পার্থ ইস্যুতে রাজপথ দাপাচ্ছে বামেরা, কতটা বদলাচ্ছে বিরোধী পরিসরের ছবি

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আর্থিক কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে যে মিটিংমিছিল বামপন্থীরা গত কয়েকদিন ধরে করছে, সেখানে মুখগুলি সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার 'মিছিলের মুখ' হিসেবেই আবার ফিরে এসেছে।


পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইডির হাতে গ্রেফতার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মহিলার বাড়ি থেকে একটা বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধারের পর বামপন্থীরা বোধহয় একটা দিনও ঘরে বসে থাকেননি। প্রতিদিনই মিটিং-মিছিল, জমায়েতের ভেতর দিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে এমন একটা জায়গায় বামপন্থীরা তুলে আনার চেষ্টা করছেন, যা তৃণমূল জমানার বিগত প্রায় দশ-এগারো বছরে আমরা আদৌ দেখতে পাইনি।

তৃণমূল জমানায় দুর্নীতির প্রশ্নে বামপন্থীরা আগেও আন্দোলন করেছে। নারদা-সারদা-রোজভ্যালি ইত্যাদি কেলেঙ্কারিগুলি যখন প্রকাশ্যে এসেছে, বামপন্থীরা রাস্তায় থেকেছে। কিন্তু সেই সময়ের আন্দোলনের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনাক্রমের আন্দোলনের আদৌ তুলনা চলে না।

বস্তুত গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বামপন্থীরা বিগত ছয় মাস ধরে যেভাবে গণআন্দোলনকে একটা তীব্র আকার দেওয়ার চেষ্টা করেছে, বহুদিন সেভাবে পথে নেমে আন্দোলন করতে বামপন্থীদের দেখা যায়নি। আনিস খান থেকে শুরু করে বগটুই গণহত্যা বা হাঁসখালি গণধর্ষণ, উত্তরবঙ্গে একাধিক নারী নির্যাতনের ঘটনা- প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সদ্য দায়িত্ব পাওয়া সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যেভাবে নিজে ছুটে গেছেন অকুস্থলে পরিস্থিতির মোকাবিলায়, কেবলমাত্র ফেসবুকে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে, পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিতে যেভাবে গেরিলা পদ্ধতিতেও আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, সেটা বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের কাছে সাম্প্রতিক অতীতে একটা নতুন মাত্রা সংযোগ করেছিল।

আরও পড়ুন: পার্থ প্রথম নন, এর আগেও প্রকাশ্যে গণরোষের শিকার হয়েছেন যে মন্ত্রীরা

রাজ্যের বিরোধী আন্দোলনের পরিসর কাদের হাতে থাকবে, বামপন্থী? না, সাম্প্রদায়িক বিজেপি?- এই প্রশ্নের টানাপোড়েনের ভেতরেই বিরোধী রাজনীতির ব্যাটনটি রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর, সমস্ত রকমের সমালোচনাকে অতিক্রম করে, মহম্মদ সেলিম বামপন্থীদের হাতে ফিরিয়ে এনেছেন। বিরোধী রাজনীতির সবটুকু নিয়ন্ত্রণ বামেদের হাতে ফিরে আসার আভাস স্পষ্ট হওয়ায় ইতিমধ্যেই রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।

এইরকম একটা পরিস্থিতির ভেতর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে বামপন্থীদের যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, তা কেবল বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সাধারণ মানুষ, যাঁরা হয়তো একটা সময় বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, পরে নানা কারণে বামফ্রন্টের থেকে দূরে সরে যান, তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা তাঁরা নানাভাবে উপকৃত হন, সেইসব মানুষও তৃণমূল কংগ্রেসের লাগামহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের এই ধারাবাহিক আন্দোলন দেখে একটা নতুন রকমের উৎসাহ ফিরে পাচ্ছেন।

