হার মানবেন জ্যোতি বসু, নেই কোনও বিরোধী, ৪৩ বছর ধরে ক্ষমতায় এই রাষ্ট্রপ্রধান

World longest President : ৪৩ বছর ধরে অনড় টিওডোরো ওবিয়াং এনগুয়েমা এমবাসোগো

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে দলীয় রাজনীতির টানাপড়েন নতুন কিছু নয়, অথচ আফ্রিকার দেশ ইকুয়েটোরিয়াল গিনি যেন একেবারেই ব্যতিক্রম। এখানে সবটাই পূর্ব-নির্ধারিত। নির্বাচন নামক নিয়মটা কেবল ধাঁধা। আর তাতেই আটকা পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এখানে কোনো লড়াই নেই। রয়েছে কেবল একচেটিয়া অধিকার কায়েম। টিওডোরো ওবিয়াং এনগুয়েমা এমবাসোগো, এ দেশের দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রপতি তিনিই। বয়স আশি ছুঁইছুঁই, অথচ অক্লান্ত, অনড়। টানা ৪৩টা বছর ধরে কোন এক অকৃত্রিম জেতার নেশায় বুঁদ হয়ে থেকেই আরও একবার জয়ের শিরোপা এখন তাঁর মাথায়।

অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি এবং আফ্রিকান শাসনব্যবস্থার অধ্যাপক আনা লুসিয়ার কথাগুলি। কিছুদিন আগেই একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এসব নির্বাচন তো শুধুই লোকদেখানো। এর ফলে কিছুই বদলাবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট এবারও অন্তত ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হবেন। কিন্তু কী এই রহস্য, যার জেরে কিনা এতগুলো বছরেও আসনখানা টলাতে পারলো না কেউই? আচ্ছা এতবারের এই জয় কি কেবল সুশাসনের প্রতিচ্ছবি নাকি এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে অন্য গল্প? ভিড় করে অজস্র সব প্রশ্ন।

আরও পড়ুন : বিনিয়োগে ব‍্যাপক রিটার্ন! যেভাবে টাটা-র শেয়ার আপনাকে করে তুলবে কোটিপতি

১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজের চাচাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ওবিয়াং। সেই থেকে একা হাতে দেশ শাসন করছেন তিনি। এরই মধ্যে ২০১১-২০১২ সময়কালে এক বছরের জন্য আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলির জোট আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারপারসনও ছিলেন ওবিয়াং। শাসনক্ষমতায় থাকার অস্ত্র হিসেবে একদিন দারিদ্র্যকেই ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন তিনি অথচ এ দেশেই চরমমাত্রায় বিরাজ করছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা হচ্ছে আরও গরিব।

জানা যায়, ইকুয়েটোরিয়াল গিনিতে মানুষের ভোটের স্বাধীনতা নেই। দেশটির সব গণমাধ্যমই সরকার এবং তার সহযোগী গোষ্ঠীদের নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতা ধরে রাখতে যা ঠিক যা যা করা দরকার, বর্তমান প্রেসিডেন্ট তার সবই করে যাচ্ছেন। গুম, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অজস্র অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিরোধী দলের কিছু প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলেও এই পাতানো নির্বাচনে কেউই খুব একটা এঁটে উঠতে পারেন না। তাদের অনেকই দাবি করেছেন, দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই। নেই কথা বলার সুযোগও। একপ্রকার পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে দেশ।

এর আগে বেশ কয়েকবার মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগও উঠেছিল ওবিয়াংয়ের বিরুদ্ধে। যদিও ফলাফলে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি সেসব কিছুই। অবশ্য রাজনীতির খেলায় ক্ষমতার ভিত্তি পাকাপোক্ত করতে বুঝি চরম কুখ্যাতদেরও চেহারা বদল করতে হয় মাঝেমাঝে, তাই ওবিয়াংও বুঝি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের চরিত্রের কালিমা মোছার চেষ্টা শুরু করেছেন। সম্প্রতি দেশটিতে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বাতিল করে দেন তিনি। ইকুয়াটোরিয়াল গিনির এই ঘটনা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রশংসাও কুড়িয়েছে।

আরও পড়ুন : দক্ষিণ আমেরিকায় লাল সূর্যোদয়? ব্রাজিলে বামপন্থী প্রেসিডেন্টের নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে দিল

খনিজ তেলে সমৃদ্ধ দেশ গিনি। এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ওবিয়াং ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বেশ শক্তভাবে আসন গেঁড়ে বসেছেন। ওবিয়াং-এর ছেলে তেওডোরো এনগুয়েমা ওবিয়াং ম্যাঙ্গু দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধেও ইউরোপ-আমেরিকায় বিলাসবহুল জীবনযাপনের অভিযোগ রয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি শাসনের নমুনা অবশ্য এই প্রথম নয়। ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা রাণী এলিজাবেথ এরা তো আগেই দেখছেন পথ। এমনকি খোদ বাংলার একসময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও তো টানা ২৩ বছর রাজত্ব করেছেন। যদিও জ্যোতিবাবু ওডিয়াং-এর কাছে হার মানবেন। এই যে আজকাল শাসক গোষ্ঠী হামেশাই বিরোধী শূন্য হওয়ার হুংকার দেন, তার সঙ্গেও তো প্রচ্ছন্ন যোগ রয়েছে এই একাধিপত্য স্থাপনের। কিন্তু সব কিছুরই একটা শেষ আছে। রাস্তা যতোই কঠিন হোক, বদল আসে। আসতেই হয়। তাই গিনিতে বিরোধীদের ধামা চাপা দিয়ে অথবা সংবাদ মাধ্যমের হল টিপে ধরলেও একদিন বদল অনিবার্য। আগুন যতোই ছাই চাপা থাকুক, একটা অন্যরকম হওয়া দিলেই তা জ্বলে ওঠে। ইকুয়েটোরিয়াল গিনির সাধারণ মানুষও সেই হাওয়াটার দিকেই তাকিয়ে।এরকম সময়ে রবীন্দ্রনাথকে বড্ড দরকার ওদের, যিনি এসে বলবেন, “আমি ভয় করব না, ভয় করব না/ দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না॥”

More Articles