লক্ষ কোটি টাকার ঘুষ, অনিয়ম! হাসিনার আওয়ামী লীগের দুর্নীতির যে চিত্র উঠে এল শ্বেতপত্রে
Sheikh Hasina Corruption: শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে নাকি গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ১৫ বছরের শাসনামলে হাসিনার বিরুদ্ধে দমনপীড়ন থেকে শুরু করে ব্যাপক দুর্নীতি— নানা অভিযোগই উঠেছিল। এবার সেই অভিযোগের সাপেক্ষে সামনে আসছে নানা প্রমাণও। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারের নানা কাজে যেসব পণ্য ও পরিষেবা কেনা হয়েছে তাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। আর এই টাকার মধ্যে কেবল ঘুষ দিতেই নাকি ব্যবহার হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা! অভিযোগ, ঘুষ নিয়েছেন আওয়ামী লীগেরই রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাঁদের সহযোগীরা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে তদন্ত করতে মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গড়েছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র কমিটি যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ঘুষের টাকার মধ্যে ৭৭ হাজার থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা গেছে আমলাদের কাছে। রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের সহযোগীরা পেয়েছেন ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রকের হিসাব বলছে, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর আমলে জমতে থাকা ঋণের পরিমাণ এখন ১৫৫ বিলিয়ন ডলার!
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে নাকি গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে বিদেশে ২৪০ বিলিয়ন বা ২ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম বিষয়ে যে ৪০০ পাতার শ্বেতপত্র তৈরি করেছে তাতে মূল যা যা উঠে এল-
আরও পড়ুন- ফেলানি খাতুন থেকে স্বর্ণা দাস! যেভাবে সীমান্তে বারবার প্রাণ যায় সাধারণ বাংলাদেশিদের…
বিদেশে অর্থ পাচার
শ্বেতপত্র অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সরকার থাকাকালীন বাংলাদেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। সরকার পতনের পর, হাসিনা দেশত্যাগী হওয়ার পরে ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের শাসনের ভার নেয়, যার প্রধান হন নোবেলজয়ী অধ্যাপক মহম্মদ ইউনূস। ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের বিএফআইইউ, সিআইডির সহায়তায় বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরানোর পাশাপাশি আত্মসাৎ করা টাকা পুনরুদ্ধারের কাজও শুরু করে।
শ্বেতপত্রে বলা হচ্ছে, গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। বিবিসি বাংলাদেশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই টাকার অঙ্ক দেখে ইউনূস বলেছেন, “আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে তারা লুণ্ঠন করেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। দুঃখের বিষয় হলো, তারা প্রকাশ্যে এই লুটপাট চালিয়েছে। আমাদের বেশিরভাগ অংশই এর মোকাবিলা করার সাহস করতে পারেনি।”
সরকারের প্রকল্পে নানা দুর্নীতি-অনিয়ম
শেখ হাসিনা সরকার নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। ১৫ বছরের শাসনাআমলে ২৯টি বৃহদাকার প্রকল্পের মধ্যে ৭টি প্রকল্প খতিয়ে দেখেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটি বলছে, বড় প্রকল্পের প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ওই ৭টি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা।
শ্বেতপত্রে বলা হচ্ছে, এই সমস্ত প্রকল্পে জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং জমি কেনায় হেরফের করে টাকা খরচের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। খরচ নাকি ৭০ শতাংশেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে। শ্বেতপত্র অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ নাকি সরকারের আমলারাই লুটপাট করেছেন।
আরও পড়ুন- হাসিনার দেশে কাদের গুম করে রাখা হতো কুঠুরিতে! কী এই রহস্যময় আয়নাঘর?
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নিয়োগে দুর্নীতি
শ্বেতপত্রে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, বাহ্যিক ভারসাম্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান ক্ষেত্রের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে নানা দুর্নীতি হয়েছে। শ্বেতপত্র কমিটি বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে হাসিনা সরকারের আমলে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে যদি ১০ শতাংশও অবৈধ লেনদেন হয়ে থাকলে তার পরিমাণ কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
শ্বেতপত্র জানাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক তছরুপ হয়েছে। ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য ঋণ কেলেঙ্কারি, প্রতারণা, ভুয়ো ঋণ ও ঋণের অপব্যবহারের বিভিন্ন ঘটনা ফাঁস করেছে ওই প্রতিবেদন। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারি প্রকল্পের কাজ পেতে ঘুষ নেওয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের লোককেই কাজ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
স্বজনপোষণ
শ্বেতপত্র কমিটি আরও জানাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে স্বজনপোষণ ঘটেছে। বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার বদলে রাজনৈতিক সম্পর্ককেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে গাড়ি ও ভ্রমণ খরচের অপব্যবহার করা হয়েছে। কমিটি পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্পগুলি নিয়েও মতামত জানিয়েছে।