কলকাতা মহানগরীর বুকেই হোক, মফসসল শহরগুলির প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলিতেই হোক বা প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেই হোক- গত ছয় মাস ধরে রাজ্যের এবং কেন্দ্রের শাসকদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের যে ধারাবাহিক আন্দোলন অতীতে দানা বাঁধার অবস্থায় পৌঁছেছিল, সেই অবস্থাটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ গণআন্দোলনে পর্যবসিত করে দেওয়ার যে সুযোগ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বামপন্থীদের সামনে এসেছে, সেই সুযোগটাই বামপন্থীরা হেলায় হারাতে চান না। অতীতে আমরা দেখেছি, চিটফান্ড কেলেঙ্কারি ঘিরে বামপন্থীরা আন্দোলন করেছেন। বহু লড়াই তাঁরা করেছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতাকে তাঁরা রক্ষা করতে পারেননি। করোনাকাল এসেছিল, তার মধ্যে, এটা অবশ্যই সত্যি কথা, কিন্তু তার আগে বা পরে রাজ্যের শাসকদের দুর্নীতির প্রশ্নে, চিট ফান্ডে টাকা খোয়ানো মানুষদের স্বার্থের প্রশ্নে, আন্দোলনগুলিকে তাঁরা খানিকটা ফেসবুকীয়, টুইটার হ্যান্ডেলের আন্দোলনে পরিণত করেছিলেন।

সেই প্রথাগত আন্দোলনকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেভাবে রাস্তায় নামিয়ে আনতে পেরেছেন বর্তমানে বামপন্থীরা মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে ,তাতে একথা খুব সংগত কারণেই বলতে হয় যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততার প্রশ্নটি ঘিরে যে প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছিল ,তা প্রচণ্ড রকমের আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। বস্তুত অতীতেও বামপন্থীরা নানা সময়, নানারকমভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততার প্রশ্নে, তাঁর ভাইপো সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততার প্রশ্নে, তাঁর দলীয় সতীর্থ, আত্মীয়-পরিজনদের সততার প্রশ্নে নানা ধরনের আন্দোলন করেছেন। বহু তথ্যপ্রমাণ দিয়ে তাঁরা সাংবাদিক সম্মেলন ইত্যাদিও করেছেন। কিন্তু সেই সমস্ত অভিযোগগুলিকে মানুষের দরবারে তাঁরা হাজির করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত অধ্যাবসায়ের পরিচয় রাখতে পারেননি। সেইসব অভিযোগগুলিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা তাপ-উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, একথা খুব জোর দিয়ে বলতে পারা যায় না। যাঁরা খুব গোঁড়া বামপন্থী সমর্থক, তাঁরা হয়তো সেইসব অভিযোগগুলিকে বিশ্বাস করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষদের ভেতরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সততা বা তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের ব্যক্তিগত সততার প্রশ্নে বামপন্থীদের তোলা বিষয়গুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি, বিগত নির্বাচনগুলির ফলাফলের ভেতর দিয়ে আমরা তা দেখেছি।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে দুর্নীতির প্রশ্নে, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে, সাম্প্রদায়িক বিজেপির সঙ্গে মমতার গোপন, অদৃশ্য বোঝাপড়ার প্রশ্নে, বিশেষ করে বিজেপির মূল আরএসএসের সঙ্গে তৃণমূল সুপ্রিমোর গোপন বোঝাপড়ার অভিযোগ তুলে সেলিমের নেতৃত্বে বামপন্থীরা যেভাবে আন্দোলনকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের মনে তৃণমূল শিবির সম্পর্কে একটা প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে দিতে সমর্থ হয়েছে অতি অল্প সময়ের ভেতরেই ।

সাধারণ মানুষের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের পরিচালনাধীন সরকার সম্পর্কে যে খুব ইতিবাচক ধারণা ছিল এমনটা নয়। অতীতের বামপন্থী সরকার ঘিরেও সাধারণ মানুষের একটা অংশের মধ্যে যথেষ্ট প্রশ্ন ছিল। সেই সমস্ত সংশয়কে অতিক্রম করানোর ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক প্রশ্ন- এগুলিকে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিগত দশ, এগারো বছরে বামপন্থীরা খানিকটা ইউরোপের প্রথাগত রাজনীতির আদলেই আন্দোলন করে গিয়েছেন। ফলে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে খুব অল্প সময়ের ভেতরেই আপামর বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে উঠে এসেছেন সেলিম।

