উচ্চবর্ণের মলমূত্র আজও সাফাইয়ের দায় ওদের! আর কতদিন চলবে এই অন্যায়!

মানুষের মলমূত্র মানুষকে দিয়ে সাফাই এবং বহন করানোটা ভারতের সমাজব্যবস্থায় প্রাচীনকাল থেকেই চালু।  নিম্নবর্ণের মানুষকে দিয়ে এই কাজ করানো হয়ে এসেছে। যদিও বর্তমানে মানুষকে দিয়ে এধরনের কাজ করানো বেআইনি। ধরা পড়লে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নিদান আছে। ১৯৯৩ সালে এই কাজটি বেআইনি হিসেবে ঘোষিত হয়। এরপর ২০১৩ সালে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে তাতে ভবী ভোলবার নয়।

হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত উচ্চবর্ণের একশ্রেণির মানুষ একই ধর্মের অন্তর্গত নিম্নবর্ণের মানুষকে দিয়ে আজও মলমূত্র সাফাই ও বহনের কাজটা অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও একাজ করানো মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার সমতুল। এ ব্যাপারে কর্ণাটক হাইকোর্টের অভিমত, কোনও মানুষকে দিয়ে মানুষের মলমুত্র সাফাই এবং বহন করানোটা ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ২১ এর পরিপন্থী। 'দি ইন্টারন্যাশনাল দলিত সলিডারিটি নেটওয়ার্ক' প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, এই বরাবরই কাজ করানো হচ্ছে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে দিয়ে। মলমূত্র সাফাইয়ের কাজ প্রধানত করানো হয় পুরুষদের দিয়ে। আর মলমূত্র বহনের কাজে নিযুক্তদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই মহিলা। প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের পাশাপাশি মলমূত্র বহনের কাজে লাগানো হচ্ছে নাবালিকাদেরও।

ভারত স্বাধীন হওয়ার ৭৫ তম বর্ষেও ভারতীয় সমাজে জাতপাতভিত্তিক ভেদাভেদ প্রকট। দেশ স্বাধীনের পর সাত দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এদেশের দরিদ্র নারীর  ক্ষমতায়নের কাজ অনেকটাই বাকি পড়ে রয়েছে। দলিত মহিলাদের ব্যাপক অংশকে উচ্চবর্ণের একশ্রেণির মানুষ যেভাবে মলমূত্র বহনের কাজে ব্যবহার করছে, সেটা একদিকে সামাজিক অভিশাপ। অন্যদিকে চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত।

জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদ আজও ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় বহাল তবিয়তেই বিরাজমান। যে সমস্ত দলিত নারীপুরুষকে দিয়ে বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির যুগেও মলমূত্র সাফাই এবং বহনের কাজ একরকম জোর করেই করানো হচ্ছে এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের যথাযথ সরকারি ব্যবস্থা না থাকার ফলে এই কাজ না করেও উপায় নেই।

ভাঙ্গি, বাল্মীকি, মাহার, মেথর গোষ্ঠীর মেয়েদের কাজে লাগানো হচ্ছে মলমূত্র বহনে। এদের মজুরি নামমাত্র। ন্যূনতম মজুরির কোনও প্রশ্ন নেই। কিছুক্ষেত্রে চালডাল মেলে। অথবা বড়জোর ৫ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক। তাও অনেকক্ষেত্রে ওঁরা শেষপর্যন্ত হাতে পান না। উপরন্তু ওই মহিলাদের মধ্যে অনেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার।

একে দারিদ্র্য, তার ওপর বর্ণাশ্রমের সর্বনিম্ন ধাপে 'অতিশূদ্র' হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ফলে এই মহিলাদের জীবনধারণ করাটা প্রতিদিনের কঠোর সংগ্রামের অঙ্গ। করোনা পরিস্থিতিতে ওদের দুর্দশা আরও বেড়েছে। এই নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে কোনো তথ্য পরিসংখ্যান-ভিত্তিক প্রতিবেদন দেখতে পাওয়া যায় না।

এই ছবি ভারতের সর্বত্রই। মহিলা সাফাই কর্মীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে উদ্বেগজনক তথ্য।  যেমন, 'ন্যাশনাল কমিশন ফর সাফাই কর্মচারীস', 'ন্যাশনাল সাফাই কর্মচারীস  ফিনান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন'-এর মতো সংস্থা মানুষের মলমূত্র মানুষকে দিয়ে সাফাই এবং বহন করানো বন্ধে অসফলই বলা যেতে পারে।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির অভিযোগ, মলমূত্র সাফাই এবং বহনের কাজ যে সমস্ত নারী - পুরুষকে দিয়ে করানো হচ্ছে তাঁরা পুনর্বাসনও পাচ্ছেন না। তাছাড়া পুনর্বাসন বাবদ যে টাকাটা এককালীন বরাদ্দ তার পরিমাণ মোটে ৫৩ হাজার। অন্য দিকে, এই খাতে বাজেট বরাদ্দের পুরো টাকাও খরচ করা হচ্ছে না। পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে খাতায় কলমে রয়েছে 'সেলফ এমপ্লয়মেন্ট স্কিম ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার'।

