পানীয় জলে দুর্গন্ধ! কলকাতায় যেভাবে বিষের আধার হয়ে উঠছে জলাভূমিগুলি
Kolkata Wetlands: সুন্দরবনের মতো রামসার সাইটে যেখানে কলকারাখানা গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে বিলাসবহুল পর্যটনক্ষেত্র, আর চোখে পড়ে নদীর জল চিরে বেরিয়ে যাওয়া স্পিড বোটের অশ্লীল যাতায়াত, সেখানে কলকাতার জলাভূমি…
পূর্ব কলকাতার জলাভূমি এবং খাস কলকাতার পুকুর, ক্যানেলের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। কলকাতা আর আদৌ কল্লোলিনী রয়েছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও, কলকাতার বুকে বয়ে চলা নদী আর ক্যানেলগুলি আর যে কল্লোলিনী নেই, সে বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। অবশ্য নদী বললে ভুল হবে, কলকাতার মধ্যেই যে আদিগঙ্গা এবং শহরের খুব সন্নিকটেই যে আদি বিদ্যাধরী এবং পিয়ালি নদী এক সময় বয়ে গেছিল, তা মানুষের যৌথ-স্মৃতি থেকেই হারিয়ে গিয়েছে। বিদ্যাধরী মৃত। পিয়ালির অবস্থা শোচনীয়। ঐতিহাসিক আদিগঙ্গাকে নর্দমা বললেও একটি শব্দ বাড়িয়ে বলা হয় না। পূর্ব কলকাতার জলাভূমিও কালো কিংবা শ্যাওলার থিকথিকে স্তরে সবুজ হয়েছে।
বিশ্ব জলাভূমি দিবসের প্রাক্কালে আমাদের নদীমাতৃক দেশের নদী, জলাভূমিকে নিয়ে যে এই কালো, পূতিগন্ধময় বাস্তবের ভেতরে কোনও একদিন হাতড়াতে হবে, সে কথা আমরা ক’জনই বা ভেবেছিলাম? অথচ তা-ই ছিল আমাদের ভবিতব্য। ভবিতব্য ছিল বন্যা, জলজমা, সাইক্লোন, সারা বছরব্যপী অকাল বৃষ্টি। কিংবা কালবৈশাখী-বিহীন এপ্রিল, মে, জুন। ভবিতব্য ছিল একদা নদীমাতৃক এক ভূ-খণ্ডে ক্রমহারে ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া। কারণ এ শহরে দিনদুপুরে পুকুর বোজানো হয়। রাতারাতি বদলে যায় ভেড়ির মালিকানা। সরকারি খাতায় জলভূমিকে জলভূমি বলে না দেখিয়ে, দেখানো হয় জমি বলে। যাতে সেখানে ঝঞ্ঝাটবিহীনভাবে ভিত স্থাপন করা যায় নতুন কোনও ইমারতের।
কলকাতার জলাভূমি, খাল এবং অবশ্যই নদী— এ শহরে পানীয় জল থেকে শুরু করে, দৈনন্দিন ব্যবহারের জল, কৃষিকাজ, মাছচাষের জলের উৎস। স্বাভাবিকভাবেই সেই জল দূষিত হলে কিংবা জলের উৎস চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলে জনজীবনে প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে প্রভাবিত হন আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষেরা এবং অবশ্যই জলাভূমির আশেপাশে যারা সারা বছর বসবাস করেন। ক্ষতিগ্রস্থ হয় সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র। ক্ষতিগ্রস্থ হয় জলাভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র, সেখানকার মাছ, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী থেকে শুরু করে মানুষ অবধি।
পূর্ব কলকাতা জলাভূমি
পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চল ১২,৫০০ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে বিস্তীর্ণ এক জলাভূমি অঞ্চল। প্রাকৃতিক জলের শোধন থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই জলাভূমি। এই জলাভূমি অঞ্চল রামসার সাইটের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্তরে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৭১ সালে ইউনেস্কোর স্থাপন করা রামসার কনভেনশনের আওতায় পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই কনভেনশনের উদ্দেশ্য জীববৈচিত্রপূর্ণ জলাভূমিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
২০২৪ সালে জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্টের একটি গবেষণা বলছে বিগত ৩২ বছরে এই জলাভূমির বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৯১ সালে যেখানে এই জলাভূমির মোট অঞ্চল ছিল ৯১.২ স্কোয়ার কিলোমিটার, ২০২৩ সালে তা ৩৩.৪ স্কোয়ার কিলোমিটারে ঠেকেছে। চাষাবাদের জমি ২৭.৮ স্কোয়ার কিলোমিটার থেকে ৫৮.৫ স্কোয়ার কিলোমিটার অবধি বেড়েছে এই সময়ের মধ্যেই। দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এই অঞ্চলে সামগ্রিক ভরাট জমির আয়তন ০.২ স্কোয়ার কিলোমিটার থেকে ১০.৫ স্কোয়ার কিলোমিটারে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে জলাভূমিগুলি খণ্ডিত হয়েছে বারবার। তারা আয়তনে বা গভীরতায় না বাড়লেও, সংখ্যায় বেড়েছে বটে। ১৯৯১ সালে জলাভূমির সংখ্যা ছিল যেখানে ২৬৮৯, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যাই বেড়ে হয়েছে ৪৫৩২।