আমি হলাম জনমকানা

Philosophy of Blindness : রীনা দাস তেমনই একজন। চোখ বুঝে ধরে ধরে গান গাইছেন। শুনে মনে হবে শান্ত জলে নৌকো বাইছে কেউ। আমার চোখ যে ভিডিওতে আটকাল সেখানে তিনি ধ্যানস্থ হয়ে গাইছেন,

আগে শীত এলেই গানের কাছে ছুটে যেতাম। নতুন শতকের প্রথম দশক সেটা। আমাদের চোখ ফুটছিল। তখন আলো তত ছিল না। এমেলা-সেমেলায় ঘুরলে তখনও দু'একজন তত্ত্বজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। চাকচিক্যবিহীন, গায়ে তেলচিটে গন্ধ খুচরো লোক চেনা-অচেনা গান শোনাতেন নিরালায় বসে। ফিরতাম গানটা সঙ্গে নিয়ে। বাসের মাথায় বসে আছি। হুহু করে হাওয়া দিচ্ছে। আমার পাশে বসে আছে গানের কথা। অনেকদিন সঙ্গে সঙ্গেই থাকত সে। তারপর কোনো ভাঙা বিকেলে আমায় ছেড়ে চলে যেত। অথবা একটু প্রচ্ছন্ন ছায়ার মতো দূরের হয়ে যেত তার অবয়ব।

এখন আর তেমন ভাবে গান খুঁজতে যাই না। যাওয়ার সুযোগ নেই। মেলাখেলার চেহারাও বদলে গিয়েছে। তখন যাদের গান শুনেছি নির্জনে, তাদের অনেকে গানের গলা পুঁজি করে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। স্বচ্ছলতা এসেছে কারও কারও, দেখে ভালো লাগে। কিন্তু ওই, হঠাৎ একটি পদের নিগূঢ় রূপ উন্মোচন এ আজ প্রকৃতই দুর্লভ আমার জন্যে, বোধহয় ব্যস্ত গাইয়ের জন্যে। কিন্তু স্বাভাবিকতার ব্যতিক্রম তো থাকেই। আকস্মিকের খেলায়, ফেসবুকে আবিষ্কার করলাম ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়ের বল্লভপুরের আখড়ায় নিরালায় বসে গান গাইছেন রীনা দাস বাউল। ল্যাডলীদা কলকাতার পাট চুকিয়ে বল্লভপুরে থিতু হয়েছেন, তাও একদশক হয়ে গেল বোধহয়। তার উঠোনে এমন গানের আসর সারা বছর বসে। কোনো বাড়তি বাহুল্য নেই সেইসব আসরের। আছে জ্ঞানক্ষ্যাপা, তত্ত্বজ্ঞানী লোকের যাতায়াত। রীনা দাস তেমনই একজন। চোখ বুঝে ধরে ধরে গান গাইছেন। শুনে মনে হবে শান্ত জলে নৌকো বাইছে কেউ। আমার চোখ যে ভিডিওতে আটকাল সেখানে তিনি ধ্যানস্থ হয়ে গাইছেন,

আমার ঘরের চাবি
পরের হাতে রে...

কোনো তাড়া নেই। বাংলা ব্যান্ড এই গানটিকে হত্যাই করেছে বলা যায়। আজ লয় ফেলে গানটার জাল বুনছেন রীনা। ফাঁদ পাতছেন, যে সে ফাঁদে পড়বে তার আর মুক্তি নেই। আমার মন যেমন আটকে গেল-"হইলাম আমি অধম জন্মকানা" অংশে। 'জনম্' নয়, রীনা উচ্চারণ করছেন জন্ম। এই সামান্য উচ্চারণ বদলে দেখলাম, 'আমি' শব্দটায় আমার মনটা আর আগের মতো থিতু হচ্ছে না। বদলে গিয়ে বসছে ওই জন্মকানায়। এ জন্ম শুধু নয়, জন্মজন্মান্তর, জন্মের পর জন্ম, আসার যাওয়ার মাঝে, সময়ের অনন্তগমনে একজন দাঁড়িয়ে আছে, একজন জন্মকানা। কে সে?

লালনের গানে এই কানা বারবার এসেছে। এই গানে যে জন্মকানা সে নিজের ঘরের চাবি পরকে দিয়ে বসে আছে। নিজের ঘরের স্বর্ণভাণ্ডারের দিকে সে তাকায়নি। নিজের ঘর মানে এখানে 'দেহ'৷ বাউল মনে করে, ঈশ্বরকে খুঁজতে উপাসনালয়ে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে দেহভাণ্ডে। চোখ দিয়ে আমি যেমন পরকে দেখব, তেমন আত্মকেও তো দেখব৷ যার আত্মপ্রশ্নই জাগেনি, যে নিজেকে সিকিভাগও চেনেনি, সে জন্মজন্মান্তর চোখ থাকতেও অন্ধ।