সেই উঠে আসার মধ্যে কিন্তু লুকিয়ে আছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেই অভিযোগটিকে সমাজের আরও গভীরের দিকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে জনমানুষকে পরিচালিত করার কৃতিত্ব। বিগত কয়েকদিন ধরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খোদ কলকাতা শহরের বুকেই হোক, মফসসলের বুকেই হোক, বা এঁদো গ্রামগুলিতেই হোক- যে-সমস্ত মিছিল হয়েছে, মিছিল দেখতে রাস্তার দু'ধারে সাধারণ মানুষ, যাঁরা হয়তো প্রত্যক্ষভাবে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁরা জড়ো হয়েছেন।

এই যে মানুষ বামপন্থীদের মিছিল দেখতে, তাঁদের প্রতিবাদ দেখতে, তাঁদের প্রতিরোধের সংকল্প বুঝতে, তাঁরা কী বলতে চাইছেন, তা জানার জন্য আবারও বামপন্থীদের সভা-সমিতিগুলিকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করতে শুরু করেছেন, এই আঁচ আমরা পেয়েছিলাম নদিয়া জেলার সীমান্ত তীরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল হাঁসখালীর বুকে বীভৎস গণধর্ষণের পর মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে দীর্ঘ পথব্যাপী এক বিস্তীর্ণ মিছিলের মধ্য দিয়ে। যে সাধারণ মানুষ কোনও না কোনওভাবেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে উপকৃত হয়ে, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে, বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে কার্যত ভুলে গিয়েছিল, সেই মানুষ নতুন করে ভাবতে যে শুরু করেছে, তার ইঙ্গিত আমরা পেয়েছিলাম আনিস খানের গ্রামেও। রামপুরহাটেও তার ইঙ্গিত ছিল।

গণআন্দোলনের সাফল্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ওপর। অতীতে বামপন্থীরা যখন দেশভাগ-স্বাধীনতার পর বিরোধী আসনে বসেছিল, তখন গণআন্দোলনকে ধারাবাহিকভাবে তাঁরা এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল, যার ফলশ্রুতি ছিল ৩৪ বছরের সরকার। সাধারণ মানুষ, তাঁরা শাসকের বিরুদ্ধে পূঞ্জীভূত ক্ষোভকে একটা জায়গায় বহিঃপ্রকাশের পথ খুঁজে নেবে ধারাবাহিক গণআন্দোলনের ভেতর দিয়ে, কোনও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

বড় কোনও আন্দোলন হলো, আবার সব ঝিমিয়ে চুপচাপ, আবার কখন নির্বাচন সংগ্রাম আসছে, তখন নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে যদি বিরোধী রাজনৈতিক দল তাদের সাফল্য খোঁজার চেষ্টা করে, সেই সাফল্য আসবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী রাজনীতিক হিসেবে এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই কিন্তু নিজের রাজনৈতিক সাফল্য ঘরে তুলতে পেরেছিলেন।

মহ. সেলিম সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর সবথেকে লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, কোনও আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বা পরবর্তী ঘটনা ক্রমের সঙ্গে আগের ঘটনার সূত্র রচনা করে, সেই আন্দোলনকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই বিষয়টি কিন্তু ২০১১-তে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামপন্থীদের ভেতর খুব একটা লক্ষ করতে পারা যায়নি। সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে যদি সাধারণ মানুষের মতো করে তুলে ধরতে পারা না যায়, সেক্ষেত্রে গণআন্দোলন কিন্তু শাসকের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় না।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আর্থিক কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে কলকাতা শহরের বুকে, মফসসলগুলিতে যে মিটিংমিছিল বামপন্থীরা গত কয়েকদিন ধরে করছে, সেই মিটিং-মিছিলের মুখগুলি কিন্তু যেন সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার 'মিছিলের মুখ' হিসেবেই আবার ফিরে এসেছে। এঁরাই এককালে বামপন্থীদের মিটিংমিছিলে ছিলেন। নতুন প্রজন্মের মানুষ, যাঁদের বাপ-ঠাকুরদারা হয়তো একদিন মিছিলে হেঁটেছিলেন, নতুন প্রজন্ম কোন অভিমানে, কোন ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের নিরিখে বামপন্থীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। সেই সমস্ত মানুষগুলিকে আবার মিছিলে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী মানুষজনরা।

More Articles