত্মিক পর্ব বলে জল-অচল কোনও বিভাজন মানিকের জীবনে ছিল না। প্রথমত, মৃত্যুর আগের বছর (১৯৫৫) হাসপাতালে শুয়ে যখন তিনি ডায়েরিতে মায়ের দয়া, ক্ষমা নিয়ে নিয়ে লিখছেন, তখন একইসঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশ নির্বাচনে দলের ভরাডুবি দেখে ব্যাকুল হচ্ছেন। পার্টির সংস্কার ও শোধন বিষয়ে খোলাখুলি সমালোচনা করছেন। স্পষ্ট জানাচ্ছেন মার্ক্সবাদীদের ‘বিনয় শিখতে হবে, ঐতিহ্যকে বা বর্তমান সমসাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার দম্ভ ত্যাগ করতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে… The C.P.I. does not understand the mind of India.’ দ্বিতীয়ত, মায়ের করুণাভিক্ষা চাইছেন বটে। কিন্তু একইসঙ্গে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে চিরদিন অহংকার করে আসা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেডে শুয়ে লিখছেন—‘যদি পারি পুরানো শাস্ত্রসংস্কার বিশ্বাসের গণ্ডী ভেঙে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মহাশক্তিকে নিয়ে একখানা বই লিখব। সেকেলে মাকে একেলে করার সাধ—’ নিছকই ভাবতন্ময়তার ঘোরে উন্মাদ হয়ে পড়েননি মানিক। চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনও এক শক্তিকে আঁকড়ে দিশা ফিরে পেতে চেয়েছেন। আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার ও সংশোধনের রাস্তা খুঁজতে চেয়েছেন। কিন্তু তার জন্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি আবিল হয়নি, সাম্যের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।

১৯৫৫ সালের ডায়েরি মূলত তাঁর হাসপাতালে (ইসলামিয়া হাসপাতাল ও লুম্বিনী পার্ক মানসিক চিকিৎসালয়) দিনযাপনের পঞ্জি। ব্যাধি, আসক্তি আর দারিদ্র‍্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াইয়ের শেষ পর্ব। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অতুল গুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুলেখা সান্যাল, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মুজফফর আহমেদ— সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৃত্তের প্রচুর শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে তাঁর কথালাপের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। চিকিৎসাপদ্ধতির বিবরণ, পথ্যের তালিকায় দিনলিপি আকীর্ণ। এসবের মধ্যেও মানিক উপন্যাস (‘পরাধীন প্রেম’) লিখেছেন, প্রুফ দেখছেন। কেউ একদিন দেখা না করতে এলে ব্যাকুল হয়েছেন। একই সঙ্গে উপভোগ করেছেন প্রাণান্তকর দৌড়ঝাঁপ থেকে ক্ষণিকের মুক্তি—‘কী সুমিষ্ট মধুর এই চিন্তাহীন স্বাধীন পরিপূর্ণ বিশ্রাম!’ অ্যালকোহলের আসক্তি তিনি ছাড়তে পারেননি (ছাড়া সম্ভবও ছিল না)। দারোয়ান, নার্স, ডাক্তারদের চোখে ধুলো দিয়ে, মিথ্যে বলে বাইরে থেকে মদ কিনে এনেছেন। কখনও থলিতে ভরে, কখনও কাগজে মুড়ে। ফিরে এসে সবকিছু ডায়েরিতে লিখেছেন। শিশুসুলভ অপরাধবোধে লেখা সেই এন্ট্রিগুলি আমাদের বিষণ্ণ করে। ট্রাজেডির শেষটুকু স্থির। প্রিয় নায়ক ধীরে ধীরে কবে কীভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন, কীভাবে জমতে থাকবে ‘পাথরের ফুল’—সবটা জানা। তাই হয়তো এই স্খলন-বিচ্যুতি (hamartia) গোটা গোটা অক্ষরে মুদ্রিত দেখার যন্ত্রণা হৃদয়ে এক অসাড় সন্তাপের জন্ম দেয়। সেই শোক ঘনীভূত হয় তাঁর শেষ লেখায় (২৯ নভেম্বর, ১৯৫৬)। সরষের তেল, হলুদ, মুসর, মুগ, বিউলির ডাল, মাছ, লেবু, বিড়ি, সিগারেটের পাইপয়সার গোছানো হিসেব। লড়াই থেমে যায়নি… চিন্তাভারাতুর মস্তিষ্ক এখনও সচল। সংসারখরচা মিটিয়ে, পাঞ্জাবীর আস্তিন গুটিয়ে এই বুঝি নতুন কোনও গল্পের প্লট লিখতে বসবেন তিনি… ‘এ-দেশের দরিদ্রতম বড়ো লেখক’… মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থঋণ:অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডায়েরি ও চিঠিপত্র)— যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত (দে'জ পাবলিশিং)

More Articles