অবশ্য 'কানা' শব্দটির নানারকম দ্যোতনা লালনের পদে ঘুরে ফিরে এসেছে। যেমন আরেকটি জনপ্রিয়তম পদ কানার হাটবাজার। এখানে হাটবাজার মানে সমাজ। লালন সমাজের নানা উচ্চকোটির চরিত্রকে উপস্থিত করছেন তার বৈশিষ্ট্য-সহ। তিনি দেখাচ্ছেন এই সমাজটা অন্ধ লোকে ভরা। এই অন্ধ কিন্তু চক্ষুষ্মান। তার অন্ধত্ব অজ্ঞানতার, অন্ধত্ব অহং-এর। প্রথমে উল্লেখিত গানে 'কানা' শব্দটি নিজেকে খুঁজতে না পারার ব্যর্থতা প্রতীয়মান করেছে। আর এই কানার হাটবাজার গানে 'কানা' শব্দটি এসেছে স্খলন বোঝাতে। যার স্খলন ঘটে যায় সে বোঝে না। কিন্তু সমাজের চালচিত্রে সমষ্টির স্খলনগুলি প্রকট হয়ে থাকে।
লালন লিখছেন-

পণ্ডিত কানা অহংকারে
মাতবর কানা চুগলখোরে
সাধু কানা অন্- বিচারে
আন্দাজে এক খুঁটি গাড়ে
জানে না সীমানা কার
এসব দেখি কানার হাটবাজার।

আমি বাউল বিশেষজ্ঞ নয়। গূঢ়কথার কিছুই জানি না। কিন্তু সাদা চোখে এ গানখানা দেখলেই মনে হবে, আমাদের স্বভাবের মধ্যেই যে বিচ্যুতিগুলি রয়ে গেছে তাকে কটাক্ষ করছেন লালন। যে পণ্ডিত তাঁর গুমোর জ্ঞান। জ্ঞান যে কারও নয়, জ্ঞান যে স্রেফ বিতরণযোগ্যতার শর্ত নিয়েই একজন সাধারণ ব্যক্তির কাছে ধরা দেয় এই বোধের অভাব লালনের কাছে অন্ধত্ব। মাতব্বরের কাজ নিদান দেওয়া। সমদৃষ্টি, নিরপেক্ষতা তাঁর আবশ্যিক গুণ। অথচ তাকে সর্বদাই পরিচালনা করে একজন ক্ষমতাবান। রাখঢাক না রেখে লালন বলছেন 'চুগলখোর। এর প্রভাবেই খাপ পঞ্চায়েতে বিধান দেয় মাতব্বর। সাধুর বিচার অভ্রান্ত হওয়ার কথা। অথচ দেশকাল ভেদে বারবার দেখা যায় তিনি নিজেই 'অন্ বিচার' করছেন৷ লালনের আক্ষেপ, এই অন্ধরা একে অন্যের হাত ধরে জীবনের পথ পেরোচ্ছে। কেউ জেনেও জানে না, মেনেও মানে না এই অন্ধত্বের কথা। কারও মনে পড়তে পারে জীবনানন্দ দাশের পঙক্তি-

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

মোদ্দা কথা, গোটা কারবারটাতে অন্ধলোকের ভিড়। আজ নয় অনন্তকাল ধরে হয়ে আসছে এমনটা। বৌদ্ধশাস্ত্রে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অন্ধের হস্তিদর্শণের গল্প পাওয়া যায়। দেখা যায়, এক শহরে হাতি এসেছে। একদল অন্ধ লোক হস্তিদর্শনে গিয়েছে। একজন হাতির শুঁড়ে হাত বুলিয়ে ভাবছে, এটা একটা সাপ। অন্যজন হাতির কানে হাত বুলিয়ে ভাবছে এটা চামর। যার হাত হাতির পায়ে সে ভাবছে, ওটা কোনো গাছ। আর যে দেহে হাত বোলাচ্ছে সে ভাবছে, এ বিরাট দেওয়াল। এই গল্প দেখায়, যার চোখ ফোটেনি সে সত্যকে কখনও পুরোপুরি জানবে না। হয়তো সে ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতায় কোনো বস্তু একভাবে ধরা দিচ্ছে। কিন্তু সেটাই বস্তুর স্বরূপ নয়। স্বরূপ জানতে দেখার চোখ থাকা চাই। যা দেখছ তাকে বারবার যাচাই করতে হবে। যত জানি, তত জানিনে- এই সত্যকে মাথা পেতে মেনে নিতে হবে। ক্রমে অন্যেকে জানতে চিনতে হবে। মনে পড়তে পারে লালনের গান-