২০১২ সাল থেকে ২০২৫ অবধি পূর্ব কলকাতার জলাভূমির যে সঙ্কোচন হয়েছে, তা গুগল আর্থ থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট ছবিই বলে দেবে। জলাভূমি হয়তো সবক্ষেত্রে রাতারাতি বুজিয়ে ফেলা হয়নি। কিন্তু তা যে বদ্ধ হয়েছে এবং গজিয়ে ওঠা ইমারত যে তাদের ধীরে ধীরে গিলে নিয়েছে, তা একাধিক ছবিতে স্পষ্ট। ফলে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ১৯৭২ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১৭.৯% কমেছে এবং বোজানো অঞ্চলের মোট আয়তন ১৬৫% বেড়েছে মাত্র ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে।
“This is compounded by the loss of agencies of citizens, especially vulnerable communities, as access to water and water bodies and decision around its course are controlled by the centralised authorities” – Ecocide, David Whytes (2020), Manchester University Press
কলকাতার জলাভূমির সাম্প্রতিক অবনমনের পেছনে জলাভূমি বোজানো যত না বেশি দায়ী, তার থেকেও বেশি দায়ী এই শহরের সুয়েজ সিস্টেম। অর্থাৎ বাড়িঘর, কারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁ থেকে আসা আবর্জনাময় জল। যা আদতে গিয়ে মেশে কলকাতার জলাভূমি বা ওয়েটল্যান্ডসে গিয়ে। জলাদর্শ কালেকটিভের মতে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি প্রাকৃতিকভাবে আসা শহুরে আবর্জনার চাপ সইতে পারলেও, শহরে আইনি ও বেআইনি ভাবে গজিয়ে ওঠা কলকারখানা থেকে ধেয়ে আসা রাসায়নিক এবং জৈবআবর্জনার ধকল সইতে পারে না।
জলাদর্শ কালেকটিভের ২০২৪ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট জানাচ্ছে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চলের লরি রোড, ট্যাংরা, ধাপা, বানতলা অঞ্চলের মিউনিসিপালিটির ট্যাপের জলে ঔষধি গন্ধ, কোথাও বা পচা গন্ধ। জলে লোহার পরিমাণও বেশি। কিছু অংশ বাদ দিলে, প্রায় ৯০% অংশ জুড়ে আবর্জনা ফেলা হয়। বানতলা পাম্পিং স্টেশনের সন্নিকটেই জলে মিলেছে সাদা ফেনা।
কোনও প্রাকৃতিক জলাভূমিই আসলে তা পারে না। সে কেবল প্রাকৃতিক আবর্জনাই রিসাইকল করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে পারে। অন্যথা নয়। উপরন্তু এই রাসায়নিক ও জৈব আবর্জনার (সঙ্গে প্লাস্টিক দোসর) জলাভূমির স্বাভাবিক প্রবাহকে থামিয়ে দিয়েছে দীর্ঘদিন। সেই রাসায়নিকের প্রভাবে ব্যপক হারে গজিয়ে উঠেছে অনাবশ্যক শ্যাওলা ও অন্যান্য জলজ আগাছা। সে ঘটনাকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ইউট্রোফিকেশন। ইউট্রোফিকেশনকে বলা চলে জলাভূমিকে পচা ডোবা কিংবা বদ্ধ জলাশয়ের জন্মের প্রাথমিক ধাপ। আর সেই বদ্ধ ডোবাকে খাতায়-কলমে জমি হিসেবে দেখাতে প্রশাসন কার্পণ্য করে না।কলকাতার নদী ও খাল
জলভূমির প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় এবং অবশ্যই অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে কলকাতার অন্তর্বর্তী পুরনো নদীগুলি বিছিন্ন হয়ে তৈরি হয়েছে ভাঙা নদী (ব্রোকেন রিভার) এবং মরা নদী বা হাজামজা। স্যাটেলাইট চিত্র একটা সময় পর আর আদি গঙ্গা বা টলি নালার গতিপথ ধরতে পারে না। কারণ মেট্রো রেলওয়ের কাজের জন্যে সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ৩০০ টি পিলার। অন্তত ২০২৪ সাল অবধি প্রকাশিত একাধিক রিপোর্ট দেখাচ্ছে আদি গঙ্গার সংস্কার ও পুনরুদ্ধার দ্রুত প্রয়োজন। আদিগঙ্গা হুগলি নদীরই একটি আদি ধারা এবং একটি প্যালিও-চ্যানেল। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল (যা আসলে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল) এবং সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে যার প্রবাহ অত্যাবশক। আদি গঙ্গা ধেয়ে চলেছিল পিয়ালি নদীর দিকে, যা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা হয়ে বয়ে চলা আরেকটি নদী। জলাদর্শ কালেকটিভের রিপোর্ট বলছে এই নদীও এখন সঙ্কটে। ভুললে চলবে না, এই জলাভূমি কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলের জিওনকাঠি এবং বৃষ্টিরও। তাই এই সুয়েজ রিসাইক্লিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শহর এবং তার বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচাতে।
আরও পড়ুন-ই-জঞ্জালে ভরেছে কলকাতা, নরকে চোখ বুজে আছেন আপনি?
