জ্বলছে আগুন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে টানা বিক্ষোভ, ইজরায়েলের অবস্থা কতটা ভয়ংকর?

Israel Political Crisis Netanyahu : সবকিছুর মূলে রয়েছে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তাঁর বিতর্কিত বিচার বিভাগ সংস্কারের সিদ্ধান্ত।

রাস্তায় রাস্তায় নেমে পড়েছে জনতা। দেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে দিনরাত প্রতিবাদ করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে চলছে এই বিক্ষোভ। একটু একটু করে সেই ছবিটা ভয়ংকর আকার নিচ্ছে। আগুন জ্বলছে, খোদ প্রধানমন্ত্রীর ছবি পোড়ানো হচ্ছে। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে সেই বিক্ষোভের আগুন। সেইসঙ্গে চলছে সমানে লাঠিচার্জ, গ্রেফতার, জলকামান ছোঁড়া। বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে ইজরায়েলের পরিস্থিতিটা এরকমই। বলা ভালো, এই সামান্য কয়েকটা শব্দের থেকেও ভয়ংকর। খোদ সরকারের বিরুদ্ধে এই বিপুল প্রতিবাদ প্রায় গৃহযুদ্ধের চেহারা নিয়েছে। সবার মুখে একটাই কথা, ইজরায়েল প্রশাসন মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায়। গণতন্ত্রকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চায়। তাই আওয়াজ তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিগত বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে এমন পরিস্থিতি। প্রতিবাদ, বিক্ষোভের এই ঢেউ বাড়তে বাড়তে এখন ধর্মঘটের পর্যায় চলে গিয়েছে। অচল হয়ে গিয়েছে বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দরগুলি। এদিকে এই বিক্ষোভে ছাত্ররা তো বটেই, শিক্ষক, ডাক্তাররাও যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের বেশকিছু কর্তা। সবার মুখে একটাই মন্ত্র, ইজরায়েলের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে। অরাজকতার হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা, ব্যাঙ্ক সমস্ত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু। আর এই সবকিছুর মূলে রয়েছে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তাঁর বিতর্কিত বিচার বিভাগ সংস্কারের সিদ্ধান্ত।

israel 2

ইজরায়েল এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে নেতানিয়াহু কোনও নতুন নাম নয়। এর আগেও টানা ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সম্প্রতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে ফের একবার সরকার গঠন করেছেন তিনি। তবে এবারের এই প্রশাসন আর মন্ত্রীদের নিয়েই যত বিপত্তি। বলা হচ্ছে, এই সরকার অত্যন্ত গোঁড়া এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছে। ইহুদিরাই তাদের কাছে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে সামনে এসেছে বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রস্তাবনা। সেখানে নেতানিয়াহু সরকার বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন –

১) ইজরায়েলের বিচারক নিয়োগকারী কমিটি আগে স্বাধীনভাবে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারত। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, তাদের ওপর নেতানিয়াহু সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কাকে নিয়োগ করা হচ্ছে, কী পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে সমস্ত কিছুর ওপর সরকারের নজরদারি থাকবে।

২) সংস্কারের ফলে আদালতের ক্ষমতা অনেকটা কমে যাবে। তার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও বেশি করে হবে। যে আইন অসাংবিধানিক বলে খারিজ করা হয়েছিল, সেগুলো পাস করতে তাহলে কোনও সমস্যা হবে না।

israel 3

৩) ইজরায়েলের সংসদ বা পার্লামেন্টের ক্ষমতা এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে, যাতে সবাই একজোট হয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও নাকচ করতে পারেন। সেই সিদ্ধান্ত একেবারে ওলটপালটও করে দিতে পারবেন।

৪) প্রধানমন্ত্রী সহ ইজরায়েলের কোনও নেতা বা মন্ত্রী যদি কোনও কাজে অপরাধী হন, কিংবা দায়িত্ব পালন করতে অপারগ হন, তাহলেও তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরানো যাবে না। আগে আদালতে গেলে তদন্ত করার পর সেই কাজটি বিচারক করতে পারতেন। এখন সেই নিয়মও আগের থেকে অনেকটাই কঠিন করা হচ্ছে। এক বাক্যে বলতে গেলে, আদালত, বিচার ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

ঠিক এই জায়গা থেকেই বিক্ষোভের শুরু। কারণ, খোদ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নামে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে তা নিয়ে তদন্তও চলছে। ইজরায়েলের একটা বড় অংশের মানুষের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি ঢাকার জন্য, আর অন্যদের দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আদালত, বিচার ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ মানা হয়। সেখানেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলে সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন?

israel 1

এরইমধ্যে ইজরায়েলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োভ গালান্ট প্রধানমন্ত্রীকে এই সংস্কারের পরিকল্পনা পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তার ফল? ইয়োভকে মন্ত্রিত্ব থেকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই বিক্ষোভ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কারও কারও মতে, বিগত কয়েক দশকের সবচেয়ে ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে ইজরায়েল। যেখানে গণতন্ত্র রক্ষাই মূল জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিটলারি শাসন থেকে ইজরায়েলকে বেরিয়ে আসতে হবে, এই মন্ত্রই শোনাচ্ছেন সেই দেশের বাসিন্দারা।

দীর্ঘদিন ধরে চলা এই বিক্ষোভ, প্রতিবাদ আর ধর্মঘটের জেরে অচলাবস্থা গোটা ইজরায়েল জুড়ে। সেই দেশের অর্থনীতিও সংকটের মুখে। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, আপাতত এই পরিকল্পনা কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হল। পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশনে এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তাঁর বক্তব্য, এরকম গৃহযুদ্ধ চায় না ইজরায়েল। যাতে তাড়াতাড়ি এই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ বন্ধ হয়, অচলাবস্থা কেটে যায়, তারই প্রার্থনা করেছেন নেতানিয়াহু। কিন্তু এই কথায় আদৌ কি চিঁড়ে ভিজবে? সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

More Articles