সরকারি প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার অভাবই পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত করছে দুঃস্থ ওই নারী - পুরুষকে। এমনকি যে নাবালিকাদের দিয়ে মলমূত্র বহনের কাজ করানো হচ্ছে তারা প্রাথমিক স্কুলে পঠনপাঠনের সুযোগলাভ করা থেকেও বঞ্চিত বলে একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে।

'সাফাই কর্মচারী আন্দোলন' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মানুষকে দিয়ে মানুষের মলমূত্র সাফ করানো এবং বহন বন্ধের দাবিতে লড়ছে। সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নেতা বি উইলসন বললেন,  'প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বচ্ছ ভারত অভিযান এই সমস্যা মোকাবিলায় একেবারেই কার্যকর নয়। কারণ স্বচ্ছ ভারত অভিযানে যে শৌচাগারগুলি তৈরি করা হচ্ছে সেগুলি সিঙ্গল পিটের। টুইন পিটের শৌচাগার নির্মিত হলে মলমূত্র মানুষকে দিয়ে সাফ অথবা বহন করানোর দরকার পড়ত না। এছাড়া ভারতে সেপটিক ট্যাঙ্কগুলি আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থার  সঙ্গে যুক্ত নয়। ফলে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজ ও মলমূত্র বহনের কাজটা মানুষকে দিয়েই করানো  হচ্ছে'। মলমূত্র সাফ এবং বহনকারীদের মধ্যে অতি স্বল্প সংখ্যক মানুষ 'ন্যাশনাল আরবান লাইভলিহুড মিশন' প্রকল্পে উপকৃত হয়েছেন বলেও অভিযোগ 'ন্যাশনাল সাফাই কর্মচারী আন্দোলন' নামে ওই সংস্থার।

নর্দমা, সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে মানুষের মলমূত্র পরিষ্কারের কাজ করেন মূলত পুরুষেরা। সেই বর্জ্য ঝুড়ি কিংবা বালতিতে চাপিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে ফেলে দেওয়ার কাজটা করেন সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মহিলারা। এই কাজের ধরন এটাই।

অতীব অস্বাস্থ্যকর এই কাজে নিযুক্ত নারী ও পুরুষ দুতরফই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কোনও চিকিৎসা জুটছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। জটিল চর্মরোগ থেকে শুরু করে শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুখ অথবা চরম হতাশায় আক্রান্ত হচ্ছেন মহিলারা।

২০২১ সালে কেন্দ্রীয় ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক পরিসংখ্যান পেশ করে জানিয়েছে, নিকাশিপথ এবং সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪০ জন। এর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক প্রাণ হারিয়েছেন উত্তরপ্রদেশে। সংখ্যাটা ৫২ জন। এরপর স্থান তামিলনাড়ুর। দক্ষিণের এই রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩ জন। মৃত্যুর নিরিখে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম স্থান দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার। দিল্লিতে ৩৬ জন, মহারাষ্ট্রে ৩৪ এবং হরিয়ানায় ৩১ জন প্রাণ হারিয়েছেন বিষাক্ত গ্যাসে।

স্বেচ্ছাসেবীরা বারবারই অভিযোগ তুলছেন, সেপটিক ট্যাঙ্ক, নর্দমা ইত্যাদি পরিষ্কারের কাজ করানো হচ্ছে বেআইনিভাবে যাঁদের দিয়ে করানো হচ্ছে কাজ করাকালীন মাস্ক-সহ অন্য সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলিও তাঁরা পান না। এছাড়া ভারতীয় সমাজের যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে দিয়ে সাফাইয়ের কাজ করানো হচ্ছে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই প্রাথমিক স্কুলে পঠনপাঠনের সুযোগটুকুও পাননি। বৈদিক যুগ থেকেই যে অবহেলিত এঁরা। 'নারদ সংহিতা'-তে নিম্নবর্ণের মানুষকে দিয়ে মানুষের মলমূত্র সাফ করানো এবং বহনের প্রসঙ্গটির উল্লেখ রয়েছে। আর সভ্যতার অগ্রগতির যুগেও এই জঘন্য পেশা থেকে মুক্তি মেলেনি ওঁদের। প্রতিবছর সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ।

'সাফাই কর্মচারী আন্দোলন' সূত্রে এও জানা গিয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসে ৪২৯ জন সাফাইকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে ৫৯ শতাংশ ক্ষেত্রে এফআইআর দায়েরের কোনও বালাই নেই। যে ঠিকাদার মারফত এই সাফাইকর্মীদের কাজে নিয়োগ করা হয়, ফাঁকতালে ওরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে। মানুষকে দিয়ে মানুষের মলমূত্র সাফ করানো এবং বহন করানোটা অপরাধ। এছাড়া এই কাজ করাকালীন যদি কেউ মারা যান তাঁর পরিবারকে এককালীন ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিলেও তা মানা হয়নি কোনওক্ষেত্রেই। 'সাফাই কর্মচারী আন্দোলন'-এর তরফে এই অভিযোগ বারংবার দায়ের করা হয়েছে।

কবে এই সামাজিক ব্যাধি ভারতের মাটি থেকে বিলুপ্ত হবে তা নিয়ে আজও ঘোর অনিশ্চয়তা!

More Articles