জলাদর্শ কালেকটিভের ২০২৪ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট (যার সমীক্ষা হয়েছে ২০২৩ থেকে ২০২৪ জুড়ে) বলছে আদিগঙ্গা-সুতি ক্যানালের চেতলা, কুঁদঘাট, গড়িয়া, পাঁচপোঁতা, শামুকপোঁতা অঞ্চলের সরবরাহ হওয়া মিউনিসিপালিটির ট্যাপের জল দুর্গন্ধযুক্ত, নোনা, কোথাও বা তেতো। আদি গঙ্গার যে অংশগুলিতে সমীক্ষা চালিয়েছে জলাদর্শ কালেকটিভ, তার মাত্র ৩৭.৫% দেখভাল করা হয়। এর ৫০% বদ্ধ। প্রায় ৭৫% অংশজুড়ে কালো জল বয়ে চলেছে। ৭৫% অংশ আবর্জনা ফেলার জন্যে ব্যবহৃত হয়। ২৫% অংশ জুড়ে সাদা ফেনা দেখা গিয়েছে।
সার্কুলার ক্যানেলের বাগবাজার অঞ্চল, টালা থেকে উল্টোডাঙ্গা, চিংড়িঘাটা, ঘুনিমেঘি, হাড়োয়া অঞ্চলের মিউনিসিপালিটির ট্যাপের জল নোনা এবং দুর্গন্ধযুক্ত। এক সময়ে এই উৎসগুলির জল যেখানে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার হতো, সেগুলি পানের অযোগ্য। এর ১০০% অংশে জলবাহিত রোগের জীবাণুর নমুনা পেয়েছেন গবেষকরা।
আদিগঙ্গা
আরও পড়ুন-প্রতিদিনের দূষণে দায় আছে আপনার পোশাকেরও, তাহলে উপায়!
বাগজোলা খালের যাত্রাগাছি-নিউটাউন, কৃষ্ণমূর্তি ব্রিজ এলাকার জল দুর্গন্ধযুক্ত ও পানের অযোগ্য। সমীক্ষা করা অঞ্চলের মাত্র ২৫% দেখভাল করা হয়, ৮৫% অংশ জুড়ে কালো জলের প্রবাহ। ৭৫% অংশে আবর্জনা ফেলার স্থান চোখে পড়েছে গবেষকদের। তাঁরা এও দেখেছেন, এই খালের সমীক্ষা করা অংশের ৫০% জুড়ে সাদা ফেনা।টলি-পঞ্চান্নগ্রাম ক্যানেলের বাঘাযতীন, সন্তোষপুর জোড়া ব্রিজ, মুকুন্দপুর, চৌবাগা, নোনাডাঙা পানীয় জলের অবস্থাও শোচনীয়। সঙ্গে জলের লালচে ভাবও দেখা যাচ্ছে মুকুন্দপুর এলাকার মিউনিসিপালিটি থেকে আসা পানীয় জলে। সমীক্ষাস্থলের ৯০% অংশ জুড়েই আবর্জনা চোখে পড়েছে গবেষকদের। পাশাপাশি ১০০% অঞ্চলে মিলেছে জলবাহিত জীবাণুর নমুনা।
বাগজোলা খাল
আরও পড়ুন-পরিবেশ ও নিজেকে বাঁচাতে নজর দিন বাতিল হওয়া মোবাইল, কম্পিউটার. ল্যাপটপে
জলাদর্শ কালেকটিভের গবেষকদের মতে, সমীক্ষার আওতায় আসা এই জলাভূমিগুলি জুড়ে রাসায়নিক, এবং জৈব-বিপজ্জনক রাসায়নিকের প্রভাব বেশি। কলকারখানা থেকে আসা আবর্জনা নিয়েও এই শহরে সরকারি দফতর এবং জনসমক্ষে খোলামেলা আলোচনা হয় না। সাধারণ মানুষও সরকারি নির্দেশাবলী নিয়ে বিশেষ সচেতন নয় এবং সেই নির্দেশাবলী তাঁদের হাত অবধি পৌঁছয়ও না। আদিগঙ্গা, সার্কুলার ক্যানেল, বাগজোলা এবং মণিখাল সংলগ্ন অঞ্চলে ক্ষতিকর রাসায়নিক মূলত এসে মেশে বোতল তৈরির কারখানা, ট্যানারি, ক্ষুদ্র শিল্প, হাসপাতাল থেকে। অবশ্য সুন্দরবনের মতো রামসার সাইটে যেখানে কলকারাখানা গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে বিলাসবহুল পর্যটনক্ষেত্র, আর চোখে পড়ে নদীর জল চিরে বেরিয়ে যাওয়া স্পিড বোটের অশ্লীল যাতায়াত, সেখানে কলকাতার জলাভূমি…