বাড়ির পাশে আরশিনগর
সেথা এক পরশি বসত করে
আমি একদিন না দেখিলাম তারে।

দেশ দেশান্তরে পাড়ি দিয়েছে অন্ধের হস্তিদর্শনের কাহিনী। বৌদ্ধ জৈন  হিন্দু তিন ধর্মেই সামান্য রূপ বদলে ফিরেছে এই গল্প। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে জাপানের হাইকু কবি, ক্যালিগ্রাফার হানাবুসা ইচোর প্রিন্টে দেখা যায়, হাতির পরিচর্যা করছে সাত অন্ধ। আসলে ধর্মগুরুদের  ধর্মের পাঠ না জানাকেও ব্যঙ্গ করছে এই ছবি৷ লালনের ভাষায় যা- বেদ বিধির পর শাস্ত্রকানা।

Elephant and seven man Hanabusa Itcho Painting

হানাবুসা ইচোর আঁকা সেই ছবি।

যে পাশেই আছে, যাকে চাইলেই ছুঁয়ে দেখা যায়, কেন দেখতে পেলাম না তাকে? কেন আমার জানা অসম্পূর্ণ রইল? উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকেই প্রথম চাবুক মারেন লালন। লেখেন-

আবার তেমনি লালন মদনা কানা

ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার

বাহার দেওয়া মানে কী? নিজেকে প্রদর্শন করা, মেলে ধরা। প্রদর্শনকামিতার অভ্যেসকে ঘুমঘোরে নিয়ে ফেললেন লালন। একজন প্রকৃত জ্ঞানী সক্রেটিস ছিলেন চালচুলোহীন। ময়লা পোশাক পরতেন৷ শ্রীচৈতন্য থাকতেন সামান্য গম্ভীরায়। অথচ সামান্য অর্জনেই কত বাহার দেওয়া দেখতে হয় রোজ। সত্যিই যদি জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হতো, তবে কি এই দেখানেপনা থাকত?

গ্রিক নাটকে অন্ধত্ব ঘুরে-ফিরে আসে। থেবাইয়ের মহাত্মা টাইরেসিয়াস অন্ধ। অ্যাথেনাকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখে তার চোখ পুড়ে গিয়েছে। কেউ আবার বলে, আকাশের দেবতা জিউসের পক্ষ নেওয়ার জন্যে তাকে অন্ধ করে দিয়েছেন বিবাহের দেবী হেরা। একটি তৃতীয় মতও রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ঈশ্বরের গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার অপরাধে তিনি অন্ধ। অন্ধ অয়দিপাউস। কেউ করেনি। সে নিজেই নিজেকে অন্ধ করেছে। ইয়োকাস্তে যখন জানলেন গর্ভের সন্তান পিতাকে হত্যা করেছে, তাঁকে ভোগ করেছে তখন তিনি আত্মহত্যা করলেন। অয়দিপাউস  তার ভুলের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন। রানির চুলের কাঁটা নিজের চোখে ঢুকিয়ে দেন। কেন অন্ধ হলো অয়দিপাউস? যা তার দেখার নয় তা সে দেখেছে বলে। যা তার দেখার তা দেখেনি বলে।

অন্ধ ইলিয়ড-ওডিসি রচয়িতা হোমার। বলা হয়, অ্যাকিলিসের অস্ত্রের ঝলকানি দেখে অন্ধ হয়ে যান হোমার। ওডিসিতে ডারমোডোকাস নামের অন্ধ অকুতোভয় কবির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ 'মাতৃদোষে'।  বেদবাসের কৃষ্ণ বর্ণ, দীপ্ত নয়ন ও পিঙ্গল জটা-শ্মশ্রু দেখে অম্বিকা ভয়ে নাকি চোখ বুঝে ফেলেন। ব্যাস বাইরে এলে সত্যবতী প্রশ্ন করেন, এর গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো? ব্যাস নাকি উত্তর দেন, এই পুত্র শতহস্তিতুল্য বলবান, বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং শতপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে অন্ধ হবে। অন্ধত্বের কথা আছে খ্রিস্টিয় আখ্যানেও। জনের সমাচারে দেখা যায়, এক অন্ধলোক চক্ষুস্মান হয় যিশুর ছোঁয়াচে। মনে হয়, বলা হচ্ছে, যিশু পৃথিবীতে এসেছেন যাতে অন্ধও আলো  পায়। 

২৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ লিখবেন,

অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ--
তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান॥

জীবনানন্দ-রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন দার্শনিক মার্গের কবি। জীবনানন্দের লেখায় অন্ধরাই পৃথিবীর ক্ষমতায়। তাদের হৃদয়ে করুণার আলোড়ন নেই। আর রবীন্দ্রনাথ চান সেই অন্ধ যেন আলো পায়। লালনের কাব্যে অন্ধ  সেই আমি যে ঘুমের মধ্যে বাহার দেয়। কেমনতর আলো অন্ধ আমার চাই? যে আলোয় নিজের দিকে ফেরা যাবে।

More Articles